Advertisement
E-Paper

প্রশাসনের নিরপেক্ষ ভূমিকাই চাই, পার্থকে বললেন রাজ্যপাল

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় রাজ্য সরকারের ভূমিকা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করলেন রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী। তাঁর মতে, উপাচার্য এবং পড়ুয়াদের সংঘাতে সরকারের নিরপেক্ষ ভূমিকা নেওয়াই বাঞ্ছনীয়। একই সঙ্গে এই আন্দোলনের উৎস, ছাত্রী নিগ্রহের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের লোকেদের নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গড়ার ব্যাপারেও সরকারকে কার্যত চাপ দেন তিনি।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:০৭
নিগৃহীতার বাড়িতে পার্থ চট্টোপাধ্যায়। সঙ্গী শঙ্কুদেব পণ্ডা। রবিবার শৌভিক দে-র তোলা ছবি।

নিগৃহীতার বাড়িতে পার্থ চট্টোপাধ্যায়। সঙ্গী শঙ্কুদেব পণ্ডা। রবিবার শৌভিক দে-র তোলা ছবি।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় রাজ্য সরকারের ভূমিকা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করলেন রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী। তাঁর মতে, উপাচার্য এবং পড়ুয়াদের সংঘাতে সরকারের নিরপেক্ষ ভূমিকা নেওয়াই বাঞ্ছনীয়। একই সঙ্গে এই আন্দোলনের উৎস, ছাত্রী নিগ্রহের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের লোকেদের নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গড়ার ব্যাপারেও সরকারকে কার্যত চাপ দেন তিনি। তার পরেই শিক্ষামন্ত্রী এ দিন একটি পৃথক তদন্ত কমিটি গড়ার কথা ঘোষণা করেন।

রাজভবন সূত্রের খবর, রবিবার শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে ডেকে পাঠিয়েছিলেন রাজ্যপাল। সেখানেই তাঁর অভিমত ব্যক্ত করেন।

এ দিন বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ পার্থবাবু রাজভবনে যান। প্রায় দেড় ঘণ্টা রাজ্যপালের সঙ্গে তাঁর কথা হয়। কী কথা হয়েছে, সে ব্যাপারে পার্থবাবু অবশ্য মুখ খোলেননি। চেষ্টা করেও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। তবে তাঁর ঘনিষ্ঠ একটি সূত্রের দাবি, দুর্গাপুজোর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণের বিষয়ে তিনি কথা বলতে গিয়েছিলেন।

তবে রাজভবনের আধিকারিকদের একাংশের বক্তব্য পার্থবাবুর সঙ্গে রাজ্যপালের এ দিনের আলোচনার বড় অংশ জুড়ে ছিল যাদবপুর। রাজ্যপালই তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন। রাজভবনের খবর, সেখানেই তিনি শিক্ষামন্ত্রীকে বলেন, যাদবপুরে যা ঘটেছে, তা মূলত উপাচার্যের সঙ্গে ছাত্রদের সমস্যা। শিক্ষা দফতরের ভূমিকা সেখানে হওয়া উচিত নিরপেক্ষ। অনেকের মতে এই কথার মধ্যে দিয়ে রাজ্যপাল প্রকারান্তরে বুঝিয়ে দিয়েছেন, যাদবপুরের ঘটনায় সরকারের ভূমিকা নিরপেক্ষ ছিল কি না, সে ব্যাপারে তাঁর সংশয় আছে।

শনিবার মহামিছিলের পরে পড়ুয়াদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন রাজ্যপাল। তাদের দাবিদাওয়ার কথা শুনেছিলেন। তার পরে এ দিন শিক্ষামন্ত্রীকে ডেকে পাঠিয়ে রাজ্যপাল জানতে চেয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের কাউকে দিয়ে ছাত্রী-নিগ্রহের তদন্ত করাতে সরকারের অসুবিধা কোথায়? বিশ্ববিদ্যালয় গঠিত তদন্ত কমিটির কার্যকলাপ নিয়ে পড়ুয়াদের অসন্তোষ রয়েছে। তাঁরা চান, নিরপেক্ষ তদন্তের খাতিরে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের লোকজন নিয়ে কমিটি গড়া হোক। রাজভবন সূত্রের খবর, রাজ্যপাল এ দিন শিক্ষামন্ত্রীকে বলেন, “আপনি তো এক জন সংবেদনশীল মানুষ! রাজ্য সরকারও তো চায়, স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করতে। আপনাদের তো লুকনোর কিছু নেই! তা হলে পৃথক তদন্তের দাবি মানতে অসুবিধা কোথায়?”

ঘটনাচক্রে রাজ্যপালের সঙ্গে বৈঠকের পরেই এ দিন তড়িঘড়ি একটি তদন্ত কমিটি গড়ার কথা ঘোষণা করেছেন শিক্ষামন্ত্রী। কাদের নিয়ে তা গঠিত হবে, সে কথা অবশ্য জানাননি তিনি। প্রশাসনিক সূত্রের খবর, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেই পার্থবাবু সোমবার ওই কমিটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানাবেন। রবিবার তিনি শুধু বলেন, মুখ্যমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন একটি তদন্ত কমিটি গঠন করার। সেই নির্দেশ মেনে এবং নির্যাতিতা মেয়েটির পরিবারের আবেদনের ভিত্তিতে রাজ্য শিক্ষা দফতর তিন থেকে চার সদস্যের কমিটি গঠন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ৭২ ঘণ্টার মধ্যে শিক্ষা দফতরের হাতে তদন্ত-রিপোর্ট তুলে দিতে বলা হবে। এ দিনই পাথর্বাবু নির্যাতিতা মেয়েটির বাড়িতে গিয়ে তার পরিবারের সঙ্গে কথা বলেন।

১৬ সেপ্টেম্বর মধ্যরাতে ক্যাম্পাসে পুলিশ ঢোকার পরে ঠিক কী ঘটেছিল, সেটাও এ দিন ফের পার্থবাবুকে জিজ্ঞেস করেছেন রাজ্যপাল। লাঠি চলেছিল কি না, সে প্রশ্ন করেন তিনি। রাজভবন সূত্রের খবর, পার্থবাবু রাজ্যপালকে বলেছেন অল্প কিছু পুলিশের হাতে লাঠি থাকলেও, লাঠিচার্জ সে রাতে হয়নি। পড়ুয়াদের সরাতে গিয়ে কিছুটা ধস্তাধস্তি হয়েছে। রাজভবনের আধিকারিকরা জানাচ্ছেন, শনিবার পড়ুয়ারা রাজ্যপালকে যে ভিডিও ফুটেজ দিয়ে এসেছিলেন, তাতেও লাঠিচার্জের প্রমাণ সে ভাবে মেলেনি। তবে সে রাতে প্রশাসনের শীর্ষ স্তরের নির্দেশে কম্যান্ডো বাহিনী পাঠানো হয়েছিল বলে লালবাজার সূত্রে জানা গিয়েছে। জানা গিয়েছে, জঙ্গি দমনে দড় এই কম্যান্ডোদের লাঠির প্রয়োজন হয় না। খালি হাতেই তাঁরা তীব্র আঘাত করতে অভ্যস্ত।

তবে শনিবারের মহামিছিলের পরে এবং আজ, সোমবারের প্রস্তাবিত পাল্টা তৃণমূলী মিছিলের প্রাক্কালে রাজ্যপাল নিজে উদ্যোগী হয়ে শিক্ষামন্ত্রী তথা সরকারকে যে বার্তা দিলেন, তা যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করা হচ্ছে। একই ভাবে তাৎপর্যপূর্ণ হল যাদবপুরের নিগৃহীতা ছাত্রীর বাড়িতে শিক্ষামন্ত্রীর যাওয়া। এত দিন পরে কেন গেলেন, মহামিছিলের পরের দিনটিই কেন বেছে নিলেন এমন নানা প্রশ্ন স্বাভাবিক ভাবেই উঠছে। তৃণমূলের অন্দরেই এটাকে রাজনৈতিক কৌশল বলে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে।

অনেকে মনে করেন, এ ধরনের কোনও ঘটনার পরে সামাজিক আন্দোলন তীব্র হলে সরকার দুর্গতদের পাশে পৌঁছে ‘বোঝাপড়া’র চেষ্টা করে। ঠিক যেমন হয়েছিল কামদুনির বেলায়। আন্দোলন বেড়ে ওঠার পরে ধর্ষণে নিহত মেয়েটির পরিবারের সঙ্গে দেখা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। চাকরি-সহ বিভিন্ন সুযোগসুবিধা এগিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাঁদের দিকে। রবিবার শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেও যাদবপুরের নির্যাতিতার বাবা বলেছেন, মন্ত্রী সুবিচারের আশ্বাস দিয়েছেন।

রাজনৈতিক কৌশলেরই আর একটি অঙ্গ হল আজ, সোমবার তৃণমূলের শক্তি প্রদর্শনের পাল্টা মিছিল। নন্দীগ্রাম মহামিছিলের পরে একই ভাবে পাল্টা মিছিলের পথে গিয়েছিল বাম সরকার। এ বার যাদবপুরের হোককলরব-এর উত্তরে ফেসবুকে তৃণমূল সমর্থকদের আহ্বান হোকক্যালানো ও হোকগর্জন। ছাত্র সংগঠনের সভাপতি শঙ্কুদেব পণ্ডা ছাড়াও আরাবুল ইসলামের মতো ডাকাবুকো নেতারা জেলা স্তরে মিছিলের লোক জড়ো করতে সক্রিয় হয়েছেন বলে খবর।

যদিও তাতে লাভ কতটা হবে, তা নিয়ে তৃণমূলের অন্দরেই সংশয় রয়েছে। দলেরই একাংশ কবুল করছেন, শাসক দলের সংগঠনকে ব্যবহার করে জেলা থেকে লোক এনে শহর ভরিয়ে দেওয়া এমন কিছু কৃতিত্বের বিষয় নয়। কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ত অরাজনৈতিক মিছিলের সঙ্গে তা কখনওই তুলনীয় হতে পারে না।

এ দিকে এত দিন পরে মেয়েটির বাড়িতে পার্থবাবুর যাওয়া নিয়ে আন্দোলনকারী ছাত্রদের মধ্যে নানা প্রশ্ন দানা বাঁধছে। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, এটা কি আন্দোলন ভাঙার চাল? পড়ুয়াদের আন্দোলনের অন্যতম মুখ চিরঞ্জিত ঘোষ তবু প্রত্যয়ী, “চোরাগোপ্তা নানা ভাবেই আমাদের সংহতি ভাঙার চেষ্টা চলছে। আমরা আশাবাদী, ফাটল ধরবে না।” নির্যাতিতার বাবার গলা অবশ্য এ দিন কিছুটা আশাবাদী শুনিয়েছে। দু’দিন আগেই সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খুলে তাঁর মেয়ের প্রতি সহমর্মিতার জন্য যাদবপুরের সতীর্থ-বন্ধুদের অকুণ্ঠ ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন তিনি। এ দিন কিন্তু তিনি বলেন, “শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে যাদবপুরের আন্দোলন নিয়ে একটাও কথা হয়নি। আমিও কিছু বলিনি, উনিও না!” পার্থবাবুর সঙ্গে শঙ্কুর উপস্থিতি নিয়েও কথা বলেননি নির্যাতিতার বাবা। পড়ুয়াদের তরফে চিরঞ্জিত শুধু কটাক্ষ করেছেন, “বহিরাগতদের নিয়ে এত হইহল্লা করে শেষমেশ শঙ্কুকে সঙ্গে করেই শিক্ষামন্ত্রীকে যেতে হল!”

জানা গিয়েছে, রবিবার দুপুরে নিগৃহীতার বাড়িতে গিয়ে সুবিচারের আশ্বাস দিয়ে এসেছেন শিক্ষামন্ত্রী। তবে এ বিষয়েও পার্থবাবু বা শঙ্কু কেউই মুখ খুলতে চাননি। কিন্তু নির্যাতিতার বাবা জানিয়েছেন, মন্ত্রী তাঁদের বাড়িতে ২০-২৫ মিনিট ছিলেন। শিক্ষামন্ত্রীর আশ্বাস পেয়ে তাঁরা কিছুটা স্বস্তি পেয়েছেন বলেও জানান তিনি।

ক্ষত নিরাময়ের চেষ্টায় দুপুরের এই ‘সাফল্য’ অবশ্য কিছুটা ধাক্কা খায় সন্ধেবেলা রাজ্যপালের কড়া বার্তায়। এর আগে যাদবপুর নিয়ে ইতিমধ্যেই একাধিক বার আলোচনায় বসেছেন রাজ্যপাল। শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গেও দু’দিন আগেই কথা বলেছিলেন তিনি। বক্তব্য শুনেছিলেন স্বরাষ্ট্রসচিবের, উপাচার্যের। ডেকে পাঠিয়েছিলেন পুলিশ কমিশনারকে। কিন্তু রাজ্যপালের বক্তব্য ছিল, পড়ুয়াদের সঙ্গে কথা না বলে তিনি চূড়ান্ত মতামত দেবেন না। শনিবার ছাত্রপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে, তাদের দেওয়া ভিডিও ফুটেজ খতিয়ে দেখে তিনি এ দিন যে ভাবে ছুটির দিনে ফের তলব করলেন শিক্ষামন্ত্রীকে, তার মধ্য দিয়েই তিনি তাঁর মনোভাবের ইঙ্গিত দিয়ে রাখলেন বলে মনে করা হচ্ছে। নিরপেক্ষতার প্রশ্নে দিয়ে রাখলেন স্পষ্ট বার্তাও।

jadavpur university student suppression partha chatterjee sanku governor
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy