E-Paper

‘অধরা’ অনুব্রতকে নিয়ে ক্ষতির শঙ্কা তৃণমূলেও

অনুব্রত মণ্ডলের আচরণে যে অস্বস্তি তৈরি হয়েছে, তাতে গ্রহণযোগ্য পদক্ষেপ করা না হলে প্রশাসনের স্বচ্ছতা নিয়ে তীব্র সংশয় দেখা দেবে বলেই মনে করছে দলের একটি বড় অংশ।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৫ জুন ২০২৫ ০৯:১৭
অনুব্রত মণ্ডল।

অনুব্রত মণ্ডল। —ফাইল চিত্র।

বীরভূমের ‘দোর্দণ্ডপ্রতাপ’ অনুব্রত মণ্ডলকে নিয়ে দলীয় নেতৃত্বের অবস্থানে এ বার প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে তৃণমূল কংগ্রেসের অন্দরেই।

প্রথম সারির এই নেতার আচরণে যে অস্বস্তি তৈরি হয়েছে, তাতে গ্রহণযোগ্য পদক্ষেপ করা না হলে প্রশাসনের স্বচ্ছতা নিয়ে তীব্র সংশয় দেখা দেবে বলেই মনে করছে দলের একটি বড় অংশ। এই প্রসঙ্গে বীরভূম জেলারই তৃণমূল ছাত্র পরিষদের (টিএমসিপি) শাস্তিপ্রাপ্ত নেতার কথা টেনে তাঁদের অনেকে বলছেন, এক যাত্রায় পৃথক ফলের এই ব্যবস্থা সামগ্রিক ভাবে দলের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলার বিষয়টিকেই হেয় করা হচ্ছে। শাসক দল ও প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে বিরোধীরাও।

নির্বাচন থেকে দৈনন্দিন প্রশাসন, সর্বত্র পুলিশকে দলের কাজে ‘ব্যবহারে’র অভিযোগে শাসক দলের বিরুদ্ধে সরব বিরোধীরা। অনুব্রতের (কেষ্ট) আচরণে প্রাথমিক ভাবে তাদের সেই অভিযোগ মান্যতা পেয়েছে বলে এ বার চর্চা শুরু হয়েছে তৃণমূলেই। গত কয়েক দিনের টানাপড়েনের প্রেক্ষিতে দলের এক শীর্ষ নেতার মত, ‘‘অনুব্রতের মতো প্রথম সারির নেতার মুখে পুলিশ সম্পর্কে ওই ধরনের অসম্মানজনক কথা নিঃসন্দেহে অস্বস্তিকর। তদন্তে যা-ই প্রমাণ হোক, এই নিয়ে মানুষের মনে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হতে বাধ্য। তাই আমাদের কড়া হওয়া উচিত।’’

তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্নেহভাজন হিসেবে পরিচিত বলে অনুব্রতকে নিয়ে নেতারা প্রকাশ্যে কিছু না বললেও অনেকেই মনে করছেন, শৃঙ্খলার প্রশ্নে নেতৃত্বের এই নীরবতা খারাপ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। সাংগঠনিক শক্তি ও ভোটের সাফল্যের কারণে অনুব্রত সম্পর্কে দলীয় নেতৃত্ব ‘দুর্বল’, অতীতে বারেবারে সেই অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি বীরভূমের জেলা সভাপতি পদ থেকে সরিয়ে অনুব্রতকে কোর কমিটির সদস্য করে দেওয়া হয়েছে তৃণমূল নেত্রীর সম্মতিতেই। তার পরেও অনুব্রতের ফোনের অডিয়ো রেকর্ডিং ছড়িয়ে পড়ার পরে দলের তরফে ক্ষমা চাওয়ার নির্দেশ ছাড়া প্রকাশ্যে আর কোনও পদক্ষেপ না হওয়ায় বিস্ময় তৈরি হয়েছে দলের একাংশের মধ্যেই। ওই রেকর্ডিংয়ে থাকা হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশের তলব নিয়ে অনুব্রতের মতো নেতা যে টালবাহানা করছেন, তা-ও প্রশাসনের সম্পর্কে বিরোধীদের অভিযোগ প্রতিষ্ঠা করছে বলেই আশঙ্কা শাসক দলের নেতাদের ওই অংশের। সে ক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রীরই হাতে থাকা স্বরাষ্ট্র তথা পুলিশের আরও অমার্যাদা হচ্ছে বলেও মনে করছেন তাঁরা।

এই চর্চায় যোগ হয়েছে অনুব্রতের পক্ষ নিয়ে সমাজ মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট পুলিশ আধিকারিককে আক্রমণ করে নিলম্বিত (সাসপেন্ড) দলের ছাত্র-নেতার প্রসঙ্গ। এই সূত্রেই দলের শৃঙ্খলা এবং সেই বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত কমিটির প্রাসঙ্গিকতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে দলের মধ্যেই। তৃণমূলের এক রাজ্য নেতার কথায়, ‘‘দলের এই রকম সব ব্যবস্থায় কেউ ব্যতিক্রম হয়ে গেলে সাধারণ নেতা-কর্মীদের আস্থা রক্ষা করা কঠিন হয়।’’ অন্য এক নেতার বক্তব্য, ‘‘এই গোটা ঘটনায় গোষ্ঠী-রাজনীতির প্রভাব থাকতে পারে। তবে প্রশাসনের মর্যাদা রক্ষা করতেই অনুব্রতকে আড়াল করা সমীচীন হবে না।’’ দলের ওই অংশের মতে, ভোটের আগে বীরভূমে দলের ক্ষমতার রাশ পুরোপুরি কাজল শেখের হাতে চলে যেতে পারে, এই সংক্রান্ত ‘ভারসাম্যে’র প্রশ্নও অনুব্রতের ক্ষেত্রে ‘ধীরে চলা’র কারণ হতে পারে।

অনুব্রতের অডিয়ো-ক্লিপ সমাজ মাধ্যমে দিয়ে সরব হয়েছিলেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। তিনি বলছেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হয়তো অনুব্রতকে ধীরে ধীরে কোণঠাসা করবেন। কিন্তু সরাসরি কোনও ব্যবস্থা নিতে পারবেন না। কারণ, অনুব্রত যদি সিবিআইয়ের কাছে মুখ খোলেন, জানিয়ে দেন গরু পাচারের টাকা কার কাছে গিয়েছে, তা হলে তৃণমূলের বড় নেতারা ভিতরে ঢুকবেন!’’ সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীর বক্তব্য, ‘‘পুলিশ মুখ্যমন্ত্রীর, অনুব্রতও মুখ্যমন্ত্রীর। বোঝা যাচ্ছে, অনুব্রতের মাথায় তাঁর দিদির হাতের শক্তি বেশি! এখন হইচই হয়ে গিয়েছে তাই, না হলে পুলিশকে অনুব্রতের কাছে ক্ষমা চাইতে পাঠানো হত! আইনের শাসন তো নেই, দুষ্কৃতীর আইন চলছে!’’ প্রদেশ কংগ্রেসের মুখপাত্র সৌম্য আইচ রায়ও বলেছেন, ‘‘এক ছাত্র-নেতাকে শাস্তি দিয়ে তৃণমূল বীরত্ব দেখিয়েছে। কিন্তু অনুব্রতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তারা ভয় পাচ্ছে। বীরভূমে দাদার যত কীর্তি আছে, তিনি মুখ খুললে কলকাতার দিদি-দাদাদের বিপদ হবে!’’

তৃণমূলের রাজ্য সহ-সভাপতি জয়প্রকাশ মজুমদার অবশ্য অনুব্রতকে বিশেষ ছাড় দেওয়ার অভিযোগ উড়িয়ে দাবি করেছেন, ‘‘পুলিশি তদন্ত চলছে। তার মধ্যে দল কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। তবে দলীয় স্তরেও প্রয়োজনীয় খোঁজ-খবর হচ্ছে।’’ তাঁর আরও মন্তব্য, ‘‘বিজেপির মতো তৃণমূলে ধর্ষণে অভিযুক্তকে মালা দিয়ে বরণ করার রেওয়াজ নেই! এখানে অনুশাসনের প্রশ্নে কাউতে রেয়াত করা হয় না।’’

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Anubrata Mondal TMC

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy