মেয়ো রোডের জনসভা। নিজস্ব চিত্র।
মঙ্গল সরেন। বাড়ি ঝাড়গ্রাম শহর থেকে কিছুটা দূরে পুকুরিয়া গ্রামে। প্রেস ক্লাবের সামনের রাস্তায় অমিত শাহের সভামুখী সমর্থকদের ভিড় থেকে একটু সরে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। সঙ্গীদের বোঝাচ্ছিলেন, কোন দিকে চিড়িয়াখানা।
মঙ্গল এর আগেও কলকাতায় এসেছেন। দিদি ক্ষমতায় আসার পরের বছরই। এখনও তাঁর মনে আছে। মঙ্গল বলেন, “সে বার ২১ জুলাই ভাল বৃষ্টি হয়েছিল। শুধু পুকুরিয়া থেকেই সে বার পাঁচখানা বাস এসেছিল। বিশাল একটা মাঠে দিদি সভা করেছিলেন।” মঙ্গলের কথা থেকেই বোঝা গেল, ব্রিগেডের কথা বলছেন তিনি।
তখন কি আপনি তৃণমূল কংগ্রেস করতেন? প্রশ্ন শুনে হেসে ফেললেন মঙ্গল। তিনি বলেন, ‘‘সেই সময় তো গোটা ঝাড়গ্রামই তৃণমূল ছিল। তা হলে সেই তৃণমূল ছেড়ে হঠাৎ বিজেপিতে কেন?
উত্তর দিতে একটু সময় নিলেন। তার পর তিনি বলেন, “দিদি হয়তো আমাদের জন্য সব কিছু ঠিকই দিচ্ছেন। কিন্তু এখানকার দাদারা তো ঠিক নেই।” স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের প্রতি তিনি তাঁর ক্ষোভ গোপন করেননি। বৃহস্পতিবারই ঝাড়গ্রামের সভায় জঙ্গলমহলের মানুষকে তাঁর উপর বিশ্বাস রাখতে অনুরোধ করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু তার পরেও মঙ্গল বা শালকু সরেনদের আস্থা যে ফেরেনি, তা মঙ্গলের কথাতেই স্পষ্ট। তিনি বলেন, “দিদি যাই বলুক, এখন আর এদেরকে বিশ্বাস করা যায় না।”
পঞ্চায়েত নির্বাচনে জঙ্গলমহলের বাসিন্দাদের একটা বড় অংশ তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতি অনাস্থা দেখিয়েছিলেন। সেই অনাস্থারই সুর শনিবার শোনা গেল জঙ্গল মহল থেকে অমিত শাহর সভায় আসা মানুষদের গলায়।
একই রকম ভাবে শাসক দলের প্রতি আস্থা হারিয়ে বিজেপির ঝান্ডা ধরে নদিয়ার তেহট্টের প্রত্যন্ত গ্রাম রানিনগর থেকে এ দিন কলকাতায় এসেছিলেন সঞ্জয় দাস। ২০১৩ পঞ্চায়েতেই তৃণমূলকে ভোট দিয়েছিলেন তিনি। তার আগে সিপিএমের ঝান্ডা নিয়ে ফি বছর কলকাতায় আসতেন। তাঁর আক্ষেপ, এত বছরেও তাঁদের গ্রামের রাস্তাটা বাম হোক বা তৃণমূল কেউ সারিয়ে দেয়নি। এ বার পঞ্চায়েত ভোটের আগে থেকে বিজেপি করা শুরু করেছেন তিনি। প্রেস ক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে সঞ্জয় বলেন, “সবাইকে তো দেখলাম। এ বার এদেরও দেখে নিই।”
উন্নয়নের প্রত্যাশায় অমিত শাহ-র সভায় সঞ্জয় দাস। নিজস্ব চিত্র।
বাঁকুড়ার শাসপুর থেকে এসেছেন নিতাই মাঝি এবং জয়দেব বাগদি। সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন মুড়ির ব্যাগও। বগলে করে সেই ব্যাগ নিয়েই সভার দিকে যাচ্ছিলেন তাঁরা। নিতাই বলেন, “এ বারে আমরা বিজেপিকেই ভোট দেব। সিপিএম, তৃণমূলকে এত দিন ভোট দিয়েছি। কোনও লাভ হয়নি।”
এই দেখে নেওয়ার ইচ্ছে থেকেই সকাল থেকেই বিজেপি সমর্থকদের একের পর এক মিছিল আসতে শুরু করে অমিত শাহর সভার দিকে। মেয়ো রোড-রেড রোডের সংযোগস্থল থেকে প্রেস ক্লাব পথ দিয়ে সমর্থকরা জওহরলাল নেহরু রোড ধরে পার্ক স্ট্রিট ফ্লাইওভারের তলা দিয়ে সভাস্থলে পৌঁছন।
মেদিনীপুরে প্রধানমন্দ্রীর সভার পরেই তৃণমূল অভিযোগ করেছিল, বিজেপি পড়শি ঝাড়খণ্ড থেকে লোক এনে প্রধানমন্ত্রীর সভা ভরিয়েছে। কিন্তু শনিবার দেখা গেল, বাবুঘাট হোক বা মেয়ো রোড, বিজেপি সমর্থকদের নিয়ে আসা একটি গাড়িও বাংলার বাইরের নয়। সবেতেই পশ্চিমবঙ্গের নম্বর প্লেট।
পশ্চিম বর্ধমানের জেলা সভাপতি লক্ষণ ঘড়ুইয়ের দাবি, ‘‘ভোর থেকে লোকজনকে আমরা বাসে করে স্টেশনে নিয়ে এসেছি। আমাদের দলের তরফে থেকে টার্গেট দেওয়া হয়েছিল জেলা থেকে ১৫ হাজার সমর্থক সমাবেশে নিয়ে যেতে হবে। সেখানে জামুরিয়া এবং বিভিন্ন এলাকায় তৃণমূলের সন্ত্রাস করেছে। তা সত্ত্বেও প্রায় ১৪ হাজার মানুষ এসেছেন।” পাশের জেলা পূর্ব বর্ধমান। জেলার সহ সভাপতি অনিল দত্তকে দেখা গেল প্রেস ক্লাবের সামনে নিজের জেলা থেকে আসা ভিড় সামলাতে। তাঁর দাবি, তাঁর জেলা থেকে এসেছেন প্রায় ১২ হাজার মানুষ। তিনি বলেন, শনিবারের সভা ভরিয়েছেন মূলত দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলি থেকে। উত্তরবঙ্গ থেকে আসা সমর্থক খুব কম। আর সেই জেলাওয়াড়ি হিসেবের ওপর ভিত্তি করে বিজেপি রাজ্য নেতৃত্বের দাবি, সর্বভারতীয় সভাপতির ডাকে এ দিন শহরে এসেছিলেন প্রায় তিন লাখ মানুষ।
যদিও কলকাতা পুলিশ বা কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের হিসেব, মেয়ো রোডে এক সঙ্গে ৬৫-৭০ হাজারের বেশি লোক ধরে না। সেই ভিড়ের সঙ্গে আশেপাশে, চিড়িয়াখানা বা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সব ভিড় এক করলেও তা সওয়া লাখ ছাড়াবে না। সংখ্যা যাই হোক না কেন, শাহের ভাষণের সময় মঞ্চের সামনে গোটা মেয়ো রোডে দৃষ্টিসীমার মধ্যে ছিল ঠাসা ভিড়। যা রাজ্য বিজেপি কর্তাদের মুখের হাসি চওড়া করেছে। আবার সেই ভিড় আশা জাগিয়েছে হাওড়ার কৌশিক বাগের মতো পুরনো বিজেপি সমর্থকদের মনে।
ভোরবেলাতেই বগলে ক্রাচ নিয়ে গ্রামের বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিলেন তিনি। ধর্মতলায় বাস থেকে নেমে পার্ক স্ট্রিট-এর দিকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতেও শুরু করেছিলেন। মানুষের ভিড়ে এগোতে না পেরে, শেষ পর্যন্ত রাস্তায় বসে পড়েন। অমিত শাহকে দেখতে না পাওয়ার আফসোস রয়েছে ঠিকই। কিন্তু বিজেপি সমর্থকদের জনস্রোত দেখে উচ্ছ্বসিত কৌশিক। তাঁর কথায়: “ভাঙা পা নিয়ে সভার কাছে যেতে পারলাম না ঠিকই। মাইকে নেতাদের ভাষণ শুনতে হল। তবে এত মানুষ দেখে ভালই লাগল। স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি এত সমর্থক সভায় যোগ দিতে আসবেন। পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূলের অত্যাচারে আমাদের গ্রামে কেউ ভোট দিতে পারেননি। এ দিনের ভিড় দেখে মনে হচ্ছে তৃণমূলের সময় শেষ হয়ে এসেছে।”
অমিত শাহকে দেখতে না পাওয়ায় হতাশ কৌশিক বাগ। নিজস্ব চিত্র।
একই সুর শোনা গেল বর্ধমান শহরের বাসিন্দা মনোজ মাহাত। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই, মনোজ তিনবার ‘জয় শ্রীরাম’ বলে নিলেন। তার পর বললেন, “যদি ঠিকঠাক ভোট হয় রাজ্য গেরুয়া ঝড় হবে দাদা। তৃণমূল হাওয়ায় উড়ে যাবে বুঝলেন। অমিত শাহ আসছে শুনেই এলাকা থেকে দল বেঁধে এসেছি কলকাতায়।”
আরও পড়ুন: বাংলায় সরকার গড়তে না পারলে বাকি সব মূল্যহীন: মমতাকে উৎখাতের ডাক শাহের
দেখুন ভিডিয়ো
মঞ্চে বিজেপি সর্বভারতীয় সভাপতি নাগরিকপঞ্জির প্রসঙ্গ তুলতেই গলা ফুলিয়ে স্লোগান দিতে শুরু করেন নদিয়া এবং মুর্শিদাবাদ থেকে আসা সমর্থকরা। পাশে শিঙা ফুঁকে ঢোল বাজিয়ে বাগদা থেকে আসা মতুয়া সম্প্রদায়ের সমর্থকরাও উচ্ছ্বাসে যোগ দেন। এঁদের এক জন মনোজিত সুত্রধর। মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুরে বাড়ি। তাঁর দাবি, “নাগরিক পঞ্জি শুরু করলে নাকি মুর্শিদাবাদের জনসংখ্যা অর্ধেক হয়ে যাবে।” একই অভিযোগ নদিয়ার অতনু সরকারের— “গেদের সীমান্তবর্তী এলাকায় ব্যাপক অনুপ্রবেশ হয়েছে।”
আরও পড়ুন: কলকাতায় দাঁড়িয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারকে উপড়ে ফেলার ডাক অমিতের
নির্বাচনে তৃণমূল উড়বে কী থাকবে সেটা ভবিষ্যৎ বলবে। কিন্তু শনিবারের সভা থেকে একটা ইঙ্গিত স্পষ্ট, অসমের মতো এ রাজ্যেও অদূর ভবিষ্যতে নাগরিক পঞ্জিকে থাকবে রাজনীতির ভর কেন্দ্রে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy