সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ হোক বা রাজ্য পুলিশ-প্রশাসনের নির্দেশ, কোনও ঘটনা ঘটলে থানার এলাকা নিয়ে টানাটানি আজও অব্যাহত। অভিযোগ, এ বার এই টানাপড়েনের শিকার হল ভিন্ রাজ্য থেকে আসা এক কিশোরী। ধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে টানা পাঁচ ঘণ্টা তাকে ঘুরতে হল এক থানা থেকে অন্য থানায়। শেষে মাঝরাতে এক স্বেচচ্ছাসেবী সংস্থার সহযোগিতায় তার অভিযোগ নিয়েছে রেল পুলিশ। ঘটনাস্থল, হাওড়া স্টেশন এলাকা।
ঠিক কী ঘটেছিল? রেল পুলিশ সূত্রে খবর, মত্ত বাবার অত্যাচার থেকে বাঁচতে সোমবার রাতে পটনা থেকে ট্রেনে হাওড়া স্টেশনে এসে পৌঁছয় ওই কিশোরী। পটনার রাজচন্দ্রপুরে তার বাড়িতে রয়েছেন বাবা ও ঠাকুরমা। মা বহু আগেই মারা গিয়েছেন। কিশোরীর অভিযোগ, চতুর্থ শ্রেণির পরে তার পড়াশোনাও ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
প্রাথমিক তদন্তের পরে রেল পুলিশ জানায়, হাওড়া স্টেশনে এসে ৭ নম্বর প্ল্যাটফর্মে আশ্রয় নিয়েছিল ওই কিশোরী। মঙ্গলবার রাতে খাবারের খোঁজে বেরিয়ে স্টেশনের বাইরে গোলাবাড়ি ট্রাফিক গার্ড বুথের সামনে এক যুবকের সঙ্গে তার আলাপ হয়। ওই কিশোরীর অভিযোগ, সব ঘটনা শুনে ওই যুবক তাকে কাজ পাইয়ে দেবে বলে কথা দেয়। এর পরে গোলাবাড়ি থানার মুখরাম কানোরিয়া রোডে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে একাধিক বার ধর্ষণ করে।
রেল পুলিশ জানায়, মঙ্গলবার ভোরে মেয়েটিকে হাওড়া স্টেশনের সামনে ছেড়ে দিয়ে চলে যায় ওই যুবক। বিকেলে সাত নম্বর প্ল্যাটফর্মে এক কিশোরী কান্নাকাটি করছে শুনে হাওড়া স্টেশনের অনাথ শিশুদের নিয়ে কাজ করা একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা তাকে উদ্ধার করে। সেখানেও ওই কিশোরী পুরো ঘটনা জানায়। ওই সংস্থার তরফে তাকে পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়েরের পরামর্শ দেওয়া হয়। আর অভিযোগ, এর পর থেকেই শুরু হয় ওই কিশোরীর হয়রানি।
বুধবার ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সভাপতি কে জায়সবাল জানান, মেয়েটিকে নিয়ে তাঁরা প্রথমে ধর্ষণের অভিযোগ জানাতে যান হাওড়া জিআরপি থানায়। তখন রাত ৮টা। কিন্তু ধর্ষণ জিআরপি এলাকায় হয়নি দাবি করে সেখানে প্রায় তিন ঘণ্টা বসিয়ে রাখা হয়। তার পরে এক অফিসারের সঙ্গে ওই কিশোরীকে গোলাবাড়ি থানায় পাঠানো হয়। কিন্তু গোলাবাড়ি থানাও অভিযোগ নিতে অস্বীকার করে বলে অভিযোগ। দায়িত্বে থাকা অফিসার জানান, একমাত্র মহিলা থানাতেই এই অভিযোগ নেওয়া হবে। শেষে ওই থানা থেকে সকলে যান হাওড়া পুলিশ কমিশনারেটের মহিলা থানায়।
কে জায়সবালের অভিযোগ, ‘‘মহিলা থানায় যখন যাওয়া হয়, তখন রাত ১২টা। তারাও ওই কিশোরীর অভিযোগ নিতে অস্বীকার করে। শেষে হাওড়া জিআরপি-ই অভিযোগ নেয়। তখন রাত ১টা। আমাদের প্রশ্ন, কোনও সভ্য দেশে ধর্ষণের অভিযোগ করতে যাওয়া কোনও মেয়েকে এ ভাবে হয়রান করা হয় কি?’’
রেল পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, এ দিন হাওড়া জেলা হাসপাতালে মেডিক্যাল পরীক্ষার পরে ওই কিশোরীকে হাওড়া জেলা শিশুকল্যাণ সমিতিতে পাঠানো হয়। সেখান থেকে আদালতের নির্দেশে তাঁকে হোমে পাঠানো হয়েছে। ঘটনার পর থেকেই অভিযুক্ত যুবক পলাতক। তাঁর খোঁজে তল্লাশি শুরু করেছে পুলিশ।
অভিযোগ নেওয়ার এই টানাপড়েন নিয়ে কী বলছেন রেল পুলিশ ও সিটি পুলিশের কর্তারা?
হাওড়ার রেল পুলিশ সুপার নীলাদ্রি চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘তিন ঘণ্টা বসিয়ে রাখার বিষয়টা জানি না। তবে ওর অভিযোগ আমরাই নিয়েছি।’’
হাওড়ার পুলিশ কমিশনার দেবেন্দ্রপ্রকাশ সিংহের বক্তব্য, অভিযোগ নিতে না চাওয়ার কথা ঠিক নয়। তাঁর দাবি, রাতে গোলাবাড়ি থানায় মহিলা পুলিশ অফিসার থাকেন না। বেশি রাতে এই ধরনের কেস এলে মহিলা থানায় পাঠানো হয়।
এ ক্ষেত্রেও তা-ই করা হয়েছিল। কিন্তু মহিলা থানা অভিযোগ নিতে অস্বীকার করল কেন? পুলিশ কমিশনার বলেন, ‘‘মহিলা থানার কাছে ওই কিশোরী যাওয়ার পরে হাওড়া জিআরপি থেকে জানানো হয় তারাই কেসটা করবে। তাই মহিলা থানা কেসটা করেনি।’’
কিন্তু এ সবের জন্য যে পাঁচ ঘণ্টা ধরে ওই কিশোরীর হয়রানি হয়েছে, তা অবশ্য দুই কর্তাই জানেন না।
এ ঘটনায় উদ্বিগ্ন মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘পারিবারিক অত্যাচার থেকে বাঁচতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেও মেয়েটি অত্যাচারিত হল। এ ক্ষেত্রে প্রশাসনও যদি অভিযোগ নিতে পাঁচ ঘণ্টা দেরি করে, তা হলে আমরা মেয়েরা যাব কোথায়?’’
বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগ করা হয়েছিল রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের ডিজি নপরাজিত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। কিন্তু পুরো ঘটনা শুনেও তিনি এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy