পোলবায় দুর্ঘটনাগ্রস্ত পুল কার। —ফাইল চিত্র।
চার দিন পর পিসির বিয়ে। শ্রীরামপুরের ধোবিঘাটের বাড়িতে তখন উৎসব শুরু হয়ে গিয়েছিল। শুক্রবার সাতসকালে উৎসবের আনন্দ বদলে গেল উদ্বেগে। পুলকার উল্টে সঙ্কটজনক অবস্থায় হাসপাতালে তখন জীবনের সঙ্গে পরিবারের খুদে সদস্য ঋষভ সিংহ।
রোজকার মতোই এ দিন পুলকারে চেপে স্কুলে যাচ্ছিল সাত বছরের ঋষভ। অভিযোগ, পোলবার কামদেবপুরে দ্রুতগতিতে একটি গাড়িকে পাশ কাটাতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পুলকার উল্টেই বিপত্তি। পুলকারের ১৬ জন পড়ুয়াই জখম হয়। তাদের চুঁচুড়া ইমামবাড়া হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে দ্বিতীয় শ্রেণির ঋষভ এবং দিব্যাংশু ভগত নামে বৈদ্যবাটীর বাসিন্দা এক শিশুকে কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালের ট্রমা কেয়ার সেন্টারে পাঠানো হয় ‘গ্রিন করিডর’ করে।
ঋষভের বাবা সন্তোষ সিংহ ওরফে পাপ্পু শ্রীরামপুর পুরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর। হাসপাতালে বসে তিনি ক্রমাগত কেঁদে গিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘পুলকার তো ছেলেটাকে আমাদের সামনেই নিয়ে গেল। তারপরই বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো এই খবর।’’
কিন্তু কেন এই পরিণতি হল শিশুদের? এই নিয়ে আলোচনায় আসছে ‘বেনিয়মের পুলকার’ নিয়ে পুরনো নানা অভিযোগ।
অভিভাবকদের অনেকেরই বক্তব্য, ঠাসাঠাসি করে বাচ্চাদের তুলে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে থাকে পুলকার। দেরি হয়ে গেলে সেই খামতি ঢাকতে বেপরোয়া গতিতে চলে। তার জেরে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। এ দিন ঘটনায় তারই খেসারত শিশুদের দিতে হল বলে অভিযোগ। পুলকার-চালক নিজেও জখম হয়ে হাসপাতালে ভর্তি।
পুলকারের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ, বহু ক্ষেত্রেই তারা নিয়ম না মেনে রাস্তায় নামে। টায়ার যাতায়াতের উপযুক্ত থাকে না। অন্য ট্রাফিক বিধিও মানা হয় না। এ দিনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, গাড়িটি অত্যাধিক গতিতে চলছিল। ঘটনাস্থলে এসে আইজি (ট্রাফিক) তন্ময় রায়চৌধুরী, হুগলি জেলা (গ্রামীণ) পুলিশ সুপার তথাগত বসু— সকলেই সেটা মেনেও নিয়েছেন।
দিব্যাংশুদের স্কুলের অনেক সহপাঠীর অভিভাবকই জানান, এই ঘটনায় পুলকারে ছেলেমেয়েকে পাঠানো নিয়ে তাঁদের চিন্তা বাড়ল। ভদ্রেশ্বর গভর্নমেন্ট কলোনির বাসিন্দা তপন সাহার কথায়, ‘‘মেয়েকে পুলকারে পাঠাই। আজ যা ঘটল, শিউরে উঠছি।’’ স্কুলের অধ্যক্ষা প্রদীপ্তা চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘যে সব অভিভাবকরা নিজেদের ঠিক করা পুলকারে বাচ্চাদের স্কুলে পাঠান, তাঁদের সঙ্গে এই ব্যাপারে আমরা কথা বলব।’’ ইমামবাড়া হাসপাতালে এসে পুলকার নিয়ে প্রশাসনের নজরদারি বাড়ানোর দাবি তুলেছেন স্থানীয় বিজেপি সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায়ও।
এ দিন কামদেবপুরে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, পুলকারটি নয়ানজুলিতে উল্টে রয়েছে। গাড়িটির চাকা উপরের দিকে। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, এমনিতেই দিল্লি রোডে দ্রুতগতিতে গাড়ি চলত। রাস্তাটি সম্প্রসারিত হওয়ার পরে সেই গতি মাত্রা ছাড়াচ্ছে। পুলিশের নজরদারি থাকে না। সাধারণ মানুষের বক্তব্য, পুলকার এবং সার্বিক ভাবে গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশের খামতি রয়েছে। স্থানীয় এক যুবকের কথায়, ‘‘সারা বছর পুলিশ চোখ বন্ধ করে থাকে। এখন ঘটনাটি বড় আকার নেওয়ায় কর্তাব্যক্তিরা ছুটে আসছেন।’’ স্থানীয় বাসিন্দা অমর দাসের বক্তব্য, ‘‘দিল্লি রোড গুরুত্বপূর্ণ সড়ক। সেই তুলনায় পুলিশি নজরদারি কোথায়? রাস্তার কাজের জন্য রাস্তার একদিক বন্ধ। পুলিশি নজরদারি বাড়ানো দরকার ছিল।’’
এ দিন আইজি (ট্রাফিক), এসপি বাদেও জেলার আঞ্চলিক পরিবহণ অধিকর্তা (আরটিও) সোমনাথ চক্রবর্তী-সহ ওই দফতরের অন্য আধিকারিকরা ঘটনাস্থলে যান। যান নিয়ন্ত্রণ নিয়ে জেলার পুলিশ আধিকারিকদের পরামর্শ দেন আইজি। এসপি জানান, ঘটনাস্থলে ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞরা আসবেন। আরটিও বলেন, ‘‘পুলকারটি রাস্তায় চলার উপযুক্ত ছিল কি না, তা পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। কোনও গাফিলতি থাকলে গাড়ির মালিকের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’ তন্ময়বাবুর বক্তব্য, এই রাজ্যে দুর্ঘটনা আগের তুলনায় অনেক কমেছে। তা যাতে আরও কমানো যায়, সেই চেষ্টা চলছে। তাঁর কথায়, ‘‘দুর্ঘটনাহীন যান চলাচলের জন্য নানা পরিকল্পনা করা হয়েছে।’’ আরটিও সোমনাথবাবুর দাবি, ‘‘আমাদের দফতরের তরফে পুলকার নিয়ে রুটিনমাফিক অভিযান চালানো হয়।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy