E-Paper

নেলপলিশ তোলার তরল, যন্ত্রে উধাও ওষুধের মেয়াদ

হঠাৎই আর কাজ হচ্ছে না পরিচিত ওষুধে। কেন? জাল ওষুধের রমরমা থাবা বসাচ্ছে স্বাস্থ্যে। তল্লাশি চললেও বদলাচ্ছে কারবারিদের কৌশল।

শান্তনু ঘোষ

শেষ আপডেট: ৩০ মার্চ ২০২৫ ০৭:৩৬

ছবি: সংগৃহীত।

নখরঞ্জনীর সঙ্গে জাল ওষুধের সম্পর্ক কী?

জাল ওষুধের তদন্তে নেমে চমকে গিয়েছিলেন তদন্তকারীরাও। দেখেছিলেন নখরঞ্জনী মুছে ফেলার তরল (নেলপলিশ রিমুভার) দিয়ে কী অনায়াসে ওষুধের স্ট্রিপ থেকে মুছে ফেলা হচ্ছে মেয়াদের তারিখ। তারপর নতুন তারিখের ছাপ দিয়ে ফের বাজারে আসছে ওই ওষুধ। ‘এক্সপায়ারি ডেট’ দেখে নিতে অভ্যস্ত ক্রেতারা জানতেই পারছেন না, মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়া ওষুধ কী ভাবে শরীরে ঢুকিয়ে নিচ্ছেন তাঁরা।

ব্যবস্থা অবশ্য হয়েছিল। মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ নিয়ে এই ভাবে জালিয়াতি হচ্ছে বুঝতে পেরে নতুন পন্থা নিয়েছিল কিছু প্রস্তুতকারী সংস্থা। ওষুধের স্ট্রিপের উপরে মেয়াদের তারিখ খোদাই করা শুরু করে তারা। কিন্তু তাতেও রক্ষা নেই।

সম্প্রতি আমতায় প্রায় ২ কোটি টাকার জাল ওষুধ বাজেয়াপ্ত হওয়ার পরে তা নিয়ে তদন্ত শুরু করে রাজ্য ড্রাগ কন্ট্রোল। বিভিন্ন সূত্র এক-এক করে মেলাতে গিয়ে দেখা যায় শিকড় রয়েছে হরিয়ানায়। সেখানকার সোনপতে ভুয়ো সংস্থা খুলে চলছিল জাল ওষুধ তৈরি। যেখানে ওষুধের স্ট্রিপে খোদাই করা মেয়াদের তারিখ অনায়াসে মুছে ফেলার জন্য ছিল স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র। শুধু তা-ই নয়। প্যাকেজিং থেকে ওষুধ তৈরি— সবেতেই উন্নতপ্রযুক্তির যন্ত্রপাতি। ইতিমধ্যে হরিয়ানা পুলিশ ওই সংস্থার মালিককে গ্রেফতার করেছে। জানা গিয়েছে, উত্তরাখণ্ডের বদ্রীর একটি সংস্থার লাইসেন্স জাল করে খোলা হয়েছিল ওই ভুয়ো সংস্থা।

শুধু ওই রাজ্য নয়। অভিযোগ, কেন্দ্র এবং রাজ্য ড্রাগ কন্ট্রোলের বেহাল পরিকাঠামোর সুযোগ কাজে লাগিয়ে আন্তঃরাজ্য জাল ওষুধের চক্র প্রবল সক্রিয়। প্রশাসনের চোখে ধুলো দিয়ে উত্তরপ্রদেশ, বিহার, ঝাড়খণ্ড, উত্তরাখণ্ড, ওড়িশা থেকেও কলকাতায় ঢুকছে জাল ওষুধ। কেন্দ্র ও রাজ্য ড্রাগ কন্ট্রোলের আধিকারিকদের বক্তব্য, “জাল ওষুধ তৈরিতে উন্নত প্রযুক্তিকে হাতিয়ার করছেন অসাধু কারবারিরা। আর সেই ওষুধ বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে দিতে ব্যবহার করা হচ্ছে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম।”

ওষুধের মেয়াদ মুছে ফেলার কাজ এক সময়ে এই শহরে রমরম করে চলেছে। বছর দুয়েক আগে বড়বাজার এলাকায় অভিযান চলার পরে তা এখন কিছুটা বন্ধ হয়েছে। আর শহর থেকে সরে গিয়ে নদিয়া, বনগাঁর মতো বিভিন্ন সীমান্তবর্তী জেলার প্রত্যন্ত এলাকায় চলছে সেই কাজ। ধরপাকড়ের খবর মিললেই যেখান থেকে বাংলাদেশে গিয়ে গা ঢাকা দিচ্ছে জালিয়াতির কুশীলবরা।

জাল ওষুধের কারবার নতুন নয়। তবে করোনা পরবর্তী সময়ে রমরমা বেড়েছে, দাবি ড্রাগ কন্ট্রোলের কর্তা ও ব্যবসায়ীদের। আগে যেখানে নামী সংস্থার ওষুধ ০.২% জাল হত, এখন তা ২০ থেকে ২২ শতাংশে পৌঁছেছে। প্যারাসিটামল, অ্যান্টিবায়োটিক, রক্তচাপ, সুগার, গ্যাসের ওষুধের মতো যেগুলির চাহিদা প্রতিনিয়ত রয়েছে, সেগুলি জাল হচ্ছে বেশি। মূলত ভিন্ রাজ্য থেকে নির্দিষ্ট পথে কলকাতায় পৌঁছচ্ছে নকল ওষুধ।

এ রাজ্যে জাল ওষুধ পৌঁছনোর জন্য মূলত দু’-তিনটি পথ রয়েছে। বিভিন্ন রাজ্যে তৈরি জাল বা মেয়াদের তারিখ বদল করা ওষুধ প্রথমে আসে দিল্লিতে। সেখান থেকে পটনা হয়ে কাটিহার-মালদা রুটে শিলিগুড়িতে। এর পরে দূরপাল্লার বাসের ছাদে চাপিয়ে তা পাঠানো হয় কলকাতায়। আবার, দিল্লি থেকে উত্তরপ্রদেশ হয়ে ছত্তীসগঢ়ে ঢোকে ওষুধ। সেখান থেকে ঝাড়খণ্ড এবং ওড়িশা হয়ে বাসরুটে আসে শহরে। এ ছাড়াও ঝাড়খণ্ড থেকে আসানসোল কিংবা ধানবাদ হয়ে পুরুলিয়াতে পৌঁছনো ওষুধ বাসে চেপেই পৌঁছয় কলকাতায়। তবে এই ওষুধ পাঠানোয় কোনও ভাবেই রেলপথ ব্যবহার করা হয় না।

সম্প্রতি জাল ওষুধের তদন্তে নেমে রাজ্য ড্রাগ কন্ট্রোল জানতে পেরেছে, রাতের বাসে চেপে জাল ওষুধের বস্তা ভোরে এসে নামত বাবুঘাটের বাস টার্মিনাসে। সেখানে কিছু বেশি ভাড়া দিয়ে নির্দিষ্ট ট্যাক্সি ও ভ্যান-রিকশায় চাপিয়ে তা পৌঁছে দেওয়া হত বড়বাজারে পাইকারি ওষুধের দোকানে। সূত্রের খবর, ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকটি বেসরকারি পরিবহণ সংস্থার নাম পেয়েছে ড্রাগ কন্ট্রোল। তবে তৎপরতা শুরুর পরে, বাবুঘাটে ওষুধের বস্তা আসা আপাতত বন্ধ হয়েছে। তদন্তকারীরা বলছেন, এখন রাতেই জাতীয় সড়কের ধারে কোথাও সেই বস্তা নামিয়ে ছোট গাড়িতে নিয়ে আসা হচ্ছে।

কিন্তু শুধুই কি আন্তঃরাজ্য? কেন্দ্রীয় ড্রাগ কন্ট্রোল সূত্রের দাবি, জাল ওষুধ ঢুকছে অন্য দেশ থেকেও। সম্প্রতি ভবানীপুরের একটি পাইকারি গুদামে হানা দিয়ে প্রায় সাড়ে ৬ কোটি টাকার ক্যানসারের ওষুধ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। তদন্তে জানা গিয়েছে, ভিন্ দেশ থেকে ওই ওষুধ বাংলাদেশ হয়ে পৌঁছেছে এ রাজ্যে। তদন্ত এখনও চলছে বলে জানাচ্ছে ‘সেন্ট্রাল ড্রাগস স্ট্যান্ডার্ড কন্ট্রোল অর্গানাইজেশন’ (সিডিএসসিও)।

প্রশ্ন হল, কী ভাবে জাল ওষুধের চক্র দেশ এবং রাজ্যের সীমানা পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে?

(চলবে)

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Fake Medicines Investigation Nail Polish Nail Polish Remover

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy