Advertisement
E-Paper

পড়াচ্ছে পুলিশই, কমছে অপরাধ

কমছে সামান্য জমি নিয়ে মারপিট, বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের জেরে সংসারের ভাঙনের মতো সামাজিক সমস্যাও।

পীযূষ নন্দী

শেষ আপডেট: ১৭ মে ২০১৯ ০২:২৮
দৃষ্টান্ত: ক্লাস নিচ্ছেন বাপি হালদার। —নিজস্ব চিত্র

দৃষ্টান্ত: ক্লাস নিচ্ছেন বাপি হালদার। —নিজস্ব চিত্র

চুরি, ছিনতাই, লুটপাট কমছে।

কমছে সামান্য জমি নিয়ে মারপিট, বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের জেরে সংসারের ভাঙনের মতো সামাজিক সমস্যাও।

বাড়ছে গ্রামবাসীর আত্মবিশ্বাস। স্কুলে ফিরছে স্কুলছুটরা। স্বনির্ভর হওয়ার দিশা পাচ্ছেন বেকার যুবক-যুবতীরা।

মাত্র পাঁচ মাসেই গোঘাটের পশ্চিম মেদিনীপুরের সীমানাবর্তী অন্তত ২০টি গ্রামের ভোল বদলে দিয়েছেন বদনগঞ্জ বিট অফিসের (ফাঁড়ি) সাব-ইনস্পেক্টর বাপি হালদার। প্রশিক্ষণ কেন্দ্র তৈরি করে তিনি বিভিন্ন চাকরির প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য গ্রামবাসীদের তৈরি হওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। দুঃস্থ পরিবারের চতুর্থ থেকে নবম শ্রেণির পড়ুয়াদের পড়াচ্ছেন। গ্রামবাসীর সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক তৈরি করেছেন। কোথাও কোনও অশান্তি চরম আকার নেওয়ার আগেই খবর পেয়ে পৌঁছে যাচ্ছে পুলিশ।

গ্রামবাসীরা সকলেই মানছেন ‘ছোটবাবু’র (সাব-ইন্সপেক্টরকে ওই নামেই ডাকা হয়) অবদান। অনুপনগর গ্রামের যুবক রিজাউল মোল্লার কথায়, ‘‘আমাদের পথ দেখালেন ছোটবাবু। আগে পুলিশকে খালি তাড়া করতে আর রাস্তায় লরি থেকে টাকা আদায় করতে দেখেছি। এখন ছোটবাবু আমাদের বিভিন্ন পরীক্ষায় বসাতে কোচিংয়ের ব্যবস্থা করেছেন।’’ ওই গ্রামেরই মহম্মদ আমিন মল্লিক ওই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে উপকৃত হয়ে পুলিশে চাকরির প্রাথমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। রামানন্দপুর গ্রামের প্রৌঢ় সামসুল হকের কথায়, ‘‘গ্রামের ছেলেমেয়েগুলোকে মানুষ করতে ছোটবাবুর দরদ দেখার মতো। আগের মতো গ্রামগত বা পারিবারিক জমি-ভিটে নিয়ে মারপিট করতেও মন সায় দেয় না। কোথাও কোনও অপরাধের সম্ভাবনা দেখলে আমরাই তাঁকে আগাম খবর দিই। তিনি বা তাঁর লোক পৌঁছে গিয়ে সমস্যা মেটানোর চেষ্টা করেন।”

পুলিশের খাতায়, পশ্চিম মেদিনীপুরের সীমানাবর্তী গোঘাটের বহড়াশোল, সুন্দরপুর, বাবুরামপুর, অনুপনগর, বদনগঞ্জ, কয়াপট, শ্যামবাজার, তিলাড়ির মতো অন্তত ২০টি গ্রাম ‘অপরাধপ্রবণ’ বলে বরাবর চিহ্নিত। পুলিশের হিসেব বলছে, গত বছর নভেম্বর পর্যন্ত ওই সব এলাকা থেকে মাসে গড়ে চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, লুটপাটের ৬-৭টি মামলা হতো। সাধারণ ডায়েরি হতো অন্তত ২০টি। ডিসেম্বরের ১ তারিখে মগরা থানা থেকে গোঘাটের বদনগঞ্জ বিট হাউসে যোগ দেন বাপি। তারপরেই পুলিশের খাতার হিসেব পাল্টায়। এ পর্যন্ত গত পাঁচ মাসে ওই সব এলাকা থেকে প্রতি মাসে মামলা হয়েছে গড়ে ২টি, ডায়েরি ২-৩টি!

কী ভাবে সম্ভব?

‘‘অপরাধ ঠেকানোর পরিকল্পনা তৈরি করতে এলাকা পরিদর্শনে বেরিয়ে দেখি, গ্রামবাসীরা আলাপ করতে ভয় পাচ্ছেন। তার মধ্যেই দুই যুবক জানালেন, তাঁদের পুলিশে চাকরি করার ইচ্ছা। কিন্তু কী ভাবে প্রস্তুতি নেবেন, বুঝতে পারছেন না। ওই কথাতেই আমি রাস্তা পেলাম। আমার পুরনো পেশা জেগে উঠল”— বলছেন গ্রামবাসীদের ‘ছোটবাবু’।

২০১৪ সালে এসআই-এর চাকরি পান বাসন্তীর সোনাখালির বাসিন্দা, বছর চৌত্রিশের বাপি। তার আগে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে দীর্ঘদিন পড়িয়েছেন বাণিজ্যের (কমার্স) ওই স্নাতক। তাঁর কথায়, “ওখানে পড়ানোর সূত্রে দু’পাতার অঙ্ক কী করে নির্ধারিত ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে করতে হয়, সেই কৌশল শিখেছিলাম। সেই কৌশলই এখানে শেখাচ্ছি।”

তিলাড়ি গ্রামের দুই বেকার যুবককে নিয়ে সেখানকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেন বাপি। দিন চারেক ক্লাসের পরই ছাত্রসংখ্যা বাড়তে শুরু করে। তাঁদের মধ্যে পশ্চিম মেদিনীপুর এবং বাঁকুড়ার বাসিন্দারাও রয়েছেন। শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ায় এখন অবশ্য ক্লাস হয় সুন্দরপুর বিট হাউস এবং বদনগঞ্জ বিট হাউসে। সপ্তাহে তিন দিন। দেড় ঘণ্টা করে। তাঁর উদ্যোগে শামিল হয়েছেন বদনগঞ্জ হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক নির্মলেন্দু সিংহ এবং আরামবাগ বন দফতরের বিট অফিসার শুভঙ্কর সিকদার। বাপি শুধু বৃহস্পতিবার ক্লাস নেন।

ফলুই গ্রামের দুলেপাড়ায় চতুর্থ থেকে নবম শ্রেণির পড়ুয়াদের নিখরচায় পড়ানোরও ব্যবস্থা করেছেন বাপি। এখানে শিক্ষকের ভূমিকায় রয়েছেন গ্রামেরই শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা। স্কুলছুটদের খোঁজ এবং তাদের ভর্তির বিষয়টা দেখেন সহকর্মী সাব-ইন্সপেক্টর গোপীনাথ মুখোপাধ্যায়।

পুরো বিষয়টা নিয়ে হুগলি জেলা (গ্রামীণ) পুলিশ সুপার সুকেশকুমার জৈন বলেন, “আমরা জনসংযোগ বাড়াতে নানা ভাবে চেষ্টা করছি। এটা তারই অংশ। সফল হলে ভাল।”

প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যে হারে ভিড় বাড়ছে, তাতে বাপির উদ্যোগ সফল বলেই মানছেন গ্রামবাসী। কয়াপাট গ্রামের মাধ্যমিক পাশ পুষ্পেন দাসের দাবি, ‘‘আগে নিজের উপর কোনও আত্মবিশ্বাসই ছিল না। খারাপ হয়ে যাচ্ছিলাম। এখন বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষায় বসতে তৈরি হচ্ছি। পাশ করতে পারব বলে নিজের উপর আত্মবিশ্বাস বাড়ছে।”

একই কথা বলেছেন আরও অনেকে।

Police Educatiion Competetive Exam
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy