E-Paper

সকলের প্রতিবাদই শক্তি আমাদের, লিখলেন আনন্দবাজার পত্রিকার সাংবাদিক দেবমাল্যের স্ত্রী

আমার শ্বশুরমশাইয়ের ৮২ বছর বয়স। চোখে অপারেশন হয়েছে। শাশুড়ি মা-ও ভয়ে থরথর। আমার দেড় বছরের মেয়েটা তখন ঘুমে কাদা।

অতসী বাগচী (দেবমাল্য বাগচীর স্ত্রী)

শেষ আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৫:২৬
জামিনে মুক্তির পরে বৃহস্পতিবার দেবমাল্য ও অতসী।

জামিনে মুক্তির পরে বৃহস্পতিবার দেবমাল্য ও অতসী। ছবি: বরুণ দে।

দুঃস্বপ্নের মতোই এসেছিল সেই মুহূর্তটা। ৬ সেপ্টেম্বর প্রায় ভোরে। হঠাৎ কলিংবেলে ধড়ফড়িয়ে উঠলাম। ঘড়ি দেখলাম, প্রায় ৪টে। বুকটা কেঁপে গেল।

দোতলা থেকে দেখলাম, বেশ কয়েক জনের জটলা সদর দরজায়। তবে পুলিশ পরিচয় দিলেন ওঁরা। আমার স্বামী, দেবমাল্য বাগচী খড়্গপুর শহরে আনন্দবাজারের সাংবাদিক। পুলিশের সঙ্গে চেনা-পরিচয় রয়েছে। ও পুলিশকর্মীদের সকালে আসতে বলল। জানাল, তার পরে যা কথা হওয়ার হবে। কিন্তু দরজা থেকে নড়ল না পুলিশ।

আমার শ্বশুরমশাইয়ের ৮২ বছর বয়স। চোখে অপারেশন হয়েছে। শাশুড়ি মা-ও ভয়ে থরথর। আমার দেড় বছরের মেয়েটা তখন ঘুমে কাদা। সবার কথা ভেবে আমিই ভিতর থেকে কলিংবেলটা বন্ধ করে দিলাম। তখন শুরু হল হাঁকডাক আর বাড়ির ভিতরে টর্চ ফেলা। কিন্তু তখনও আমি কিংবা দেবমাল্য বুঝতে পারছি না রাতদুপুরে বাড়িতে পুলিশ এল কেন!

সেটা বুঝলাম ভোরের আলো ফোটার পরে।

ফোন এল এলাকারই এক পরিবারের কাছ থেকে। জানলাম, একটি অভিযোগের ভিত্তিতে ওই পরিবারের বাসন্তী দাসকে ভোরেই গ্রেফতার করেছে পুলিশ। আর সেই মামলাতেই নাম রয়েছে দেবমাল্যের।

তত ক্ষণে ফোন শুরু করেছে দেবমাল্য। জানতে পারল কড়া ধারায় মামলা। গ্রেফতারের সম্ভাবনা রয়েছে। ৬ তারিখ সকাল ১০টা নাগাদ খড়্গপুর টাউন থানায় গেল দেবমাল্য। ভেবেছিলাম কথাবার্তাতেই সব মিটে যাবে। কিন্তু গ্রেফতার হবে, সত্যিই ভাবিনি।

গ্রেফতারের খবরটা পেলাম ওর সতীর্থ এক সাংবাদিকের থেকে। নিমেষে চারপাশ অন্ধকার। অথচ ঘরের সব জানলাই তখন খোলা।

তার পরের ৯টা দিন যে কী ভাবে কেটেছে, কখন সকাল গড়িয়ে রাত হয়েছে, সত্যি টের পাইনি। এই কোর্টে ছুটছি, তো এই জেলে, আবার পুলিশের কাছে। বাড়িতে দু’টো বুড়ো-বুড়ি। মেয়ের আবার জ্বর। ওর অনুপস্থিতিতে কী ভাবে যে কী করব, কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তবে এটা বুঝেছিলাম, সহধর্মিণী হিসেবে ওর পেশার প্রতি আমারও দায়বদ্ধতা রয়েছে, লড়াইটা আমারও। সেটাই আমাকে শক্তি জুগিয়ে চলেছে। আমি চাই, আমাদের মেয়েও দেখুক, ওর বাবার লড়াইটা।

কান্না আমার আসে না। তবে জেলে যে দিন প্রথম ওর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম, বাঁধ ভাঙল। মেদিনীপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে রেখেছিল দেবমাল্যকে। সেখানে আবাসিকদের সঙ্গে দেখা করার জায়গাটা খুপরির মতো। মাঝে দু’টো জালের ঘেরাটোপ। ও এসে দাঁড়াল। তবে মুখটা আবছা। কান্না দলা পাকিয়ে আসছিল। কিন্তু ওর সামনে তো ভেঙে পড়লে চলবে না। ও নিজেও আমাকে ভরসা জোগাচ্ছে তখন। বলল, ‘‘তুমি নাচের ক্লাসটা বন্ধ কোরো না।’’ বুঝতে পারলাম, দেবমাল্যও কান্না চাপছে।

বৃহস্পতিবার জামিন পেয়ে বাইরে বেরিয়েছে মানুষটা। আদালতের নির্দেশ মেনে চলছে এবং চলবেও। বুঝতে পারছি, লড়াইটা এখনও ফুরোয়নি। এ ক’দিনে যাঁরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে আমাদের পাশে থেকেছেন, দেবমাল্যর হয়ে গলা তুলেছেন, তাঁদের সবাইকে অকুণ্ঠ ধন্যবাদ। সকলের এই প্রতিবাদ, সহমর্মিতাই তো আমাদের শক্তি।

একটা কথা নিশ্চিত ভাবেই জানি, দেবমাল্য দোষী নয়। আইনের উপরে পূর্ণ আস্থা ছিল, আছে, থাকবেও। লম্বা লড়াই এটা। তবে জিতবে সত্য-ই।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Anandabazar Patrika arrest

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy