অকেজো নলকুপে মেলে না জল।
একেবারে লাগোয়া চলে গিয়েছে ঝাঁ চকচকে ছয় লেনের মুম্বই রোড। পুরো রাস্তায় ঝলমলে আলো। তবে জাতীয় সড়কের গা ঘেঁষা হলেও উলুবেড়িয়ার বাণীতবলায় অবশ্য অন্য ছবি। উন্নয়নের আলোর ছিটফোঁটাও নেই সেখানে।
গত দেশ মাস ধরে অবশ্য প্রচারের আলোয় রয়েছে এই এলাকা। গত ১৬ নভেম্বর এলাকার বাসিন্দা কোরপান শাহকে কলকাতার এনআরএস হাসপাতালের ছাত্রাবাসে পিটিয়ে মারা হয়েছে। সেই ঘটনায় রাজ্য জুড়ে হইচই শুরু হয়েছে। বিশিষ্টজন ও সংবাদমাধ্যমের আনাগোনায় প্রচার পেয়েছে বাণীতবলা। কিন্তু হতদরিদ্র কোরপানের মতোও হতদরিদ্র এই এলাকার পরিবেশের তাতে কতটা উন্নতি হবে সেই প্রশ্ন বাসিন্দাদের।
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য প্রতিবন্ধী সম্মিলনীর রাজ্য সম্পাদক কান্তি গঙ্গোপাধ্যায় গত সোমবার ঘুরে গিয়েছেন কোরপানের বাড়িতে। ঘরের পাশেই কুলগাছের নীচে বসার ব্যবস্থা হয়েছিল তাঁর। সেখানে বসেই কথা বলেছেন কোরপানের স্ত্রী আরজিনা বিবির সঙ্গে। কথাবার্তার সময় মাছির উপদ্রবে কালঘাম ছুটে গিয়েছিল কান্তিবাবু এবং তাঁর সতীর্থদের। এক সময় এ নিয়ে নিজের বিরক্তিও প্রকাশ করেন তিনি। প্রায় চল্লিশ বছর ধরে এখানে বসবাস করছেন অন্তত সত্তরটি পরিবার। বাসিন্দাদের বক্তব্য, একদিন এসেই যদি বিশিষ্ট মানুষজনের এমন অবস্থা হয় তা হলে যাঁরা বছরভর এখানে থাকেন তাঁদের অবস্থাটি ঠিক কী? এলাকায় ঘুরে যা দেখা গেল, এক কথায় জাতীয় সড়ক লাগোয়া এই এলাকা কার্যত বসবাসের অযোগ্য।
মুম্বই রোডের উত্তর দিক থেকে এক চিলতে রাস্তা বেরিয়ে গিয়েছে শাহপাড়ার বুক চিরে। রাস্তার দু’পাশে কোথাও মাটির আবার কোথাও ইটের গাঁথনির খুপরি ঘর। কোনও কোনও ঘরের ঢালাই ছাদ থাকলেও বেশিরভাগেরই টালির ছাউনি। খুপরির মতো ঘরে ঠেসাঠেসি করে ছেলেপুলে নিয়ে বসবাস লোকজনের।
তবে নামেই রাস্তা। আসলে তা একটি খালের বাঁধ। নাম কাবলে বাঁধ। বাঁধের দু’পাশে সরকারি জমি দখল করে বহু বছর ধরেই বাস করছেন গরিব মানুষগুলি। কেউ দিনমজুর, কেউ জোগাড়ের কাজ করেন। তবে বেশিরভাগই যুক্ত জরির কাজের সঙ্গে। খুপরি ঘরগুলির ভিতরেই পাতা হয়েছে ঢাড্ডা। মহিলা-পুরুষ নির্বিশেষে শাড়ি, চুড়িদারের উপরে নিপুণ হাতে বুনে চলেছেন জরির নকশা। যার চাহিদা দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও।প্রতিটি নির্বাচনে এখানকার বাসিন্দারা ভোট দেন। ভোটের আগে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা এসে তাঁদের নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে যান। কিন্তু সরকারের কাছ থেকে তাঁরা কোনও সুবিধা পাননি বলে এলাকার বাসিন্দারা জানালেন।
কোনও একসময়ে রাস্তায় পিচ পড়েছিল। তবে তা কোনকালে কেউই বলতে পারলেন না। এখন আর পিচের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। কুমিরের পিঠের মত এবড়ো-খেবড়ো রাস্তায় কিছুটা পিচ, কিছুটা ইট আর বাকিটা মাটি। এখান দিয়ে যাতায়াত করতে হয় এলাকর মানুষকে। নেই সরকারি ট্যাপকল। ফলে পানীয় জলের জন্য ভরসা নলকূপ। দু’টি নলকূপের একটি আবার সব সময় বিকল হয়ে থাকে বলে অভিযোগ বাসিন্দাদের। একটি নলকূপে সমস্যা না মেটায় এলাকার মহিলাদের জল আনতে যেতে হয় মুম্বই রোডের ওপারে অন্য মহল্লায়।
বেশিরভাগ মানুষেরই ঘরে কোনও শৌচাগার নেই। পুরসভার পক্ষ থেকে ১২টা কমিউনিটি শৌচাগার করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেগুলো সাফাইয়ের ব্যবস্থা পুরসভার পক্ষ থেকে করা হয়নি। ফলে সেগুলিরও শোচনীয় দশা। কোনওটির কপাট ভাঙা, কোনওটি আবার জঞ্জালে ভরে আছে। বাসিন্দারাই জানালেন তাঁরা এগুলি ব্যবহার করেন না। তা হলে শৌচকর্ম করেন কোথায়? মহল্লার ঠিক পাশেই পুরসভার জঞ্জাল ফেলার জায়গা। অস্বাস্থ্যকর ওই জায়দাতেই বেশিরভাগ বাসিন্দা শৌচকর্ম সারেন।
দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারীদের জন্য ভর্তুকিতে বাড়ি তৈরি করে দেওয়ার পুর ও নগরোন্নয়ন দফতরের প্রকল্পের সুবিধা পেয়েছেন উলুবেড়িয়া পুরসভার বিভিন্ন এলাকার মানুষ। কিন্তু শাহপাড়ার মানুষের কাছে সেই সুযোগ অধরাই থেকে গিয়েছে। কারণ পুরসভা সূত্রের খবর, এই এলাকায় বিপিএল তালিকাভুক্ত মানুষজন নেই। বসতি এলাকার পাশে পুরসভার জঞ্জাল ফেলার জায়গাটি উন্মুক্ত। পাশেই পুকুর। জঞ্জাল জমে নেমে এসেছে পুকুরে। আবর্জনাময় দূষিত সেই পুকুরেই স্নান করেন অধিকাংশ বাসিন্দা। তাঁদের বক্তব্য, দু’টি নলকূপ ঠিক থাকলে এই সমস্যা হত না। কিন্তু একটি নলকূপ সব সময়েই বিগড়ে থাকায় বাধ্য হয়েই নোংরা পুকুরের জলে স্নান করতে হচ্ছে।
উলুবেড়িয়া পুরসভা বহুদিন ধরেই ছিল বামফ্রন্টের দখলে। ২০১০ সালে বামফ্রন্ট হেরে যাওয়ার পরে কয়েক মাসের জন্য কংগ্রেস পুরবোর্ড দখল করে। পরে বোর্ড চলে আসে তৃণমূলের দখলে। কংগ্রেস শাসিত বোর্ডের প্রাক্তন সভাপতি তথা বর্তমান পুরপিতা সাইদুর রহমানও দাবি করেন, “আমার আমলে ওই এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। ১২টি শৌচাগার আমিই করে দিয়েছি। তবে সেগুলি বাসিন্দারাই রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারেনি।” অন্যদিকে তৃণমূল নেতারা জানিয়েছেন, এলাকায় পানীয় জল সরবরাহ-সহ নানা পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। যদিও তিন দলের নেতারাই স্বীকার করেছেন এলাকায় আরও উন্নতির প্রয়োজন আছে।
সেই উন্নয়ন কবে হবে তার দিকেই তাকিয়ে বাণীতবলা।
ছবি: সুব্রত জানা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy