আক্রান্ত: জখম টোটো-চালক। নিজস্ব চিত্র
হাওড়া রয়েছে হাওড়াতেই!
কিছু দিন আগেই হাওড়া থানা এলাকার শ্রীবাস দত্ত লেনে চোর সন্দেহে বাপি প্রসাদ নামে মানসিক ভারসাম্যহীন এক যুবককে বাতিস্তম্ভে বেঁধে লাঠি আর বাঁশ দিয়ে পিটিয়েছিলেন তাঁরই পাড়ার লোকজন। এ বার চোর সন্দেহে গণপিটুনি দেওয়া হল এক টোটো চালককে। লোহার রড, স্টিল পাঞ্চার ও হকি স্টিক দিয়ে বেধড়ক মারা হল তাঁকে। শুধু তা-ই নয়, তাঁর চোখে ঘষে দেওয়া হল লঙ্কাগুঁড়ো। ছুরিও মারার চেষ্টা হল পেটে।
বুধবার রাতে ভয়াবহ এই ঘটনা ঘটেছে হাওড়ার সাঁতরাগাছি এলাকার দক্ষিণ বাকসাড়ার শিবতলায়। হাওড়া শহরে এক মাসে দু’টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটায় এ বার পুলিশের নজরদারি নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। শ্রীবাস দত্ত লেনের ঘটনার পরে এক মাস কেটে গেলেও পুলিশ কাউকে ধরতে পারল না কেন? কেনই বা গণপিটুনির খবর সময়মতো পুলিশের কাছে পৌঁছচ্ছে না? অপরাধীরাই বা রেহাই পেয়ে যাচ্ছে কী ভাবে?
পুলিশ জানিয়েছে, আক্রান্ত টোটো চালকের নাম ফিরোজউদ্দিন মোল্লা। বছর আঠেরোর ওই তরুণের বাড়ি স্থানীয় তিন নম্বর সুলতানপুর হাজিবাড়িতে। সেখানে টালির চালের ঘরে বাবা, দুই ভাই আর চার বোনের সংসার। বাবা নবাবউদ্দিন মোল্লা পেশায় দর্জি। ফিরোজউদ্দিন এক জনের কাছ থেকে ভাড়ায় টোটো নিয়ে চালাতেন। পুলিশ জানায়, টোটো মালিকের বাড়ি দক্ষিণ বাকসাড়ার শিবতলার কাছে। রোজই শিবতলার মাঠে টোটো রেখে সুলতানপুরের বাড়িতে
ফিরতেন ফিরোজউদ্দিন।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বুধবার রাত আটটা নাগাদ শিবতলার মাঠে টোটো রাখতে গিয়েছিলেন ফিরোজউদ্দিন। ওই সময়ে মহিলা-পুরুষ মিলিয়ে ৮০-৯০ জন ‘চোর’ ‘চোর’ বলে চিৎকার করতে করতে কাউকে তাড়া করছিলেন। রাস্তার ধারে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা ফিরোজউদ্দিনকে দেখতে পেয়ে তাঁকেই হঠাৎ চোর ভেবে বসেন সকলে। তার পরেই শুরু হয় বেধড়ক মার। প্রথমে পিছন থেকে কেউ এক জন সজোরে রড দিয়ে আঘাত করতেই মাটিতে পড়ে যান ফিরোজউদ্দিন। মাথা ফেটে গলগল করে রক্ত বেরোতে থাকে। সেই অবস্থাতেই তাঁকে রাস্তায় ফেলে শুরু হয় হকি স্টিক ও লাঠি দিয়ে বেপরোয়া মারধর। এক জন ওই যুবকের চোখে লঙ্কা গুঁড়ো ঠেসে ধরেন। শুধু তা-ই নয়। অভিযোগ, ওই অবস্থায় তাঁকে তুলে ধরে মুখে স্টিল পাঞ্চার দিয়ে পরপর ঘুসি মারা হয়। একটা ঘুসি লাগে বাঁ দিকের চোখে। কিছু ক্ষণের মধ্যে চারপাশে রক্ত জমাট বেঁধে চোখ ফুলে যায়। জনতার হাত থেকে ওই যুবককে বাঁচাতে এগিয়ে আসেন এলাকার একটি ক্লাবের বর্ষীয়ান সদস্যেরা। কোনও রকমে ওই যুবককে উদ্ধার করে ক্লাবে নিয়ে আসেন তাঁরা। এর মধ্যে পুলিশ চলে আসায় ওই যুবককে তাদের হাতে তুলে দেন ক্লাবের সদস্যরা। পুলিশ গুরুতর আহত ওই যুবককে হাওড়া জেলা হাসপাতালে ভর্তি করে।
বৃহস্পতিবার সকালে হাসপাতালে শুয়ে ফিরোজউদ্দিন বলেন, ‘‘টোটোর চাবি দেখিয়ে বারবার ওদের বলছিলাম, আমি টোটো চালক। গাড়ি রাখতে এসেছিলাম। কিন্তু কেউ শোনেনি।’’ হাসপাতালে ছেলেকে দেখতে এসেছিলেন নবাবউদ্দিন মোল্লা। তিনি বলেন, ‘‘আমি পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছি। নিজের পরিচয় দেওয়া সত্ত্বেও ওকে যারা এ ভাবে মেরেছে, তাদের আমরা
ছাড়ব না।’’
পুলিশ সূত্রের খবর, গোটা দক্ষিণ বাকসাড়া এলাকায় সম্প্রতি ছিঁচকে চোরের উপদ্রব বেড়ে যাওয়ায় এলাকার মানুষ অতিষ্ঠ। এলাকার বাসিন্দা লক্ষ্মী দাস বলেন, ‘‘বেশ কিছু দিন ধরেই আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছি। সন্ধ্যা হলেই দরজা বন্ধ করে বসে থাকছি।’’
যে ক্লাবের সদস্যেরা ওই যুবককে বাঁচান, তার কোষাধ্যক্ষ কিশোর রায় বলেন, ‘‘যা ঘটেছে, তা গর্হিত কাজ। এ ভাবে কাউকে মারধর করা যায় নাকি? আমরা ওকে উদ্ধার করে ক্লাবে নিয়ে না এলে হয়তো মেরেই ফেলত।’’
হাওড়ার পুলিশ কমিশনার তন্ময় রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘চোর সন্দেহে কেন এ ভাবে ওই যুবককে মারা হল, তা আমরা তদন্ত করে দেখছি। মারধরের মামলা রুজু হয়েছে। অপরাধীদের গ্রেফতার করা হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy