E-Paper

নাবালিকা বিয়ে বা শ্রমিক হওয়াই রাস্তা

রাস্তায় বরাদ্দ হয়। খরচও হয়। তবু রাস্তা নেই বলে পড়াশোনা ছেড়ে দিতে হয় এ রাজ্যেই। কেন?

সোমা মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০২৫ ০৫:২৪
ছোট নৌকা বেয়ে স্কুলের পথে। টিকলি চরে।

ছোট নৌকা বেয়ে স্কুলের পথে। টিকলি চরে। ছবি: সারিউল ইসলাম।

একটা খারাপ রাস্তা জীবনটাকে কোন খাতে বইয়ে দেয়?

মুর্শিদাবাদের টিকলি চরে এই জীবন কখনও নাবালিকা বিয়ের কারণ হয়ে যায়। কখনও বা কৈশোর না পেরোতেই ভিন্ রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিক হতে বাধ্য করে। প্রকৃতির রোষে ঘর ভাঙা আর ঘর গড়ার চক্রে বাঁচেন যে হাজার হাজার মানুষ, একটা পাকা রাস্তা তাঁদের প্রতি রাতের স্বপ্নে ঘুরেফিরে আসে। ভোর হলে ঘুম যখন ভাঙে, দেখেন রাস্তা কোথাও নেই। রয়েছে নৌকা, কাদা, পাঁক, গর্ত, বিষাক্ত সাপ আর চর্মরোগেভরা বাস্তব।

ভগবানগোলার খড়িবোনা ঘাট থেকে নৌকায় পদ্মার শাখানদী পেরিয়ে, হেঁটে, তার পরে মোটরসাইকেলে, তার পরে আবার হেঁটে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের খুব কাছেই টিকলি চরে পৌঁছোনো। ভগবানগোলার মূল এলাকা সকালের ব্যস্ততায় জেগে উঠলেও এখানে ছবিটা আলাদা। দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল, জল পেরিয়ে ছোট নৌকায় আসছে কয়েক জন কিশোর -কিশোরী। পরনে স্কুলের পোশাক। সাদিকা খাতুন, আউলিয়া খাতুন, মিনারা খাতুন, পায়েল খাতুনেরা টিকলি চর থেকে পড়তে যায় মাদ্রাসায়। চর পাইকমারি থেকে সাইকেলে আধ ঘণ্টা। তার পরে ছোট নৌকা। সে নৌকা নিজেদেরই বাইতে হয়। এক-এক দিন পালা করে এক-এক জন নৌকা বায়। নৌকা থেকে নেমে আবার দীর্ঘ পথ হাঁটা। পৌঁছোনো খড়িবোনা ঘাটে। সেখানে আরও কিছুটা হেঁটে তার পরে মাদ্রাসা। বইয়ের ব্যাগে ছোট পলিথিনের প্যাকেটরাখে অনেকেই। রাখে পোশাকও। কখন জলে কাদায় পরনের জামা নষ্ট হয়ে যাবে!

এ ভাবেই প্রতি দিন? এক কিশোরী বলে, ‘‘বর্ষার সময় তো মাসের পর মাস বাড়িতেই বসে থাকি। অন্য সময়েও বাড়ি থেকে রোজ বারণ করে। বলে, ‘এ ভাবে যাস না। কোন দিন বড় বিপদ হবে।’ আমরা জোর করেই আসি। আমাদের অনেক বন্ধুর স্কুলে আসা বন্ধ হয়ে গেছে।’’ সেই বন্ধুরা বাড়িতেই থাকে? মুখ নামিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে। তাকায় বন্ধুদের দিকে। তার পরে বলে, “অনেকের বিয়ে হয়ে গিয়েছে।” ষষ্ঠ শ্রেণির এই ছাত্রীর বয়স এখন ১২। জানা যায়, তারও বিয়ের চেষ্টা চলছে। তার ১৭ বছরের দাদা লেখাপড়া ছেড়ে কেরলে গেছে কাজ করতে। “বাবা বলেছে লেখাপড়া তো হল না, বরং কাজ করে দুটো টাকা ঘরে আন।”

ভগবানগোলার মূল এলাকা থেকে টিকলি চর বা তার পাশের নির্মল চরের দূরত্ব কিলোমিটারের হিসেবে বেশি নয়। কিন্তু প্রশাসনিক সীমানা দিয়ে চরের মানুষের দুর্দশা মাপা যায় না। রাস্তার অভাবে মূল এলাকার সঙ্গে এখানকার দূরত্ব এমনই যে ঘরে ঘরে স্কুলছুট ছেলেমেয়ে। যারা কোনও মতে স্কুলের গণ্ডি পেরোয়, তাদের বেশির ভাগই কলেজের মুখটা দেখতে পায় না। বা দেখলেও স্বপ্ন থেমে যায় মাঝপথেই।

ছাত্রী নাসিমা খাতুন।

ছাত্রী নাসিমা খাতুন। ছবি: সারিউল ইসলাম।

রসায়ন অনার্স নিয়ে বহরমপুরের কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন নাসিমা খাতুন। মাঝপথে পড়া ছেড়ে দিয়েছেন। কলেজে ক্লাস পাঁচ ঘণ্টা।

যাতায়াতের জন্য সময় লাগে ৬ ঘণ্টা। বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা। অন্ধকারে এতটা পথ ফেরার সময় মন্দ লোকের ভয় তো থাকেই, সঙ্গে থাকে বিষধর সাপ আর বুনো শুয়োরের ভয়। নাসিমার অবশ্য জেদ, কলেজ ছাড়লেও বিয়ে নয় এখনই। শহরের নার্সিং কলেজে জায়গা পেলে হস্টেলে থেকে বৃত্তির ব্যবস্থা করে নার্সিং পড়তে চান তিনি। ‘‘তা হলে একটা কাজের ব্যবস্থা অন্তত করতে পারব। কিন্তু জানেন, আমি রসায়ন নিয়েই পড়তে চেয়েছিলাম। পারলাম না। আমার বন্ধুদের অনেকেরই বাড়ি থেকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়েছে। বলেছে, লেখাপড়া তো আর হবে না। বাড়ি বসে থেকে কী করবি!’’ তার পরেই স্বগতোক্তি, ‘‘একটা পাকা রাস্তা থাকলে আমাদের জীবনটা কিন্তু অন্যরকম হতে পারত।’’

শিক্ষক নয়ন সরকার বলছিলেন, ‘‘মেধায় কম নয় এখানকার ছেলেমেয়েরা। শুধুমাত্র সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিত হয় বলে এগোতে পারে না। স্কুলছুট হয়। কত ছাত্রছাত্রী যে মাঝপথে লেখাপড়া ছেড়ে দিল! প্রশাসনিক ব্যর্থতা প্রজন্মের পর প্রজন্মকে পিছিয়ে রাখছে।’’

স্কুল-কলেজের দূরত্ব, রাতে ফেরার সময় নিরাপত্তার অভাব, শৌচাগারের সমস্যা, বর্ষায় মাসের পর মাস স্কুল পৌঁছতে না পারা, সব মিলিয়ে এলাকার পর এলাকায় প্রজন্মের পর প্রজন্ম বাধ্য হয়ে শিক্ষা বিমুখ থেকে গিয়েছে। অথচ মূল এলাকার সঙ্গে সংযোগকারী একটা রাস্তা থাকলেই স্কুলে উপস্থিতির হার বাড়ত। কমে যেত স্কুলছুটের সংখ্যা।

গ্রামগুলিতে যাঁদের সামান্য সামর্থ্য আছে, তাঁরা সন্তান বড় হলে দূরে কোনও আত্মীয়ের বাড়িতে রেখে লেখাপড়া করান কিংবা হস্টেলে রাখেন। তৌহিদা বেগম বললেন, ‘‘এখানে সবটাই নদীর মর্জির ওপর নির্ভর করে। কখনও কখনও মাসের পর মাস কেউ বেরোতেই পারে না। এই ভরসায় ছেলেমেয়ের পড়াশোনা হয় নাকি?’’ তাঁর স্বামী তাকিউল্লা এই গ্রাম থেকেই গ্র্যাজুয়েট হয়েছেন। শেষ এক বছর আত্মীয়ের বাড়িতে থেকে কলেজ যেতেন। বললেন, ‘‘এখানে থাকলে লেখাপড়া শেষ হত না। অবস্থা ক্রমশ আরও খারাপ হচ্ছে। ঘরের পর ঘর ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা বন্ধ। প্রশাসনের কোনও স্তরেই হেলদোল নেই। চরের মানুষের ভোটের দাম আছে, শিক্ষার দাম নেই।’’

পড়ুয়া আসে না। স্কুলে শিক্ষকরাও আসতে চান না। মিড ডে মিলের রান্নাঘর ঠিকমতো চলে না। এলাকার লোকজনের ক্ষোভ, নেতাদের কিছু বলতে গেলে ওঁরা বলেন, ‘কী করব, ভাঙনের এলাকা। সমস্যা তো থাকবেই!’ তাঁদের প্রশ্ন, ‘‘তা হলে কি চরের ভবিষ্যত, এখানকার ছেলেমেয়েদের শিক্ষা ভাঙনের অজুহাতে বছরের পর বছর অবহেলিতই থেকে যাবে?’’

শুধু ভগবানগোলা ১ নম্বর ব্লকের টিকলি চরই নয়, ২ নম্বর ব্লকের হাঁসচরা, চর মহিষমারি, নির্মল চর, শয়তান পাড়া, চর মনসুরপুর, চর পাইকমারি, সর্বত্র ছবিটা একই। জল কম থাকলে বালির চরে নৌকা আটকে যায়। আর জল বাড়লে স্রোতের তীব্রতায় নৌকায় পারাপার করতেই ভয় লাগে। নৌকা থেকে নামার পরেও বালিতে পা ডুবে যায়। কাদায় আটকে থাকে সাইকেলের চাকা। দু'এক জায়গায় বাঁধানো রাস্তা আছে ঠিকই, কিন্তু তাতে মূল এলাকার সঙ্গে যোগসূত্র তৈরি হয় না।

চারদিকে এত প্রকল্প, এখানকার মানুষের জীবনটা বদলায় না কেন? ভগবানগোলা ১- এর বিডিও নাজির হুসেন বলেন, ‘‘টিকলি চর কবরস্থান থেকে বিএসএফ ক্যাম্প পর্যন্ত রাস্তার অনুমোদন হয়েছে। টেন্ডার প্রক্রিয়াও শুরু হতে চলেছে। অদূর ভবিষ্যতে ওখানে রাস্তা হবে।’’

নির্মল চরের রাস্তা সম্পর্কে ভগবানগোলা ২- এর বিডিও অনির্বাণ সাহু বলেন, "জেলা পরিষদ বিষয়টা দেখছে। মাস ছয়েক আগে নির্মল চর-সহ কয়েকটি গ্রাম সংযুক্ত করার জন্য প্রায় আট কিলোমিটার রাস্তার প্রস্তাব জমা পড়েছে।’’ মুর্শিদাবাদের অতিরিক্ত জেলাশাসক শামসুর রহমানও জানান, টিকলি চর সংলগ্ন কয়েকটি গ্রামের মধ্যে সংযোগকারী রাস্তা তৈরির বিষয়ে প্রাথমিক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এলাকার মানুষ অবশ্য বিশ্বাস করেন না। তাঁদের বক্তব্য, ‘‘মাঝেমাঝেই এমন কিছু কথা হাওয়ায় ভেসে ওঠে, মিলিয়ে যায়। আমাদের অবস্থার ফারাক হয় না। ভোটের মুখে এ সব কথায় তাই আর ভরসা নেই। আমরা জেনে গিয়েছি,আমাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া হবে না, ব্যস।’’

ফিরতি পথে দেখা তৃতীয় শ্রেণির পড়ুয়া আসমিনার সঙ্গে। রাস্তা নিয়ে কথা বলছি শুনে এগিয়ে আসে। বলে, ‘‘আমরা যদি প্রতি দিন এত কষ্ট করে স্কুলে যেতে পারি, বড়রা কি একটা রাস্তা তৈরি করতে পারে না?’’

প্রশ্ন তোলার সাহস রাখা আসমিনারাই কি চরে নতুন দিন আনতে চলেছে?

(চলবে)

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Poor condition of road road construction West Bengal government School students

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy