Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

‘অসুস্থ’ বাপি হাসপাতালে, বদলি আইসি

শ্লীলতাহানি এবং পুলিশ পেটানোয় দায়ে গ্রেফতার হয়েছিলেন। কোর্টের নির্দেশে জেল হাজতও হয়েছিল বাঁকুড়ার তৃণমূল কাউন্সিলরের স্বামী বাপি ওরফে পীযূষ চক্রবর্তীর। তবে আদালত চত্বর থেকে মঙ্গলবার বিকেলে বাঁকুড়া জেলে পৌঁছনোর ঘণ্টা কয়েকের মধ্যেই ‘খুব ঘাম হচ্ছে’ বলে বাঁকুড়া জেলের কয়েদি ওয়ার্ড থেকে তাঁর ঠিকানা বদলে গিয়েছে সম্মিলনী হাসপাতালের আইটিইউ ওয়ার্ডে।

বাঁকুড়া থানার সদ্য বদলি হওয়া আইসি বিশ্বজিৎ সাহা। —নিজস্ব চিত্র।

বাঁকুড়া থানার সদ্য বদলি হওয়া আইসি বিশ্বজিৎ সাহা। —নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
বাঁকুড়া শেষ আপডেট: ১১ জুন ২০১৫ ০২:৫৮
Share: Save:

শ্লীলতাহানি এবং পুলিশ পেটানোয় দায়ে গ্রেফতার হয়েছিলেন। কোর্টের নির্দেশে জেল হাজতও হয়েছিল বাঁকুড়ার তৃণমূল কাউন্সিলরের স্বামী বাপি ওরফে পীযূষ চক্রবর্তীর। তবে আদালত চত্বর থেকে মঙ্গলবার বিকেলে বাঁকুড়া জেলে পৌঁছনোর ঘণ্টা কয়েকের মধ্যেই ‘খুব ঘাম হচ্ছে’ বলে বাঁকুড়া জেলের কয়েদি ওয়ার্ড থেকে তাঁর ঠিকানা বদলে গিয়েছে সম্মিলনী হাসপাতালের আইটিইউ ওয়ার্ডে।

সেই সঙ্গে, মঙ্গলবার সকালেই বদলির নির্দেশও এসেছে বাঁকুড়া থানার আইসি বিশ্বজিৎ সাহার।

গোটা ঘটনা ঘিরে বুধবার সকাল থেকেই শুরু হয়েছে জল্পনা— বাঁকুড়ার জেলা সভাধিপতির ঘনিষ্ঠ অনুগামীকে গ্রেফতারের জন্যই কি কোপ পড়ল আইসি-র উপরে? বুধবার রাতে যে জল্পনা বাড়িয়েছে আরও এক পুলিশ অফিসারের বদলি। কলকাতার টালিগঞ্জ থানার ওসি সৌমেন ভট্টাচার্যকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ সিকিওরিটি কন্ট্রোল বিভাগে। মাত্র ক’দিন আগে এক ট্রাফিক কনস্টেবলকে নিগ্রহে অভিযুক্ত কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের ভাইঝিকে প্রথমে এই টালিগঞ্জ থানাতেই আনা হয়েছিল। গ্রেফতার করা না হলেও জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা রুজু হয়েছিল দেবপ্রিয়া চট্টোপাধ্যায় নামে ওই তরুণীর বিরুদ্ধে। লালবাজারের দাবি, সৌমেনবাবুর বদলি একেবারেই রুটিন বদলি। যদিও ১৬ জনের বদলি-তালিকার প্রথমেই ছিল তাঁর নাম।

একই ভাবে বাঁকুড়া থানার আইসি বিশ্বজিৎবাবুর বদলিকেও ‘রুটিন’ বলে দাবি করেছেন জেলা পুলিশের কর্তারা। সূত্র অবশ্য জানাচ্ছে, আইসি-বদলির ফলে ক্ষোভ দানা বাঁধছে পুলিশের নিচুতলায়। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, জেলা তৃণমূল নেতাদের অনেকেই ফোন করে চাপ দেওয়া সত্ত্বেও, ‘ডাকাবুকো’ অফিসার হিসেবে পরিচিত বিশ্বজিৎবাবু রেয়াত করেননি। রাতেই গ্রেফতার করেছিলেন ওই তৃণমূল নেতাকে। আদালত তাঁকে ১৪ দিনের জেল হাজতের নির্দেশও দিয়েছিল।

কিন্তু জেলে পৌঁছে কিছু ক্ষণের মধ্যেই পীযূষ বলতে থাকেন, তাঁর ঘাম হচ্ছে, অসুস্থ বোধ করছেন। তখন তাঁকে পাঠানো হয় হাসপাতালে। যা দেখে বিরোধীরা টিপ্পনি কেটেছেন ‘এ তো মদন মিত্রের উপসর্গ!’ বিজেপির রাজ্য সহ-সভাপতি সুভাষ সরকার বলেন, “তৃণমূল নেতাদের জেল থেকে বাঁচার আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে সরকারি হাসপাতাল। যে যুবক ঘণ্টা কয়েক আগে পুলিশের সঙ্গে হাতাহাতি করে, মহিলার শ্লীলতাহানি করে, সে এত তাড়াতাড়ি অসুস্থ হয় কী করে?’’

চিকিৎসক কপিলজিৎ চক্রবর্তীর অধীনে সম্মিলনী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন পীযূষ। এ দিন সকাল থেকেই ইনটেন্সিভ থেরাপি ইউনিট-এ (আইটিইউ) তাঁর সঙ্গে দেখা করতে তৃণমূল নেতাদের ভিড়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, হাইপার টেনশন, উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে তাঁর। তা হলে এত লোকের সঙ্গে দেখা করতে দিচ্ছেন কেন? এক চিকিৎসক বলছেন, ‘‘কী করব, আমরা তো ওঁদের ঠেকাতে পারি না।’’ ওই ওয়ার্ডে আরও বেশ কয়েক জন রোগী রয়েছেন। তাঁদের অসুবিধার কথা ভেবে দু-এক বার মৃদু আপত্তি জানিয়েও যে ফল হয়নি, হাসপাতাল সূত্রেই তা জানা গিয়েছে।

এ দিন সকালেই হাসপাতাল ঘুরে বাঁকুড়ার পুরপ্রধান মহাপ্রসাদ সেনগুপ্ত বলছেন, “পীযূষকে ফাঁসানো হয়েছে। উনি নির্দোষ। তাই ওঁর রক্তচাপ বেড়ে গিয়েছে।” পীযূষের স্ত্রী, বাঁকুড়া পুরসভার ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলার পিঙ্কি চক্রবর্তীও হাসপাতালে এসে বলেন, “আমার স্বামী দীর্ঘ দিন হৃদ্‌রোগে ভুগছেন। মিথ্যা বদনাম দিয়ে ওকে ফাঁসানো হল।” আর, জেলা সভাধিপতি অরূপ চক্রবর্তী, যিনি ঘটনার পরেই পীযূষকে ‘সমাজকর্মী’ বলে চিনিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি বলেন, ‘‘ওই তৃণমূল কর্মী তো দীর্ঘ দিন ধরেই অসুস্থ।’’

জেলা পুলিশের এক শীর্ষ কর্তা অবশ্য ধরিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘পীযূষ ওরফে বাপি তো ‘ক্যাসেট বাপি’ বলেই পরিচিত। তোলাবাজির দায়ে ওর নামে অভিযোগও রয়েছে। এলাকার বাসিন্দাদের কাছে এক বার মারধরও খেয়েছিল। সে কবে সমাজকর্মী হল জানি না।’’ পুলিশেরই একাংশের বক্তব্য, মাত্র ১৬ মাস আগে বিশ্বজিৎবাবু বাঁকুড়া থানার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তার পর থেকেই শাসক দলের স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে বেশ কয়েক বার ঠোকাঠুকি হয়েছে তাঁর। পুজোর সময়ে তারস্বরে মাইক এবং বাজি ফাটানো রুখতে, কড়া ব্যবস্থা নিতে গিয়ে একাধিক বার তৃণমূল নেতাদের বাধা পেয়েছেন তিনি। বদলি কি এ সবের জেরেই? এ দিন হুগলি ডিআইবি-তে বদলির ব্যাপারে মুখ খুলতে চাননি বিশ্বজিৎবাবু।

তবে অনেকেই বলছেন, সাম্প্রতিক অতীতে এমন একাধিক ঘটনায় রাজ্যের পুলিশের মনোবল এখন তলানিতে। কখনও গুলি খেয়েছেন পুলিশ অফিসার, কখনও থানায় হামলার সময় পুলিশকে টেবিলের তলায় লুকোতে হয়েছে, কখনও রোগীকে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করাতে গিয়ে মার খেয়েছে পুলিশ। অথচ প্রত্যেক ঘটনাতেই স্রেফ শাসক দলের সঙ্গে অভিযুক্তের ঘনিষ্ঠতার জন্য হাত গুটিয়ে থাকতে হয়েছে আইনরক্ষকদের। বিরোধীদের কেউ কেউ মনে করিয়ে দিচ্ছেন, পার্ক স্ট্রিটে ‘ধর্ষণ হয়েছে’ বলে সরকারের অবস্থানের বিরুদ্ধে যাওয়ায় গোয়েন্দাপ্রধান দময়ন্তী সেনকে বদলি হতে হয়েছিল। কাজেই ওসি বা আইসি-দের ‘বেচাল’ যে শাসক দল বরদাস্ত করবে না, তা খুব স্বাভাবিক।

নিগৃহীত ওই মহিলা এ দিনও ফোনে জানান, ‘‘ওই তৃণমূল নেতার সঙ্গীরা অভিযোগ তুলে নিতে ক্রমাগত চাপ দিচ্ছে। তবে আমি চাই, দোষীদের কড়া শাস্তি হোক।’’ বাঁকুড়া জেলা পুলিশের এক কর্তা প্রশ্ন তুলছেন, ‘‘দোষীদের শাস্তি তো আমরাও চাই, কিন্তু সে ব্যাপারে কড়া ব্যবস্থা নিলেই যদি বদলি হয়ে যেতে হয়, তা হলে?’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE