রাস্তার মাঝখানে সেই ক্লাব। — নিজস্ব চিত্র
যে দলের মেয়র, সেই দলেরই মন্ত্রী। অতএব, সোনায় সোহাগা।
যে সে মন্ত্রী নন, দলের অন্যতম প্রবীণ নেতা এবং স্বয়ং কলকাতা পুরসভার প্রাক্তন মেয়র।
তাই জনগণের রাস্তার ঠিক মাঝখানে বেআইনি ভাবে তিনতলা ক্লাব মাথাচাড়া দিয়ে উঠলেও রা কাড়ে না পুরসভা ও পুলিশ।
একডালিয়া রোডের মাঝখানে এক টুকরো ঘেরা জায়গায় বহুদিন ধরেই ছিল একচালার ক্লাব একডালিয়া এভারগ্রিন। সেখানেই মাথা উঁচিয়ে একতলা থেকে তিনতলা হয়ে গিয়েছে ক্লাব, যার সর্বময় কর্তা রাজ্যেরই বিদায়ী মন্ত্রী তথা তৃণমূলের ওজনদার নেতা সুব্রত মুখোপাধ্যায়।
অভিযোগ, রাস্তা ‘দখল’ করে ওই বাড়ি গড়ে তোলা হয়েছে। আরও অভিযোগ, পুরসভা ‘নীরব’, আর পুলিশ দেখেও ‘দেখেনি’।
ওই নির্মাণ নিয়ে যথাযথ আইনি ব্যাখ্যা সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের কাছে পাওয়া যায়নি। তিনি শুধু বলেছেন, ‘‘যে জায়গায় ক্লাবটি হয়েছে, সেটি পুরসভা থেকে লিজ নেওয়া আছে। অনেক আগেই। সেই লিজ নেওয়া জমিতে অনেক আগেই একচালা ক্লাব ছিল। সেটা ভেঙেচুরে যাওয়ায় সারানো হয়েছে। তল বাড়ানো হয়েছে। এলাকাবাসীর প্রয়োজনে। ব্যক্তিস্বার্থে নয়।’’ কিন্তু ওই তল বাড়ানোর জন্য পুরসভার কাছ থেকে কোনও অনুমোদন নেওয়া হয়েছে কি? পুরসভা সূত্রের খবর, বাড়ির তল বাড়াতে হলে পুরসভাকে নকশা (প্ল্যান) জমা দিতে হয়। পুরসভা সেই নকশা দেখে অনুমোদন দিলে তবে তা করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে তেমনটি করা হয়নি বলেই পুরসভার বিল্ডিং দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে।
গড়িয়াহাট মোড় থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে একডালিয়া রোড। সাবেক ওই রোডের একটি নতুন নাম করেছে পুরসভা। পি সি সরকার সরণি। পার্ক সার্কাস থেকে গড়িয়াহাটগামী মূল রাস্তা থেকে বাঁ দিকে একডালিয়া রোড। এভারগ্রিনের জাঁকজমকপূর্ণ দুর্গাপুজো শহরের বড় পুজোগুলির অন্যতম। রাস্তার উপরেই পুজো হয়ে আসছে বছরের পর বছর। পুজো প্যান্ডেলের পিছনেই এক চালার ক্লাব একডালিয়া এভারগ্রিন। কয়েক দশক ধরেই ওই পুজোর দায়িত্বে রয়েছেন সুব্রতবাবু। একডালিয়া এভারগ্রিন বলতে লোকেও এক বাক্যে সুব্রতবাবুকেই জানেন। তিনিই ওই ক্লাবের সভাপতি।
এখন ওই এলাকায় গেলেই চোখে পড়বে একচালার উপরে তিনতলা বাড়ি গড়ে উঠেছে। বাড়ির গায়ে বড় হরফে লেখা একডালিয়া এভারগ্রিন ক্লাব। স্থাপিত - ১৯৪৩। বাড়ির এক তলায় একটি ফলকে লেখা রয়েছে নব নির্মিত ভবনের উদ্বোধন করলেন রাজ্যের মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। ২০১৫ সালের ১৩ ডিসেম্বর। অর্থাৎ প্রায় ৭৩ বছর আগের একটি ক্লাব, এ বার ‘বেআইনি’ নির্মাণে অভিযুক্ত।
পুরসভা সূত্রের খবর, জায়গাটি কলকাতা পুরসভার সম্পত্তি। সেখানে একটা তিনতলা বাড়ি গড়ে তোলা অবৈধ নির্মাণ বলেই মনে করছেন পুরসভার একাধিক আমলা। তাঁদের কথায়, উনি ক্ষমতাশালী ব্যক্তি বলেই কেউ প্রতিবাদ করার সাহস দেখাননি। প্রশ্ন উঠেছে, পুর এলাকায় রাস্তার উপরে কোনও অস্থায়ী কাঠামো হলেই ‘রে রে’ করে তেড়ে আসেন বিল্ডিং দফতরের ইঞ্জিনিয়ারেরা। ‘বখরা’ না পেলে তা ভেঙে দিতে কসুরও করে না পুলিশ। সেখানে এ ধরনের একটি নির্মাণ নিয়ে পুরসভা বা পুলিশ কোনও পদক্ষেপ করল না কেন?
রাজ্যের এক শীর্ষস্থানীয় মন্ত্রী, যিনি নিজে কলকাতার মেয়র ছিলেন, তিনি নিজে কী ভাবে ওই ‘বেআইনি’ নির্মাণ করলেন, প্রশ্ন উঠছে তা নিয়েই। আর পুরসভার বর্তমান মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়, যিনি আবার বিল্ডিং বিভাগের দায়িত্বে, তিনিই বা এ ব্যাপারে কোনও ব্যবস্থা নিলেন না কেন? পুরসভা সূত্রের খবর, রাস্তার উপর যে ভাবে তিনতলা বাড়ি হয়েছে, তা আইনত করা যায় না। আর তা নজরে রাখার মূল দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট বরোর বিল্ডিং দফতরের আধিকারিকের। এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া তো দূর, বরং কয়েক মাস ধরে ওই নির্মাণকাজ হওয়া দেখেও টুঁ শব্দটি করেননি ওই বরোর আধিকারিক। মুখে কুলুপ এঁটেছেন পুরসভার প্রধান দফতরে থাকা বিল্ডিং দফতরের অন্য আধিকারিকেরাও।
রাজ্যের প্রবীণ নেতা ও প্রাক্তন মন্ত্রী যদি বিনা বাধায় এ ভাবে রাস্তার মাঝখানে তিনতলা ক্লাব তৈরি করতে পারেন, তা হলে প্রশ্ন ওঠে অন্য কেউ চাইলে কী যুক্তিতে এই ধরনের নির্মাণ আটকাবে পুরসভা? মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘ওই নির্মাণ সম্পর্কে আমার কিছু জানা নেই। খোঁজ নিয়ে জানতে হবে।’’ পুর আইন অনুযায়ী এ ধরনের নির্মাণ হতে পারে কি? রক্ষণাত্মক ভঙ্গিতে মেয়র বলেন, ‘‘সুব্রতদা নিজেও কলকাতার মেয়র ছিলেন। পুরসভার আইনকানুন তিনিও জানেন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy