Advertisement
E-Paper

বাড়ির লোকের ফিরতে রাত হলেই ঘুম ছোটে পরিবারের

রাত ১১টা ৪৫। চুঁচুড়ার রবীন্দ্রনগর এলাকা। শীতের রাতে পথ সুনসান। কলকাতার একটি বেসরকারি সংস্থার কর্মী রণেন সেন (নাম পরিবর্তিত) ট্রেন থেকে নেমে মোটরবাইকে বাড়ি ফিরছিলেন। প্রায়ান্ধকার রাস্তায় আচমকাই মাটি ফুঁড়ে বাঁশ হাতে হাজির কয়েকজন যুবক। তাদের পিছনে এক যুবক, হাতে উঁচিয়ে পাইপগান। বাঁশ দিয়ে বাইক আটকে একজনের আদেশ, ‘হেলমেট খোল। সোয়টার খোল।’

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০১৪ ০২:০৩
শোকার্ত পরিবার।

শোকার্ত পরিবার।

রাত ১১টা ৪৫।

চুঁচুড়ার রবীন্দ্রনগর এলাকা। শীতের রাতে পথ সুনসান। কলকাতার একটি বেসরকারি সংস্থার কর্মী রণেন সেন (নাম পরিবর্তিত) ট্রেন থেকে নেমে মোটরবাইকে বাড়ি ফিরছিলেন। প্রায়ান্ধকার রাস্তায় আচমকাই মাটি ফুঁড়ে বাঁশ হাতে হাজির কয়েকজন যুবক। তাদের পিছনে এক যুবক, হাতে উঁচিয়ে পাইপগান। বাঁশ দিয়ে বাইক আটকে একজনের আদেশ, ‘হেলমেট খোল। সোয়টার খোল।’ এ বার যুবকেরা তাঁর চিবুকে হাত দিয়ে টর্চের আলোয় গলার কাছে কী যেন খুঁজতে লাগল। আতঙ্কে তখন রণেনবাবুর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। তল্লাশি পর্ব মিটতে যুবকেরা বলে উঠল, ‘কাটা দাগ নেই। যাকে খুঁজছিলাম, সে তুই নোস। সোজা ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যা। আর কোনও দিকে তাকাবি না’।

এরপর পড়ি কী মরি করে বাইক নিয়ে সোজা বাড়ির পথে রণেনবাবু। না, পুলিশের কাছে যাননি। কেন না, রোজ ওই পথেই অফিস থেকে মধ্যরাতে ফিরতে হয়। ঘটনার পর সতর্ক তিনি। বললেন, “আগের মতো মাঝরাতে আর এখন বাড়ি ফিরি না। অফিসে বলে ম্যানেজ করেছি। রুটটাও বদলে নিয়েছি। প্রায় এক কিলোমিটার ঘুরপথ হলেও ওই পথ আর মাড়াই না। জানের ভয় তো আছে।”

ভয় কেবল রণেনবাবুর নয়। বাসিন্দাদের অভিযোগ, গত বছর খানেকের মধ্যে চুঁচুড়ায় মূলত শহরকেন্দ্রিক এলাকায় দুষ্কৃতীদের তাণ্ডব লাগামছাড়া হয়ে গিয়েছে। মাঝেমধ্যে একটু থিতিয়ে গেলেও ফের যে কে সেই। এলাকায় সমাজবিরোধীদের দাপট যত বাড়ে, ততই প্রশ্নচিহ্নের মুখে পড়ে জেলার পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকা।

সম্প্রতি দিনের বেলা দ্বাদশ শ্রেণির এক ছাত্রকে গুলি করে খুন করার ঘটনা সেই প্রশ্নকে আরও তীব্র করেছে। কী করে লোকে হাতে অস্ত্র পাচ্ছে? কী করেই বা প্রায় প্রকাশ্যে যত্রতত্র তা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে? কেন কাজে যাওয়ার পথে গণধর্ষিতা হচ্ছেন হাসপাতালের মহিলা কর্মী?

অথচ পুলিশ সুপার, জেলাশাসক, পুলিশ লাইনের জেলা সদর চুঁচুড়ায়। জেলা জজের আবাসন এখানেই। চুঁচুড়া থানা, সিআই অফিস থেকে জেলা প্রশাসনের উচ্চ পদাধিকারীরাও সদরেই থাকেন। তবু দিন দিন জেলার আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতি যেন নিম্নগামী।

নাম প্রকাশ করা যাবে না এমন শর্তে মুখ খুললেন জেলা পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত এক কর্তা। তাঁর কথায়, এক সময় জেলা সদর চুঁচুড়া ও সংলগ্ন অঞ্চলের ডাকাবুকোদের নিয়ন্ত্রণ করতেন শহরের বাসিন্দা সিপিএমের এক প্রাক্তন সাংসদ। সিপিএমের ছত্রচ্ছায়ায় এই সব দুষ্কৃতীরা বেঁচেবর্তে ছিল। ওই সাংসদের বিশ্বস্ত এক অনুগামী পেশায় আইনজীবী ছোটখাটো সমস্যা দিব্যি সামলে নিতেন। সেই ভাবেই চলছিল বেশ। এলাকার দখলদারি, প্রোমোটারি, কন্ট্রাকটারি সবই শাসকদলের অধীনে ঠিকঠাক চলছিল। প্রাথমিকভাবে সরকার বদল হওয়ার পরও সবকিছু মোটের উপর নিয়ন্ত্রণে ছিল। কিন্তু শাসকদলের ক্ষমতার মুঠি এক বছরের মধ্যে একটু আলগা হতেই সমস্যার শুরু।

রবীন্দ্রনগর, পেয়ারাবাগান, চুঁচুড়া স্টেশন রোড, হুগলি স্টেশন রোড-সহ চুঁচুড়ার বিস্তীর্ণ এলাকা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে টোটন, মুন্না, সঞ্জীবের মতো সমাজবিরোধীরা। সিপিএম, ফরওয়ার্ড ব্লক বা বিজেপির মতো বিরোধী দলগুলির অভিযোগ, এই সব দুুষ্কৃতীদের মাথায় রয়েছে শাসক দলের নেতাদের হাত। এলাকার তৃণমূল বিধায়ক অসিত মজুমদার এবং সপ্তগ্রামের বিধায়ক তথা দলের জেলা সভাপতি তপন দাশগুপ্তের দিকেও দুষ্কৃতীদের মদত দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন বিরোধীরা। বেআইনি প্রোমোটারি, ঠিকাদারি, ব্যবসায়ীদের থেকে তোলাবাজি, পুকুর বোজানোসব কিছুই চলছে এঁদের অঙ্গুলিহেলনে। শহরে কোনও নির্মাণ করতে গেলে এঁদের আশ্রিত দুষ্কৃতীদের সাগরেদকেই নির্মাণসামগ্রী সরবরাহের বরাত দিতেই হবে। তাতে সন্তুষ্ট না হলে ‘নজরানা’ আদায় করতে পুলিশ-প্রশাসনের নাকের ডগায় এরা যে কোনও সময় অনর্থ ঘটিয়ে ফেলতে পারে। তাই অনেক সময়েই নিরীহ সাধারণ মানুষ থানায় যেতে সাহস করেন না। যেখানে প্রশসন বা পুলিশের কাছে অভিযোগ জমা পড়ছে, সেখানে উঁচুতলার নেতাদের অদৃশ্য হাত দুষ্কৃতীদের আড়াল করছে। ফলে জেলা সদরে পুলিশ-প্রশাসন কার্যত ঠুঁটো জগন্নাথের ভূমিকায় রয়েছেন বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ।


প্রতিবেশীকে মারধরের প্রতিবাদ করতে গিয়ে দুষ্কৃতীদের হাতে নিহত সুদেব দাস।

যদিও পুলিশ কর্তা থেকে নেতাসান্ত্রীরা সরাসরি এই অভিযোগ অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন। জেলার পুলিশ সুপার সুনীল চৌধুরী বলেন, “পুলিশ নিয়মিত তল্লাশি চালাচ্ছে। অস্ত্র উদ্ধার করেছে।”

সম্প্রতি রবীন্দ্রনগর এবং মগরা থেকে ১৬টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার হয়েছে বলে সাফাই দিয়েছেন পুলিশ সুপার। যদিও পুলিশ-প্রশাসনের একাংশই ঠারেঠোরে স্বীকার করছে, রাজনৈতিক চাপ রয়েছেই। পাশাপাশি নদিয়ার কুপার্স ক্যাম্প, উত্তর ২৪ পরগনার নোয়াপাড়া, জগদ্দল থেকে সমাজবিরোধীদের ‘সাপ্লাই লাইন’ চুঁচুড়া এবং হুগলির শহরকেন্দ্রিক এলাকায় নিরাপত্তা বিঘ্নিত করছে। পুলিশ সুপারদের সমন্বয় বৈঠকেও সে কথা উঠেছে। যদিও কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

অসিতবাবু বা তপন দাশগুপ্ত অবশ্য তাঁদের বিরুদ্ধে আনা যাবতীয় অভিযোগ মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁদের যুক্তি, “শহরে শান্তি এবং স্থিতি বিরাজ করছে। তবে এটা সত্যি যে, জনসংখ্যার চাপ বাড়ায় মাঝেমধ্যে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটছে।”

শুধু জেলের বাইরে থাকা দুষ্কৃতীরা নয়, এখন জেলে থাকা দুষ্কৃতীরাও মোবাইলে নিয়ন্ত্রণ করছে তাদের সাম্রাজ্য। যার রসায়ন, নেটওয়ার্ক রীতিমত তাৎপর্যপূর্ণ।

(চলবে)
--ফাইল চিত্র।

sudeb das chinsurah murder southbengal
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy