Advertisement
E-Paper

বোমা-বাজির চাপানউতোর নিয়েই দিনভর উত্তপ্ত পিংলা

বাজি না বোমা—ঠিক কী ফেটে হয়েছিল তুলকালাম, বিস্ফোরণের ২৪ ঘণ্টা পরেও তার জবাব পেল না ব্রাহ্মণবাড়। উল্টে, পিংলা-বিস্ফোরণের কারণ নিয়ে প্রশাসন আর বিরোধীদের চাপান-উতোর শুক্রবার এলাকার রাজনৈতিক উত্তাপ কমতে দিল না। তেতে রইল রাজ্য রাজনীতিও। বুধবার রাতে ব্রাহ্মণবাড় গ্রামের অবৈধ বাজি কারখানায় বিস্ফোরণে প্রাণ গিয়েছে ১২ জনের। চার জন গুরুতর জখম। মৃত ও জখমদের অধিকাংশই আবার নাবালক। অথচ, ঠিক কী থেকে আগুন লেগেছিল এ দিন তা স্পষ্ট করে জানাতে পারেননি সিআইডি-কর্তারা। পশ্চিম মেদিনীপুরের অন্যত্র যে সব বেআইনি বাজি কারখানা রয়েছে, সেখানে কোনও অভিযান হয়নি।

সুমন ঘোষ ও দেবমাল্য বাগচী

শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০১৫ ০৩:২৮
পিংলার বিস্ফোরণে জখম জহিরুদ্দিন শেখকে জল খাওয়াচ্ছেন মা শিরিনা বিবি। শুক্রবার সৌমেশ্বর মণ্ডলের তোলা ছবি।

পিংলার বিস্ফোরণে জখম জহিরুদ্দিন শেখকে জল খাওয়াচ্ছেন মা শিরিনা বিবি। শুক্রবার সৌমেশ্বর মণ্ডলের তোলা ছবি।

বাজি না বোমা—ঠিক কী ফেটে হয়েছিল তুলকালাম, বিস্ফোরণের ২৪ ঘণ্টা পরেও তার জবাব পেল না ব্রাহ্মণবাড়। উল্টে, পিংলা-বিস্ফোরণের কারণ নিয়ে প্রশাসন আর বিরোধীদের চাপান-উতোর শুক্রবার এলাকার রাজনৈতিক উত্তাপ কমতে দিল না। তেতে রইল রাজ্য রাজনীতিও।

বুধবার রাতে ব্রাহ্মণবাড় গ্রামের অবৈধ বাজি কারখানায় বিস্ফোরণে প্রাণ গিয়েছে ১২ জনের। চার জন গুরুতর জখম। মৃত ও জখমদের অধিকাংশই আবার নাবালক। অথচ, ঠিক কী থেকে আগুন লেগেছিল এ দিন তা স্পষ্ট করে জানাতে পারেননি সিআইডি-কর্তারা। পশ্চিম মেদিনীপুরের অন্যত্র যে সব বেআইনি বাজি কারখানা রয়েছে, সেখানে কোনও অভিযান হয়নি। বিকেলের দিকে পিংলা থানার ওসি-কে সাসপেন্ড করে ‘ক্লোজ’ করার খবর মেলে। তবে প্রশাসন সূত্রেই জানা গিয়েছে, সে ‘ব্যবস্থা’ ব্রাহ্মণবাড়ের বাজি-কারখানার খবর জেনেও পদক্ষেপ না করার অভিযোগে নয়, এলাকা সম্পর্কে ‘সম্যক ধারণা’ না থাকায়। পিংলা থানারই তেগেরিয়া গ্রামে এ দিন একটি বাজি কারখানার সন্ধান মিলেছে। ওই কারখানার মালিক পরেশ ঘোড়ুইয়ের সঙ্গে এক সময়ে চেনাজানা ছিল ব্রাহ্মণবাড়ের বিস্ফোরণে মৃত রামপদ মাইতির। পরেশের পরিবারের দাবি, পেটের দায়েই তাঁরা এই কাজ করেন।

ব্রাহ্মণবাড়ের ওই কারখানায় শুধুই বাজি তৈরি হত, মারণ-বোমা নয়— এ দিন এমনই দাবি করেছে পুলিশ-প্রশাসন। তবে এলাকাবাসীর একটা বড় অংশ এখনও বলছেন, ‘‘বাজির নামে বোমা বাঁধা হতো ওই কারখানায়। না হলে কারখানাটা ঘিরে অত ঢাক-ঢাক গুড়গুড় করত কেন বিস্ফোরণ কাণ্ডে মূল অভিযুক্ত রঞ্জন মাইতি?’’ ঘটনাচক্রে তৃণমূল প্রভাবিত বাজি প্রস্তুতকারকদের সংগঠন ‘সারা বাংলা আতসবাজি উন্নয়ন সমিতি’ও বাজি-তত্ত্ব খারিজ করছে। সংগঠনের চেয়ারম্যান বাবলা রায় এ দিন কলকাতায় সাংবাদিক বৈঠক করে বলেন, ‘‘পিংলার ঘটনায় মুখ্যমন্ত্রীকে বিভ্রান্তকর তথ্য দিচ্ছে স্থানীয় পুলিশ ও প্রশাসন। ওখানে বিয়ের আতসবাজি নয়, শক্তিশালী বোমাই তৈরি করা হচ্ছিল বলে ঘটনাস্থলে গিয়ে আমার মনে হয়েছে।’’ এই সব সূত্র ধরেই বিরোধীদের কেউ আদালতের নজরদারিতে কেন্দ্রীয় সংস্থার মাধ্যমে এই বিস্ফোরণ-কাণ্ডের তদন্তের দাবি তুলেছেন, আবার কেউ বলেছেন, আজ, শনিবার রাজ্যে এলেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর হস্তক্ষেপ চাইবেন।

বিস্ফোরণস্থলে এ দিন বেলা ১১টা নাগাদ পৌঁছন এডিজি সিআইডি রাজীব কুমার, ডিআইজি সিআইডি (অপারেশনস) দিলীপ আদক, আইজি (পশ্চিমাঞ্চল) সিদ্ধিনাথ গুপ্ত, আইবি-র স্পেশ্যাল সুপারিন্টেনডেন্ট সুগত সেন। আগে থেকেই সেখানে ছিলেন জেলার পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষ। প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে বিস্ফোরণস্থল পরিদর্শনের পরে দিলীপবাবু বলেন, ‘‘এখানে অ্যালুমিনিয়ম গুঁড়ো আর কিছু স্টোনচিপস্‌ মিলেছে। তা ফুলঝুরি, রংমশাল আর ছোট আলু বোমা তৈরিতে ব্যবহার হত বলেই মনে হচ্ছে। কোনও স্‌প্লিন্টার পাওয়া যায়নি, যা দিয়ে মারণ-বোমা তৈরি হতে পারে।’’ কী থেকে আগুন লেগেছিল? সিআইডি-কর্তার জবাব, ‘‘আমরা দেখছি।’’ শুধু সাধারণ বাজির কারখানায় এই মাত্রার বিস্ফোরণ কী সম্ভব, যেখানে ঘটনাস্থল থেকে বেশ কিছুটা দূরে গাছের ডালপালা পর্যন্ত ছিটকে গিয়েছে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ? দিলীপবাবুর জবাব, ‘‘এখনও পর্যন্ত এ তথ্যই পেয়েছি। ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞেরা নমুনা সংগ্রহ করেছেন। সেই রিপোর্ট পেলেই এ ব্যাপারে বিস্তারিত বোঝা যাবে।’’

বিরোধীরা অবশ্য সিআইডির এই বাজি-তত্ত্বে আদৌ সন্তুষ্ট নয়। এ দিন ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর রাজ্যের বিরোধী দলনেতা তথা সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, ‘‘সিআইডি-তে ভরসা নেই। ওটা আসলে ‘চিফ মিনিস্টারস্‌ ইনভেস্টিগেশন ব্যুরো’। ওঁরা বলছেন, এখানে ফুলঝুরি তৈরি হতো। কেমন ফুলঝুরি তো দেখতেই পাচ্ছি যা ১২ জনের প্রাণ নিয়ে নেয়।’’ সূর্যবাবুকে ঘিরে ক্ষোভের কথা জানান গ্রামবাসীরাও। অভিযোগ করেন, পুলিশ বেআইনি কারখানার কথা জেনেও কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। তাঁদের আরও অভিযোগ মৃতের সংখ্যা কমিয়ে বলা হচ্ছে। সূর্যবাবু বলেন, ‘‘গ্রামবাসীরা বলেছেন মৃতের সংখ্যা ২০ বা তারও বেশি হতে পারে। এই পরিস্থিতিতে রাজ্য বা কেন্দ্র যে সংস্থাই তদন্ত করুক না কেন, তা যেন আদালতের নজরদারিতে হয়।’’ এ দিন পিংলার মুণ্ডমারিতে সভাও করেন সূর্যবাবু। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে তিনি বলেন, ‘‘হিম্মত থাকে তো কালই এলাকায় আসুন। মানুষের ক্ষোভের কথা শুনুন।’’ তৃণমূল সূত্রে খবর, স্থানীয় সাংসদ হিসেবে দেব ইতিমধ্যে ঘটনাস্থলে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। তবে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের তরফে তাঁকে বোঝানো হয়েছে, বিষয়টি প্রশাসনিক। প্রশাসনই দেখছে। এই মুহূর্তে পিংলায় যাওয়ার দরকার নেই।

ব্রাহ্মণবাড়ে গিয়ে এ দিনই বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহও দাবি করেন, ‘‘খাগড়াগড়ের মতো এ ক্ষেত্রেও প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা করছে সিআইডি ও পুলিশ। ওদের উপরে আস্থা রাখা যায় না।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘স্থানীয় বাসিন্দারা বিস্ফোরণের ঘটনায় এনআইএ (জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা) তদন্তের দাবি করেছেন। প্রধানমন্ত্রী রাজ্যে আসছেন। তাঁর কাছে এ দাবি জানাব।’’ রাতে রাহুলবাবু এ বিষয়ে রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠীকেও চিঠি পাঠিয়েছেন বলে দাবি করেছে বিজেপি। এনআইএ তদন্তের দাবি তুলছে কংগ্রেসও। জেলারই বিধায়ক তথা প্রদেশ কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়া বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, বিয়েবাড়ির বাজি তৈরি হচ্ছিল। বিয়েবাড়ির বাজিতে কখনও এমন হয়? এ সব অহেতুক মন্তব্য না করে মুখ্যমন্ত্রীর উচিত অবিলম্বে তদন্তের জন্য এনআইএ-কে আহ্বান জানানো।’’ পুলিশ-প্রশাসনের ‘ভূমিকা’র প্রতিবাদে আজ, শনিবার ১২ ঘণ্টা পিংলা বন্‌ধের ডাক দিয়েছে এসইউসি। এ দিন ব্রাহ্মণবাড়ে গিয়েছিলেন বহিষ্কৃত সিপিএম নেতা রেজ্জাক মোল্লাও।

ব্রাহ্মণবাড়ে বৃহস্পতিবারই গিয়েছিলেন জানিয়ে ‘আতসবাজি উন্নয়ন সমিতি’র নেতা বাবলাবাবু এ দিন দাবি করেন, বিস্ফোরণস্থলে অ্যামোনিয়া পাউডার (অ্যামোনিয়া নাইট্রেট) ও নাইট্রো-গ্লিসারিনের খালি ড্রাম দেখেছেন। বিস্ফোরণের তীব্রতা বাড়াতে এই সব রাসায়নিক কাজে লাগে, সাধারণ আতসবাজি তৈরি করতে নয়। তাঁর আর এক দাবি, পিংলা-সহ পশ্চিম মেদিনীপুরের একাধিক অবৈধ বাজি কারখানায় যে এ ধরনের বিস্ফোরক জমা করা হচ্ছে তা বছর দু’য়েক আগে সংশ্লিষ্ট থানা ও মুখ্যমন্ত্রীকে লিখিত ভাবে জানিয়েছিলেন।

পিংলা থানার পুলিশ অবশ্য এ দিনও দাবি করেছে, এমন কোনও তথ্য তাদের জানা ছিল না। পুলিশের রুজু করা মামলার অভিযোগপত্রে শুধু মানা হয়েছে, কারখানাটি বেআইনি। দুর্ঘটনা মোকাবিলারও ব্যবস্থা ছিল না সেখানে। তবে ব্রাহ্মণবাড়ের বাসিন্দারা কিন্তু জোরের সঙ্গেই বলছেন, রঞ্জন ও রামপদ মাইতি মিলে ওই কারখানায় বোমা বানাত। তাঁদের কথায়, ‘‘আমাদের ওই কারখানার ত্রিসীমানায় যেতে দিত না রাম-রঞ্জন। হুমকি দিত। পুলিশকে বারবার জানিয়েছি। লাভ হয়নি।’’

বাজি-তত্ত্বের প্রতিবাদ এসেছে অন্যত্র থেকেও। মেদিনীপুর মেডিক্যাল সূত্রের খবর, ব্রাহ্মণবাড় থেকে ময়নাতদন্তে আসা কিছু দেহে স্‌প্লিন্টার মিলেছে। বিকেলে জখমদের দেখতে মেদিনীপুর মেডিক্যালে এসে বিজেপির রাজ্য সহ-সভাপতি সুভাষ সরকারও বলেন, ‘‘ডাক্তার হিসেবে বলছি, খোকন মাঝি নামে এক জনের দেহে স্‌প্লিন্টারের আঘাত রয়েছে।’’

পিংলার বিস্ফোরণ-কাণ্ডে এ দিনই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলা করার আবেদন জানানো হয়েছে কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুরের ডিভিশন বেঞ্চে। ওই আবেদন জানিয়েছেন হাইকোর্টের আইনজীবী রবিশঙ্কর চট্টোপাধ্যায়। প্রধান বিচারপতি ওই আইনজীবীকে এ নিয়ে আবেদন করতে বলেন। আবেদন জানানো হলে তিনি তা গ্রহণ করবেন এবং আবেদন শুনবেন বলেও জানিয়েছেন। মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআর আবার পিংলার ঘটনার পরে পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষের অপসারণ দাবি করেছে।

মেদিনীপুর জেলা আদালতে এ দিন দুপুরে হাজির করা হয়েছিল বিস্ফোরণ-কাণ্ডে ধৃত রঞ্জন মাইতিকে। তাঁর বিরুদ্ধে বিস্ফোরক আইন, অনিচ্ছাকৃত খুন-সহ মোট ৯টি ধারায় মামলা রুজু করেছে পুলিশ। মেদিনীপুরের সিজেএম মঞ্জুশ্রী মণ্ডল এ দিন রঞ্জনকে ১৪ দিন পুলিশ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন।

রঞ্জন এলাকায় দাপুটে তৃণমূল নেতা ছিলেন বলেই পুলিশ ব্রাহ্মণবাড়ে কারখানা বন্ধে উদ্যোগী হয়নি বলে গ্রামবাসীরা এ দিনও ফের অভিযোগ করেছেন। দাবি করেছেন, বৃহস্পতিবার রাতে গাড়িতে চেপে পুলিশ এসে রঞ্জনের বাড়ি থেকে কিছু জিনিস নিয়ে যায়। কিছু বস্তা ফেলে দিয়ে যায় পাশের পুকুরে। রঞ্জনের বোন দেবকী মাইতি অবশ্য বলেন, ‘‘আমাদের বাড়িতে কেউ আসেনি। দাদা তো ওই জমিটা কারখানার জন্য ভাড়া দিয়েছিল। এর বেশি আর কিছু জানি না।’’

abpnewsletters suman ghosh devmalya bagchi pingla misnapore trinamool tmc surya kanta mishra bjp rahul sinha
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy