Advertisement
E-Paper

নিগ্রহের তদন্তে পুলিশ ডাকেননি উপাচার্যই

নিজের প্রাণসংশয়ের কথা বলে যাদবপুরের ছাত্র আন্দোলন ভাঙতে পুলিশ ডাকতে দ্বিধা করেননি তিনি। উপাচার্যের সেই সিদ্ধান্তের পরিণতিতে পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে নির্বিচারে পিটিয়েছে ছাত্রছাত্রীদের। কিন্তু এক তরুণীর শ্লীলতাহানির দায়ে অভিযুক্ত কয়েক জন ছাত্রকে চিহ্নিত করে তদন্তের জন্য ক্যাম্পাসে পুলিশ ঢোকাতে সেই উপাচার্যই কিন্তু পিছু হটেছিলেন। অভিযোগকারিণী ছাত্রীর বাবার আর্জি উড়িয়ে দিয়ে তিনি বলেছিলেন পুলিশ ক্যাম্পাসে ঢুকলে যাদবপুরের ভাবমূর্তি, মর্যাদা, সব তছনছ হয়ে যাবে!

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:৩৭

নিজের প্রাণসংশয়ের কথা বলে যাদবপুরের ছাত্র আন্দোলন ভাঙতে পুলিশ ডাকতে দ্বিধা করেননি তিনি। উপাচার্যের সেই সিদ্ধান্তের পরিণতিতে পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে নির্বিচারে পিটিয়েছে ছাত্রছাত্রীদের। কিন্তু এক তরুণীর শ্লীলতাহানির দায়ে অভিযুক্ত কয়েক জন ছাত্রকে চিহ্নিত করে তদন্তের জন্য ক্যাম্পাসে পুলিশ ঢোকাতে সেই উপাচার্যই কিন্তু পিছু হটেছিলেন। অভিযোগকারিণী ছাত্রীর বাবার আর্জি উড়িয়ে দিয়ে তিনি বলেছিলেন পুলিশ ক্যাম্পাসে ঢুকলে যাদবপুরের ভাবমূর্তি, মর্যাদা, সব তছনছ হয়ে যাবে!

ইনিই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তী!

কলা বিভাগের যে ছাত্রীর শ্লীলতাহানির ঘটনার সূত্রে বিশ্ববিদ্যালয় এখন উত্তাল হয়ে উঠেছে, তাঁর বাবা নিজেই উপাচার্যের এই দ্বিচারিতার কথা তুলে ধরেছেন।

কেন তিনি এমনটা করলেন? বার বার ফোন করে এবং মোবাইলে এসএমএস করে বিষয়টি জানতে চাওয়া হয় অভিজিৎবাবুর কাছে। তিনি জবাব দেননি। এ প্রসঙ্গে যাদবপুরের আন্দোলনরত ছাত্র-ছাত্রীরাও এ দিন বলেছেন, গুরুতর ওই অভিযোগে ক্যাম্পাসে পুলিশ তদন্ত করলে তাঁদের কিছুই আপত্তি ছিল না।

বস্তুত তাঁর মেয়ের অভিযোগের তদন্তে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ঢিলেমিতে রীতিমতো বিস্মিত ও বিরক্ত ওই পিতা। তাঁর দাবি, সহমর্মী আন্দোলনরত পড়ুয়াদের নিগ্রহের নেপথ্যেও উপাচার্য সর্বতো ভাবে দায়ী।

নির্যাতিতার বাবার কথায়, “উপাচার্য এক বার ছাত্রদের সঙ্গে কথা বললেই সে-দিন গোলমালটা মিটে যেতে পারত! কিন্তু উনি তা না-করে পুলিশ ডেকে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের মার খাওয়ালেন!”

নিজের মেয়ের প্রসঙ্গেও এ দিন মুখ খুলেছেন ওই বাবা। দৃঢ় ভাবে তিনি বলেছেন, “আমার মেয়ে অন্যায় করেনি। এই ঘটনায় ওর কোনও দায় নেই। বরং বুদ্ধি খাটিয়ে ও প্রাণে বাঁচার চেষ্টা করেছে!” কী হয়েছিল, ছাত্রীটির সঙ্গে? তা-ও এ দিন সবিস্তার সংবাদমাধ্যমের সামনে বলেছেন ওই পিতা। তিনি জানান, গত ২৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় যাদবপুরে কলা বিভাগের ফেস্ট-এর সন্ধ্যায় ঘটনাটি ঘটে। তাঁর বয়ান অনুযায়ী, সাড়ে সাতটা নাগাদ ফেস্টের অনুষ্ঠান শুনতে ওপেন এয়ার থিয়েটারে একাই যাচ্ছিলেন তাঁর মেয়ে। তাঁর টয়লেটে যাওয়ার দরকার ছিল। কিন্তু তখন কলা বিভাগের ভবনগুলি বন্ধ দেখে কাছে একটি ঝোপঝাড়ের আড়ালে যান মেয়েটি। তিনি বেরিয়ে আসার সময়ে দেখা হয় এক পরিচিত যুবকের সঙ্গে, তিনি সে-দিনই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার বিচারক ছিলেন। ওই দু’জনে কথা বলার সময়েই চড়াও হয় আরও কয়েক জন যুবক। তাঁদের কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, নিউ পিজি হস্টেলের বাসিন্দা। ‘দু’জনে ওখানে কী করছিস’ বলে শুরু হয় সম্ভাষণ। মারতে মারতে মেয়েটিকে হস্টেলে নিয়ে যাওয়া হয়। বাবার কথায়, “ধর্ষণটুকুই ওরা করতে বাকি রেখেছে। হস্টেলের ঘরে দরজা বন্ধ করে মদ্যপ অবস্থায় অভব্যতা, মারধর সব করেছে। মেয়ের গায়ে মদ ঢেলে দিয়েছে। বুকে-পিঠে লাথি মেরেছে। ও ছিটকিনি খুলতে গেলে আঙুলগুলো মুচড়ে দিয়েছে বারবার!”

ওই অবস্থা থেকে কী ভাবে মুক্তি পেলেন ছাত্রীটি? তাঁর বাবার কথায়, “ও কোনও মতে এক পরিচিতকে ফোন করে! তিনি বিশ্ববিদ্যালয়েরই প্রাক্তনী, তখন ক্যাম্পাসে ছিলেন। মেয়ে বেশি ক্ষণ কথা বলতে না পারলেও লাইনটা কাটতে কিছুটা দেরি হয়। ওই যুবক তখন চিৎকার, চেঁচামেচি শোনেন। কোথায় ঘটনাটি ঘটছে বুঝতে পেরে চলেও আসেন।” বাবার দাবি, পরিচিত যুবকটি তাঁর মেয়েকে ছুটে বেরিয়ে আসতে দেখেন। হস্টেলের সুপারও তাঁর মেয়ে ও অন্য ছেলেগুলিকে ওই সময়ে দেখতে পান।

বাবা জানিয়েছেন, সে-দিন রাতে তাঁর বড় মেয়ে ও জামাইয়ের কাছে ছিলেন নিগৃহীতা মেয়েটি। পর দিন সকালে গায়ে কালশিটে ও আঘাতের দাগ নিয়ে বাড়ি ফেরেন তিনি।

এই মারাত্মক ঘটনার অভিযোগ জানানোর পরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তথা উপাচার্যের কাছ থেকে যে সাড়া মিলেছে, তা আরও দুভার্গ্যজনক বলে মনে করেন ওই পিতা।

নির্যাতিতার বাবার দাবি, গত ১ সেপ্টেম্বর প্রথম বার তিনি উপাচার্যের কাছে যান। অভিজিৎবাবু বলেন তিনি দু’দিন থাকবেন না, তাই পাঁচ তারিখে আসুন। থানায় অভিযোগের পরামর্শও দেন। ২ তারিখ যাদবপুর থানায় অভিযোগ করার পরে বাবা জানতে পারেন, উপাচার্য দিব্যি ক্যাম্পাসে আছেন। তাই ৩ সেপ্টেম্বর আবার তাঁর সঙ্গে কথা বলতে আসেন। উপাচার্য তাঁকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে খোঁজখবর করে তাঁরা পুলিশকে যা করার করতে বলবেন। তাতে অন্তত ১৫-২০ দিন সময় তো লাগবেই! এর মধ্যে ছাত্রীটির নিরাপত্তার কোনও গ্যারান্টি তিনি দিতে পারবেন না বলেও জানিয়ে দেন উপাচার্য। মেয়েকে বিশ্ববিদ্যালয়ে না-পাঠাতে পরামর্শ দেন তিনি।

এর পরে ১২ সেপ্টেম্বর তাঁদের বাড়িতে আসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিযোগ-সংক্রান্ত কমিটির সদস্যরা। মেয়েটি কী পোশাক পরেছিলেন, ওই যুবককেই বা কেন ফোন করেছিলেন, তাঁর সঙ্গে কী সম্পর্ক, এই সব বিষয়ে প্রশ্ন করেন তাঁরা। বাবার অভিযোগ, জেরার নামে উত্ত্যক্তই করা হয় ছাত্রীটিকে। বিধাননগর কমিশনারেটের অন্তর্গত একটি থানায় এই হয়রানির বিষয়ে জেনারেল ডায়েরিও নথিভুক্ত করিয়েছেন ওই ছাত্রী।

শুক্রবার উত্তর কলকাতায় নিজের অফিসে বসে মেয়ের কথা বলতে গিয়ে পেশায় ব্যবসায়ী ওই প্রৌঢ়ের গলা কাঁপছিল! তিনি বলেন, “আমার মেয়ে বিভীষিকার মধ্যে রয়েছে।” বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিযোগ-সংক্রান্ত কমিটির ডাকে এক বার, তার পরে পুলিশকে ঘটনাস্থল চেনাতে আরও এক বার ক্যাম্পাসে যেতে হয়েছিল তাঁর মেয়েকে। আলিপুরে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জবানবন্দিও দিয়ে এসেছেন ওই ছাত্রী। এর বাইরে ঘরবন্দি তিনি।

ছাত্রীটির বাবা জানান, পুলিশের হামলার ভিডিও দেখেছে তাঁর মেয়ে। তার এক বান্ধবীর জামা ছেঁড়ার চেষ্টা হচ্ছে, তাও দেখেছে। যা দেখে আরও অসুস্থ হয়ে পড়েছে। বাবার কথায় ছাত্রীটির শরীরের ক্ষত সেরেছে। কিন্তু মনস্তত্ত্ববিদের মতে বিভীষিকা কেটে মানসিক অবস্থা স্বাভাবিক হতে তিন-চার মাস লাগবে। এর মধ্যে মঙ্গলবার রাতে যাদবপুরে ছাত্র নিগ্রহের ঘটনায় মেয়েটি একেবারেই ভেঙে পড়েছে।

jadavpur university police latest news online news kolkata news
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy