ছবি: মণীশ মৈত্র
বিকট গন্ধ। সঙ্গে বিদঘুটে শব্দ। শিয়ালদহ থেকে এনজেপি যাবেন বলে পদাতিক এক্সপ্রেসে উঠেই আঁতকে উঠেছিলেন হাওড়ার দেবী ঘোষ। এনজেপিতে নামার আগেও একই দৃশ্য নিয়মিত দেখা যায়। পদাতিক এক্সপ্রেসের বাতানুকূল থ্রি টিয়ার কামরায় জামা খুলে বার্থে উপুড় হয়ে শুয়ে রয়েছেন কেউ কেউ। তাঁদের গায়ে তেল ছড়িয়ে চলছে মালিশ। নিয়মিত যাঁরা যাতায়াত করেন, তাঁরা তাই ট্রেনটির নাম দিয়েছেন ‘ম্যাসাজ পার্লার অন হুইলস’।
শিয়ালদহে মালিশ চলে ট্রেন ছাড়ার আগের দশ পনেরো মিনিট। কামরায় উঠে পড়েন ‘মালিশওয়ালারা’। সহযাত্রীদের সম্মতির তোয়াক্কা না করে কেউ কেউ জামা খুলে ফেলেন। কেউ প্যান্ট গুটিয়ে নেন। ‘আয়ুর্বেদিক তেল’ দিয়ে শুরু হয় মালিশ। তারপরেই কামরা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে কটু গন্ধ। তার সঙ্গে ধপাস, চপাস শব্দ। কেউ ব্যথা পেয়ে চেঁচান, কেউ আনন্দে। দেবী বলেন, ‘‘মুখ ঘুরিয়ে বসেছিলাম। কিন্তু মাথা ধরে যাচ্ছিল ওই শব্দ আর গন্ধে। কিছু বলতে সাহস পাইনি।’’ মিনিট পাঁচেকের মধ্যে রেলের সাফাইকর্মীরা উঠে সুগন্ধি স্প্রে করে দিয়ে যান।
একই দৃশ্য যাত্রাপথের শেষের দিকেও। কিসানগঞ্জ এলেই আবার কামরায় ম্যাসাজের হাঁকাহাঁকি। শুধু পদাতিক নয়, কামরূপ এক্সপ্রেসেও বহু দিন ধরেই এই কাণ্ড চলছে। মধ্য চল্লিশের উমিদ রায় দাবি করলেন, কয়েক বছর ধরে ট্রেনে ম্যাসাজই তাঁর পেশা। খোলাখুলিই কারবার চালান। সুগন্ধিও ছড়ানো হয় না। উমিদের হকারের লাইসেন্সও নেই। উমিদ বলেন, ‘‘চুরি তো করছি না। ফুল বডি আড়াইশো, হেড অ্যান্ড শোল্ডার দেড়শো, ওনলি হেড ৫০ টাকা।’’ পুলিশ, টিটিই, রেলকর্মীদের কী ভাবে ম্যানেজ করেন? উমিদের দাবি, প্রয়োজনে কিছু ‘ফ্রি ম্যাসাজ’ দিতে হয় তাঁকে। কিন্তু স্রেফ এই দু’টো ট্রেনে কেন! উমিদের জবাব, ‘‘কামরূপ, পদাতিকেই লোকে বেশি ম্যাসাজ করায়।’’ দার্জিলিং মেলের মতো কিছু ট্রেন তাঁরা এড়িয়ে চলেন।
যাত্রীদের বক্তব্য, রেলকর্তারা জানেন না, তা হতে পারে না। রেলের কাটিহার ডিভিশনের সিনিয়র এরিয়া ম্যানেজার পার্থসারথি শীল বলেন, ‘‘ট্রেনের কামরায় ম্যাসাজ করাটা অসভ্যতা। ঘটনা শুনেই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। এ সব বন্ধ
হয়ে যাবে।’’
কিন্তু এত দিন ধরে চলছেই বা কী করে? বুধবারের কথাই ধরা যাক। এনজেপিগামী পদাতিক কিসানগঞ্জ ছাড়ার পরেই ‘মালিশ-মালিশ’ আওয়াজে সরগরম হয়ে যায় বাতানুকূল টু-টিয়ার কোচ। একটু পরেই শুরু হয়ে যায় গন্ধ আর শব্দের উপদ্রব। ঘটনাচক্রে, সেই ট্রেনেই ছিলেন সপরিবার পর্যটন ব্যবসায়ীদের সংগঠনের নেতা সম্রাট সান্যাল। তিনি বলেন, ‘‘ট্রেনের মধ্যে এতটা অভব্য ব্যাপার দিনের পর দিন কী ভাবে চলতে পারে? আগে তো এমন ছিল না। সব মহলে জানাব।’’
সূত্রের খবর, কোনও অভিযোগ নেই বলে কেউই ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। কিন্তু, রেল সুরক্ষা আইনের ১৪৫ ধারা অনুযায়ী ট্রেনের কামরায় এমন কোনও আচরণ কিংবা কাজ করা যাবে না, যাতে সহযাত্রীদের অসুবিধে হয়। তেমন দেখলে স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে রেল সুরক্ষা বাহিনী, জিআরপি ব্যবস্থা নিতে পারে। এমনকী, গ্রেফতারও করতে পারে। রেলের সিনিয়র এরিয়া ম্যানেজারের আশ্বাস, শীঘ্রই কড়া পদক্ষেপ হবে।
তত ক্ষণ ওই কড়া গন্ধ আর দৃশ্যের মধ্যে কামরায় পা ফেলতেও ভয় পাচ্ছেন অনেকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy