এক পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের পরে কেটে গিয়েছে দু’মাস। এ বার আর এক পরীক্ষার প্রশ্নের প্যাকেট হারিয়ে যাওয়ায় পরীক্ষাটিই স্থগিত হয়ে গেল। কিন্তু দু’মাস আগের সেই আইটিআই প্রবেশিকার প্রশ্ন ফাঁসের তদন্ত এখনও তেমন সাফল্যের মুখ দেখেনি। খোদ মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে সিআইডি তদন্তে নামলেও মূল অভিযুক্ত নাগালের বাইরেই রয়ে গিয়েছে।
সিআইডি-সূত্রের খবর: আইটিআই প্রশ্ন ফাঁস কেলেঙ্কারিতে এ পর্যন্ত যে সাত জন ধরা পড়েছে, তাদের সকলের সঙ্গে শাসকদলের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ।
এমতাবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, শাসকদলের একাংশের চাপে কি মূল অভিযুক্তকে গ্রেফতারের চেষ্টায় ঢিলে দেওয়া হচ্ছে?
সিআইডি’র তরফে অভিযোগ অস্বীকার করা হলেও পুলিশেরই কারও কারও অনুমান, ওই ব্যক্তি ধরা পড়লে আরও বড় চক্রের চেহারা বেরিয়ে পড়বে বুঝেই তদন্তের গতিতে রাশ পরানো হচ্ছে। প্রশ্ন ফাঁসের জন্য আঙুল মূলত যার দিকে, সে হুগলি আইটিআইয়ের এক কর্মী-নেতা। সিআইডি-কর্তাদের দাবি, তার খোঁজে জোরদার তল্লাশি চলছে।
রাজ্যে এ বছর আইটিআই প্রবেশিকা হওয়ার কথা ছিল ২৮ জুন। পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল প্রায় ১ লক্ষ ১১ হাজার।
২৮ জুন সকালে সংবাদমাধ্যমে জানা যায়, প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে গিয়েছে। পরীক্ষা স্থগিত করে দেওয়া হয়। আইটিআই প্রবেশিকা শেষ পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে ৫ জুলাই। তবে প্রশ্ন ফাঁস ঘিরে শোরগোল কম হয়নি। যার জেরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সিআইডি-কে তদন্তের দায়িত্ব দেন।
সিআইডি এ পর্যন্ত কী করেছে?
গোয়েন্দা-সূত্রের খবর: তদন্তে নেমে প্রথমে ধরা হয় কল্যাণী আইটিআইয়ের দুই ছাত্রকে— অর্জিত দাস ও তুহিন দাস। গ্রেফতার হয় বাপ্পা পাইন নামে স্থানীয় এক তৃণমূল নেতাও। ওদের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে রানাঘাটে জালে ফেলা হয় আর এক অভিযুক্ত সৌমিত্র মজুমদারকে। ধৃতদের মুখে জানা যায়, অর্জিত-তুহিনের হাতে প্রশ্ন-সহ উত্তরপত্র তুলে দিয়েছিল বাপ্পা ও সৌমিত্র, প্রতিটি আট হাজার টাকা ‘দরে।’ লেনদেন হয়েছিল কল্যাণীর এক হোটেলে বসে।
সিআইডি’র দাবি: এর পরে অগস্টের গোড়ায় গোপন সূত্রে খবর মেলে, হুগলি আইটিআইয়ের তিন নৈশরক্ষীও অপরাধে জড়িত। গ্রেফতার হয় তিন জনই— রোশন সিংহ, সোমনাথ দাস ও দীপক প্রসাদ। গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, ওরা তৃণমূলকর্মী হিসেবে পরিচিত। শুধু তা-ই নয়, রোশন হুগলি আইটিআইয়ে তৃণমূল পরিচালিত ছাত্র সংসদের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক (জিএস)-ও বটে।
গোয়েন্দাদের দাবি, রোশনের বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে বেআইনি আগ্নেয়াস্ত্রের হদিস মিলেছে। এবং অভিযোগ, নৈশরক্ষীরাই ছিল প্রশ্নপত্রের জোগানদার।
কিন্তু ওদের কাছে প্রশ্নপত্র পৌঁছাল কী ভাবে?
সিআইডি-র দাবি, রোশনরা জেরায় স্বীকার করেছে, হুগলি আইটিআইয়ের এক কর্মী-নেতা ২৬ জুন রাতে প্রবেশিকার প্রশ্ন তাদের হাতে তুলে দিয়েছিল। গোয়েন্দাদের অনুমান, ওই ব্যক্তিই চক্রের মূল হোতা। বিপদ আঁচ করে সে গা ঢাকা দিতে দেরি করেনি।
সিআইডি-সূত্রের খবর, কল্যাণীর দুই ছাত্রের ভূমিকার প্রেক্ষাপটে প্রথমে মনে করা হয়েছিল, নদিয়া থেকে প্রশ্ন বেরিয়েছে। পরে বোঝা যায়, উৎস হল হুগলি। ঘটনাচক্রে টেটের প্রশ্ন লোপাট-কাণ্ডেরও কেন্দ্রে সেই হুগলি জেলা! দুয়ের কোনও যোগসূত্র আছে কি না, তা যাচাই করা হবে বলে শুক্রবার জানিয়েছেন এক সিআইডি-কর্তা।
তবে সিআইডি জানিয়েছে, কল্যাণীর হোটেলে হাতবদল হওয়া উত্তরপত্রগুলো ছাপা হয়েছিল নদিয়াতেই— বগুলার এক ছাপাখানায়। কিন্তু কে বা কারা সেগুলো ছাপতে দিয়েছিল, সে ব্যাপারে তদন্তকারীরা অন্ধকারে। কত পেশাদারি দক্ষতায় পুরো চক্রটি চলত, তার আন্দাজ অবশ্য ওঁরা পেয়েছেন।
কী রকম?
গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, মার্কেটিং এজেন্টের মতো এক-দু’জন করে লোক বহাল করা হয়েছিল প্রতি জেলায়। প্রশ্ন পেয়ে দ্রুত উত্তর ছাপিয়ে বিলি-বন্দোবস্ত করা ছিল তাদের কাজ।
তদন্তকারীদের দাবি, রাজ্যের প্রায় চল্লিশটি ‘সেন্টার’ থেকে উত্তরপত্র বিক্রি হয়েছিল, যার একটি হল কল্যাণীর ওই হোটেল। কিন্তু হুগলির রোশন-সোমনাথদের সঙ্গে নদিয়ার বাপ্পাদের যোগাযোগ কী ভাবে হল, সিআইডি’র কাছে তার স্পষ্ট উত্তর এই মুহূর্তে নেই।
ধোঁয়াশা কি কাটবে না?
মূল অভিযুক্ত ধরা না-পড়লেও গোয়েন্দারা আশাবাদী। এক সিআইডি-কর্তা এ দিন বলেন, ‘‘তদন্ত প্রায় শেষ। আগামী মাসেই চার্জশিট পেশ হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy