Advertisement
১১ জুন ২০২৪

রাজ্যে ৩,৪০০ কোটি টাকা লগ্নির প্রতিশ্রুতি জিন্দলদের

বিজয়া দশমীর রেশ মেলানোর আগেই বিনিয়োগের মিষ্টিমুখ! দীপাবলির আগাম উপহার হিসেবে জিন্দল গোষ্ঠীর কাছ থেকে ৩,৪০০ কোটি টাকার লগ্নি-প্রতিশ্রুতি পেল রাজ্য।

নবান্নে সাংবাদিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী ও সজ্জন জিন্দল। ছবি: সুদীপ আচার্য।

নবান্নে সাংবাদিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী ও সজ্জন জিন্দল। ছবি: সুদীপ আচার্য।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০১৬ ০৩:২০
Share: Save:

বিজয়া দশমীর রেশ মেলানোর আগেই বিনিয়োগের মিষ্টিমুখ! দীপাবলির আগাম উপহার হিসেবে জিন্দল গোষ্ঠীর কাছ থেকে ৩,৪০০ কোটি টাকার লগ্নি-প্রতিশ্রুতি পেল রাজ্য।

মঙ্গলবার নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে এক ঘণ্টা কথা বলেন শিল্প গোষ্ঠী জেএসডব্লিউ-এর কর্ণধার সজ্জন জিন্দল। বৈঠক শেষে রং কারখানা ও ইস্পাতের অনুসারী শিল্প গড়তে যথাক্রমে ১,৫০০ ও ১,০০০ কোটি টাকা ঢালার কথা ঘোষণা করেন তিনি। সঙ্গে জানান, নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি এবং সিমেন্ট কারখানা সম্প্রসারণের জন্য ২০০ ও ৭০০ কোটি টাকা ঢালার কথা। সব মিলিয়ে ১,১০০ কোটি ডলারের (প্রায় ৭৪ হাজার কোটি টাকা) এই শিল্প গোষ্ঠীর বিনিয়োগের অঙ্ক দাঁড়াবে ৩,৪০০ কোটি টাকা।

শালবনিতে এই লগ্নি প্রস্তাবের দৌলতে ৪ হাজার জনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা তৈরি হল। শুধু তা-ই নয়, সামাজিক দায়বদ্ধতা প্রকল্পের অংশ হিসেবে ২৯৪ একর জমিতে সমবায় কৃষির জন্য পুঁজি ঢালারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন জিন্দল। যেখানে প্রযু্ক্তি ও প্রশিক্ষণ সংস্থা জোগালেও লাভের কড়ি যাবে চাষিদের হাতে। পুরো প্রস্তাবে খুশি মমতার কথায়, ‘‘শুভ বিজয়ার পরে শুভ মিষ্টি।’’ তাঁর দাবি, জিন্দলদের বিনিয়োগে রাজ্য যেমন উপকৃত হবে, তেমনই তা ভাল হবে দেশের অর্থনীতির পক্ষেও।

এ দিন মুখ্যমন্ত্রীকে পাশে রেখেই চার প্রকল্পে লগ্নির ঘোষণা করেছেন জিন্দল। বলেছেন, ‘‘সিমেন্ট কারখানার সম্প্রসারণে আরও ৭০০ কোটি বিনিয়োগ করছি। এ ছাড়াও ইস্পাতের অনুসারী শিল্প, বিদ্যুৎকেন্দ্র ও রং কারখানা তৈরি হবে। মোট ৩,৪০০ কোটি ঢালবে জেএসডব্লিউ।’’

দীর্ঘ চড়াই-উতরাই পেরিয়ে চলতি বছরের গোড়ায় রাজ্যে যাত্রা শুরু করেছে জিন্দল গোষ্ঠী। তাদের সিমেন্ট কারখানার শিলান্যাস করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। এ দিন জিন্দল জানান, সিমেন্ট প্রকল্পের কাজ ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। মার্চের মধ্যে উৎপাদন শুরু হবে। আরম্ভ হয়েছে বাকি প্রস্তাবিত প্রকল্পগুলির বিস্তারিত রিপোর্ট তৈরির কাজও। তিন বছরের মধ্যে প্রকল্পগুলি শেষ হবে বলেই তাঁর দাবি।

পরিকাঠামো ক্ষেত্রে বড় ভাবে ঢুকে পড়ার পরিকল্পনার কথা সম্প্রতি একাধিক বার বলেছেন জিন্দলরা। এ দিন সিমেন্ট, রং এবং ইস্পাতের অনুসারী শিল্পে লগ্নির ঘোষণা সেই লক্ষ্যেই পা ফেলার ইঙ্গিত। তা ছাড়া, এ বছর জানুয়ারিতে জিন্দলরা জানিয়েছিলেন, রং ব্যবসায় পা ফেলতে চান তাঁরা। সংস্থা নিজেই রংয়ের প্রলেপ দেওয়া ইস্পাত (কালার কোটেড স্টিল) তৈরি করে। ফলে রং ব্যবসায় নামলে তা সংস্থার নিজস্ব চাহিদা মেটাতে কাজে আসবে। বাজারেও রংয়ের চাহিদা বাড়ছে। এ ছাড়া, রং ব্যবসার সঙ্গে জিন্দল পরিবারের যোগ আগে থেকেই রয়েছে। সজ্জন জিন্দলের ছোট ভাই রতন জিন্দল শালিমার পেন্টসের প্রোমোটার। তবে গত জানুয়ারিতেই সজ্জন জিন্দলের ছেলে পার্থ শালিমারের সঙ্গে কোনও রকম হাত মেলানোর সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছেন।

বাম আমলে ইস্পাত প্রকল্প গড়ার জন্য জিন্দল গোষ্ঠীর দরকার ছিল ৪,৩৩৪ একর জমি। এর মধ্যে ২৯৪ একর তারা সরাসরি চাষিদের কাছ থেকে কিনেছিল। কিন্তু দীর্ঘ টানাপড়েনের পরে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে ওই ২৯৪ একর জমি তারা বিনা পয়সায় চাষিদের ফিরিয়ে দেওয়ার কথা জানায়। জিন্দলদের বিনিয়োগ প্রস্তাবে মুখ্যমন্ত্রী স্বাভাবিক ভাবেই খুশি। কিন্তু তাঁর কাছ থেকে জিন্দলরা এ দিন বাড়তি প্রশংসা আদায় করে নেয়, ওই জমি ফেরতের ইচ্ছের জন্য। মমতা বলেন, ‘‘প্রকল্প শুরু করতে দেরি হওয়ার কারণে অসন্তোষ প্রকাশ করছিলেন জমিহারা মানুষ। তখন জিন্দলরা জমি ফেরানোর প্রস্তাব দেন। একমাত্র সংস্থা, যারা চাষিদের জমি ফেরাতে চেয়েছে।’’ মুখ্যমন্ত্রী বলেন, পরে চাষিরাই আবার কাজের দাবি জানান। তা মাথায় রেখে জিন্দলরা সমবায় কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তুলবেন। কৃষি দফতরও এই প্রকল্পের সঙ্গে থাকবে। জিন্দলও বলেন, ‘‘রাজ্যে লগ্নির পরিবেশ ভাল। মুখ্যমন্ত্রী, প্রশাসনের কাছে সব রকম সহায়তা পেয়েছি।’’

বাম জমানায় দেওয়া প্রস্তাবে প্রথমে বছরে এক কোটি টন ইস্পাত উৎপাদনের কারখানা গড়ার কথা বলেছিল জিন্দল গোষ্ঠী। তখন স্থানীয়দের প্রশিক্ষণ ও চাকরি দেওয়া ছাড়াও প্রকল্পের শেয়ার বা অংশীদারি দেওয়ার কথা বলেছিল তারা। শেয়ার দিয়ে স্থানীয়দের প্রকল্পের শরিক করে নেওয়ার প্রস্তাব সেই প্রথম। কিন্তু রাজ্যে আকরিক লোহার অভাব ও সারা বিশ্বে ইস্পাতের বাজার খারাপ হওয়ায় ৩৫ হাজার কোটি টাকার সেই প্রকল্প এখন স্থগিত। তাই সেখানে অংশীদারি দেওয়ার মডেল আলোর মুখ দেখেনি। এ দিনও জিন্দল জানান, তাঁর বাবার খুব ইচ্ছে ছিল এ রাজ্যে ইস্পাত প্রকল্প গড়ার। কিন্তু সংশ্লিষ্ট সূত্রে খবর, তা না-হওয়ায় স্থানীয়দের শেয়ার দেওয়া যায়নি। তাঁদের কথা মাথায় রেখে নতুন কর্মসূচি নিচ্ছে সংস্থা।

সামাজিক দায়বদ্ধতা প্রকল্পের আওতায় এ বার রাখা হচ্ছে সমবায় কৃষি। জিন্দল জানান, ২৯৪ একরে সমবায় চাষ হবে। প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ দেবে সংস্থা। ফসল ঘরে তুলে লাভের টাকা গুনবেন জমির মালিকরা। এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর আর্জি, স্থানীয়দের অন্যান্য প্রশিক্ষণও দিক সংস্থা।

বাম জমানায় রাজ্যে লগ্নির প্রস্তাব দেওয়ার পর থেকেই বারবার বাধার মুখে পড়েছে জিন্দলদের প্রকল্প। ২০০৭ সালে রাজ্য ও জিন্দল গোষ্ঠীর মধ্যে সমঝোতাপত্র সই হয়। ২০০৮-এর ২ নভেম্বর প্রকল্পের শিলান্যাস করেন তত্কালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। কিন্তু তাকে ছাপিয়ে বড় খবর হয়ে ওঠে প্রস্তাবিত প্রকল্পের অদূরেই মাইন বিস্ফোরণের ঘটনা। এর পরে ২০০৯ সালে বিশ্বজোড়া মন্দার কারণে ইস্পাতের চাহিদায় ভাটা পড়ে। কঠিন হয়ে দাঁড়ায় প্রকল্পের জন্য ব্যাঙ্ক-ঋণ পাওয়া।

এর পরে সামনে আসে জমি ঘিরে জটিলতা। প্রকল্পের জন্য ২৯৪ একর সরাসরি কিনেছিল সংস্থা। জমির ঊর্ধ্বসীমা আইন অনুযায়ী শিল্পের জন্য বাড়তি জমি রাখতে ১৪-ওয়াই ধারায় আবেদন করে ভূমি দফতরের অনুমোদন নেওয়া জরুরি। জিন্দলরা তা না-নেওয়ায় জমির লিজ চুক্তি আটকে যায়। শিল্প দফতরের হস্তক্ষেপে পরে সমস্যা মেটে।

এত রকম ঝঞ্ঝাট পেরিয়ে শেষমেশ এল জিন্দলদের এই লগ্নি-প্রতিশ্রুতি। শালবনি এতে স্বাভাবিক ভাবেই খুশি। কাজের সুযোগ তৈরি হওয়ার আশা আর সমবায় কৃষির প্রতিশ্রুতিতে কার্যত অকাল দীপাবলি সেখানে। প্রকল্প এলাকার সামনে এ দিন পটকা ফাটান জমিদাতাদের একাংশ। জ্বলে রংমশাল। জমিদাতা সংগঠনের নেতা পরিষ্কার মাহাতো বলেন, “দ্রুত প্রকল্পের কাজ এগোনো ও কর্মসংস্থানের আশ্বাস দিয়েছেন জিন্দলরা। এলাকার মানুষ খুশি। সেই কারণেই এই উদ্‌যাপন।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Jindal's JSW group investment West Bengal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE