পুরনো চেহারায় চন্দননগর কলেজের জীর্ণ ‘হেরিটেজ ভবন’কে ফেরানোর কাজে হাত দিয়েছে পূর্ত দফতর। ইতিমধ্যেই ভবনের ছাদের অংশ ভেঙে ফেলা হয়েছে। কিন্তু কাজের ধরন এবং মান নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন শহরবাসীর একাংশই। অবিকল পুরনো চেহারা আদৌ ফিরবে কিনা সেই সংশয়ও প্রকাশ করছেন অনেকে। কিন্তু এই সংশয় বা কাজের গুণমান নিয়ে প্রশ্ন অমূলক বলে দাবি করেছেন কলেজ কর্তৃপক্ষ এবং পূর্ত দফতর।
গঙ্গার ধারে এই প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয় ১৮৬২ সালে। এই শহরে তখন ফরাসিদের উপনিবেশ। আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষকরা জানান, সাত বার নাম পরিবর্তিত হয়ে ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠানটির নাম হয় চন্দননগর কলেজ। রাজ্যের হেরিটেজ কমিশন কলেজের সেই সময়ের ভবনটিকে ‘হেরিটেজ’ ঘোষণা করে। কলেজ সূত্রের খবর, ভবনটির ভেঙে পড়ার অবস্থা হয়েছিল। ছাদ দিয়ে বৃষ্টির জল পড়ছিল। পলেস্তারা খসে পড়ছিল। পূর্ণাঙ্গ সংস্কার জরুরি হয়ে পড়ায় কলেজ কর্তৃপক্ষ ২০১৭ সালে রাজ্য সরকারের কাছে আবেদন জানান। পূর্ত দফতরের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ প্রকল্পটি অনুমোদন করে। প্রায় ২ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়। গত মাসের শেষ দিকে পুনঃসংস্থাপনের কাজ শুরু হয়।
কিন্তু পূর্ত দফতরের হাতে ঐতিহ্যশালী ওই ভবন সংস্কারের কাজ যাওয়ায় ক্ষুব্ধ ‘চন্দননগর হেরিটেজ’-এর সম্পাদক কল্যাণ চক্রবর্তী। তিনি বলেন, ‘‘সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক ভাবে ওই কাজ হচ্ছে। প্রাচীন স্থাপত্য সংরক্ষণের জ্ঞান সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারদের নেই। অতীতেও নানা ক্ষেত্রে তা প্রমাণিত।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘এর আগে শহরের ঐতিহ্যশালী লিবার্টি গেট, চাঁদনি ঘাট সম্পূর্ণ ধূলিসাৎ করে নতুন ভাবে গড়া হয়েছে। কলেজের ক্ষেত্রেও তার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। তাজমহল সংস্কার করতে হলে কি ওই স্থাপত্য ভেঙে গুঁড়িয়ে নতুন করে তৈরি করা হবে? এটাই আধুনিক সংস্কার-বিজ্ঞান? এমন অনৈতিক কাজে চন্দননগরের মানুষ স্তম্ভিত এবং দুঃখিত।’’ কল্যাণবাবুর মতে, প্রয়োজনে ফরাসি সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের প্রযুক্তিগত পরামর্শ অথবা এ রাজ্যের স্থপতিদের সঙ্গেও কথা বলা যেত।
চন্দননগরের বাসিন্দা, স্থপতি রঞ্জন চট্টোপাধ্যায় কেএমডিএ-র প্রাক্তন ডিরেক্টর জেনারেল (প্ল্যানিং)। বর্তমানে তিনি স্থাপত্য বিষয়ক একটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক। তিনিও মনে করেন, ‘‘পুনঃসংস্থাপন বিশেষজ্ঞের তদারকিতে কাজ হলে ভাল হতো। যাঁরা এই কাজ করছেন তাঁরা বিশেষজ্ঞ কিনা, সন্দেহ আছে।’’ রঞ্জনবাবু বলেন, ‘‘ছবিতে এবং বাইরে থেকে মনে হয়েছে ওই ভবনের অন্তত ৭০% ভেঙে ফেলা হয়েছে। ভবনের কাঠামো পরখ না করলেও আমি মনে করি এতটা অংশ ভেঙে ফেলার দরকার ছিল না।’’ ওই কলেজের প্রাক্তন ছাত্র ও শিক্ষক তপনকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ও বলেন, ‘‘ভবনটা ভাঙা হচ্ছে শুনে দেখতে গিয়েছিলাম। সত্যিই এতটা ভেঙে ফেলার দরকার ছিল? অবিকল পুরনো চেহারা ফিরবে কিনা সন্দেহ আছে।’’
কী বলছেন কলেজ কর্তৃপক্ষ এবং পূর্ত দফতর?
অধ্যক্ষ দেবাশিস সরকার বলেন, ‘‘রাজ্যে এ ধরনের সরকারি ভবন পূর্ত দফতরেরই সংস্কারের কথা। রীতি মেনেই সব হচ্ছে। জীর্ণ ছাদ রাখা যায়নি বলেই ভাঙা হয়েছে। দেওয়াল বা থাম ভাঙা হয়নি। মূল কাঠামো যাতে একটুও না-পাল্টায় সে ভাবেই কাজ হচ্ছে। ছ’মাসের মধ্যেই শেষ হবে আশা করছি। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে সেই সময়কার ভবনই অবিকল ফিরিয়ে আনা হবে। এর আগে মাঝেমধ্যে সংস্কারকাজে কাঠের রেলিং বা গ্রিল বদলে ফেলে কংক্রিটের করা হয়েছিল। আমরা ওই জায়গায় নির্দিষ্ট জিনিসই বসাচ্ছি। ছাদের একটা অংশ আগেই ভাঙা হয়েছিল। তখন তো প্রশ্ন ওঠেনি!’’
হুগলি পূর্ত দফতরের (সোশ্যাল সেক্টর) এগ্জিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার দেবব্রত সরকার বলেন, ‘‘প্রযুক্তি-বিশেষজ্ঞরাই ওই কাজ করছেন। গোটা রাজ্যে এই ধরনের ভবনের কাজ পূর্ত দফতরই করে। ছাদটা খুবই জীর্ণ হয়ে পড়ায় ভাঙতে হয়েছে। কাজ শেষ হলে সবাই দেখবেন, আগে যেমন ছিল, তেমন অবস্থাই ফিরে এসেছে।’’
এখন দেখার, সংস্কার কাজের পরে কী চেহারায় ফেরে কলেজের ‘হেরিটেজ ভবন’।