Advertisement
E-Paper

মিছিলে অভিযুক্ত বিক্রম, পুলিশ বলছে পলাতক

সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। ‘চুনোপুঁটি’রা হয়তো ধরা পড়ছে। ‘রাঘব বোয়াল’রা ঘুরে বেড়াচ্ছে অবাধেই! দুবরাজপুর, বোলপুর, আলিপুর, পাত্রসায়রে শাসক দলের নেতাকর্মীদের হাতে পুলিশ আক্রান্ত হওয়ার পরেও মূল অভিযুক্তদের ধরা হয়নি। পুলিশ ‘পলাতক’ বললেও তাঁদের প্রকাশ্যে দেখা গিয়েছে। এ বার চাঁপদানি-কাণ্ডেও পুলিশের গলায় সেই সুর!

গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৭ এপ্রিল ২০১৫ ০২:৫১
মিছিলে বিক্রম গুপ্ত। সোমবার চাঁপদানিতে তাপস ঘোষের তোলা ছবি।

মিছিলে বিক্রম গুপ্ত। সোমবার চাঁপদানিতে তাপস ঘোষের তোলা ছবি।

সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে।

‘চুনোপুঁটি’রা হয়তো ধরা পড়ছে। ‘রাঘব বোয়াল’রা ঘুরে বেড়াচ্ছে অবাধেই!

দুবরাজপুর, বোলপুর, আলিপুর, পাত্রসায়রে শাসক দলের নেতাকর্মীদের হাতে পুলিশ আক্রান্ত হওয়ার পরেও মূল অভিযুক্তদের ধরা হয়নি। পুলিশ ‘পলাতক’ বললেও তাঁদের প্রকাশ্যে দেখা গিয়েছে। এ বার চাঁপদানি-কাণ্ডেও পুলিশের গলায় সেই সুর! সোমবার বিকেলে শ’খানেক কর্মী-সমর্থককে নিয়ে নিজের এলাকাতেই মিছিল করলেন রবিবার চাঁপদানি পুলিশ ফাঁড়িতে হামলায় অন্যতম অভিযুক্ত বিক্রম গুপ্ত। অথচ চাঁপদানি পুরসভার তিন নম্বর ওয়ার্ডের এই তৃণমূল প্রার্থী নাকি ‘পলাতক’, এমনই দাবি দিনভর করে গেল হুগলি জেলা পুলিশ!

প্রকাশ্যে যাঁকে মিছিল করতে দেখা গেল, দু’দিনেও তাঁকে ধরতে না পারায় ফের পুলিশের ‘সদিচ্ছা’ নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন বিরোধীরা। কেউ কেউ মনে করছেন, অভিযুক্ত শাসক দলের হওয়াতেই বারবার পার পেয়ে যাচ্ছে। জেলা তৃণমূলের একটি সূত্রেরও দাবি, বিক্রমবাবুকে ধরার জন্য রবিবার রাতেই রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষ স্তর থেকে নির্দেশ এসেছিল। কিন্তু দলের জেলা স্তরের কিছু নেতা মনে করেন, এখন বিক্রমবাবুকে ধরা হলে পুরভোটে খারাপ প্রভাব পড়বে। তিন নম্বর ওয়ার্ডটি তাঁদের হাতছাড়াও হতে পারে। এটাই পুলিশকে বলা হয়েছে।

পুলিশ অবশ্য এমন কোনও নির্দেশের কথা মানেনি। জেলা পুলিশের দাবি, বিক্রম ‘পলাতক’। তাঁর খোঁজে তল্লাশি চলছে। জেলা পুলিশের এক কর্তা বলেন, ‘‘কাকে কোথায় দেখা গিয়েছে, সেটা আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। নির্দিষ্ট পদ্ধতি মেনেই তদন্ত চলছে। ৪৪ জনের নামে মামলা হয়েছে। ১৪ জনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। বাকি অভিযুক্তদেরও ধরা হবে। তল্লাশি জারি রয়েছে।’’

এ নিয়ে তৃণমূলের মহাসচিব এবং রাজ্যের মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘পুলিশ কেন ধরতে পারেনি, পুলিশ বলতে পারবে! যে বা যারাই পুলিশের উপর আক্রমণ করেছে, একেবারেই ঠিক করেনি। দলের রং না দেখেই পুলিশকে কাজ করতে বলা হয়েছে।’’ পাশাপাশিই পার্থবাবু স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, চাঁপদানির ওই তৃণমূল নেতাও তো পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন!

রাস্তায় মোটরবাইক ‘চেকিং’-এর সময় যথাযথ কাগজপত্র দেখাতে না পারায় রবিবার বিক্রমবাবুর পরিচিত এক মোটরবাইক আরোহীকে ধরে চাঁপদানি ফাঁড়িতে নিয়ে গিয়েছিল পুলিশ। অভিযোগ, সেই যুবকের ফোন পেয়েই থানায় সদলবলে চড়াও হয়ে বিক্রম ভাঙচুর চালান এবং পুলিশকর্মীদের মারধর করেন। ভদ্রেশ্বর থানার ওসি অনুদ্যুতি মজুমদার-সহ জখম হন ৯ পুলিশকর্মী। ওই রাতেই তল্লাশি চালিয়ে দু’দফায় পুলিশ ১৪ জনকে গ্রেফতার করে। প্রত্যেকেই এলাকায় তৃণমূল সমর্থক হিসেবে পরিচিত। খুনের উদ্দেশ্যে আক্রমণ, সরকারি সম্পত্তি ভাঙচুর-সহ ১০টি ধারায় পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করেছে। সোমবার ধৃতদের চন্দননগর আদালতে হাজির করানো হয়। পুলিশ তাদের নিজেদের হেফাজতে চেয়ে আবেদন করেনি। বিচারক ধৃতদের ১৪ দিন জেল হাজতে রাখার নির্দেশ দেন। পুলিশের এই পদক্ষেপেরও সমালোচনা করেন বিরোধীরা। ওই পুলিশকর্তা অবশ্য দাবি করেন, জেলে গিয়েও তদন্তের স্বার্থে ধৃতদের জেরা করা যায়।

এ দিন ধৃতদের যখন আদালতে হাজির করানো হয়, তার কিছু ক্ষণের মধ্যেই চাঁপদানির তিন নম্বর ওয়ার্ডের এ সি এম রোডে কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে মিছিল করতে দেখা যায় বছর বিয়াল্লিশের বিক্রমবাবুকে। ওই এলাকাতেই তাঁর বাড়ি। বেশ কিছু সাধারণ মানুষও তাঁর সঙ্গে হাত মেলাতে এগিয়ে আসেন। আগের দিন পুলিশের উপরে হামলায় তিনি কোনও ভাবে জড়িত নন বলে দাবি করেন পরপর দু’দফার কাউন্সিলর (প্রথমবার অবশ্য নির্দল হিসেবে) বিক্রমবাবু। তিনি বলেন, ‘‘আমরা কেন পুলিশকে মারব? শাসক দলের লোক হিসেবে এতে তো আমাদেরই বদনাম! সমস্যা মেটাতে জিতেন্দ্রপ্রসাদ সিংহই (সাসপেন্ডেড তৃণমূল নেতা) প্রথমে থানায় যায়। পরে আমি থানায় গিয়েছিলাম।’’

তা হলে ফাঁড়িতে কারা হামলা চালাল?

বিক্রমবাবুর দাবি, ‘‘ভিড়ের মধ্যে থেকে বিজেপির লোকজনই ওই গোলমাল করে। পুলিশ সামলাতে পারেনি। আমি তো দলের ছেলেদের এক ধারে শান্ত ভাবে দাঁড় করিয়ে রেখে দিয়েছিলাম।’’ একই সঙ্গে পুলিশের বিরুদ্ধে তাঁকে মারধরের পাল্টা অভিযোগও তুলেছেন বিক্রমবাবু। জামা তুলে পিঠের কিছু দাগ এবং হাতের কালশিটে দেখিয়ে তিনি দাবি করেন, পুলিশের লাঠির ঘায়েই তাঁর ওই অবস্থা হয়েছে। বিক্রমবাবুর মা, এক সময়ের সিপিআই কাউন্সিলর শকুন্তলাদেবীর অভিযোগ, ‘‘পুলিশ তল্লাশির নামে বাড়িতে এসে ভাঙচুর চালিয়েছে। পুলিশের ভয়ে ছেলে বাড়িতে থাকতে পারছে না।’’ কিছু সাধারণ বাসিন্দাও মনে করেন, হামলায় বিক্রমবাবু জড়িত নন। ফাঁড়ির ইনচার্জ জয়ন্ত পালের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে হামলাকে ‘জনরোষের জের’ বলেই দাবি করেছেন তাঁরা।

পুলিশ অবশ্য বিক্রমবাবুকে মারধরের অভিযোগ মানেনি। চাঁপদানি ফাঁড়িটি যে থানার আওতায়, সেই ভদ্রেশ্বর থানার পুলিশের দাবি, রবিবার কয়েকশো হামলাকারী যে ভাবে চড়াও হয়েছিল, তাতে অল্প সংখ্যক পুলিশের কিছু করার ছিল না। বিক্রমবাবুকে এলাকার লোকজন ‘ক্লিনচিট’ দিলেও পুলিশের দাবি, তাঁর ভাবমূর্তি আদৌ স্বচ্ছ নয়। তাঁর বিরুদ্ধে এর আগে ২০০২ এবং ২০০৮ সালে বেআইনি ভাবে আগ্নেয়াস্ত্র রাখার মামলা হয়েছে। দু’টি মামলাতেই তিনি জামিনে রয়েছেন।

সব জেনেও পুলিশ বিক্রমবাবুকে না ধরায় কেউ কেউ মনে করছেন চাঁপদানি-কাণ্ডের পরিণতিও বোলপুর, আলিপুর বা পাত্রসায়রের মতোই হবে। পার পেয়ে যাবেন মূল অভিযুক্তেরা। বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু বলেন, ‘‘শাসক দল রাজ্যে নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে গিয়ে পুলিশকেও রেহাই দিচ্ছে না। চাঁপদানির ঘটনা তারই প্রমাণ। একাধিক বার পুলিশের উপর হামলা হয়েছে। কিন্তু কোনও ক্ষেত্রেই অপরাধীদের শাস্তি হয়নি। কারণ তারা শাসক দলের লোক।’’

চাঁপদানির প্রাক্তন কংগ্রেস বিধায়ক আব্দুল মান্নানের বক্তব্য, ‘‘পুলিশ যে ভাবে কাজ করছে, তার জন্যই তাদের প্রতি মানুষের সহানুভূতি কমে যাচ্ছে। আজ ওসি মার খাচ্ছেন। কাল এসপি-র গায়ে হাত উঠবে। অপরাধীরা ছাড় পেয়ে গেলে ভয়ঙ্কর দিন আসবে।’’ বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ বলেন, ‘‘পুলিশকে যারা পেটাল, তাদের জেল-হাজতে রাখা হল! অভিযুক্ত প্রকাশ্যে ঘুরছেন। অথচ বলা হচ্ছে, তিনি ফেরার! এখান থেকেই বোঝা যায়, এ রাজ্যে আইন নিয়ে ছেলেখেলা হচ্ছে। পুলিশকে যারা মারছে, পুলিশ তাদেরই পক্ষ নিতে বাধ্য হচ্ছে!’’

Vikram Gupta Chapdani police out post Party rally congress Abdul Mannan police
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy