Advertisement
০৪ মে ২০২৪

অপুষ্টির ‘সন্ত্রাস’ কুরে কুরে খাচ্ছে কলকাতার বস্তির শৈশব

শিশু দিবসে কেমন রয়েছে কলকাতার বস্তির শিশুরা? ‘কলকাতার যিশু’রা? সাম্প্রতিক সমীক্ষার ফলাফল জানাচ্ছে, তারা একেবারেই ভাল নেই। শুধুই সমীক্ষার ফলাফল নয়। আমরা গিয়েছিলাম কয়েকটি বস্তি এলাকায়। মিলেছে খুবই উদ্বেগজনক ছবি।

ঢাকুরিয়া রেল লাইনে কলকাতার বস্তির সংসার! শনিবার, শিশু দিবসে।

ঢাকুরিয়া রেল লাইনে কলকাতার বস্তির সংসার! শনিবার, শিশু দিবসে।

সুজয় চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০১৫ ১৫:৪৪
Share: Save:

মাঝ-নভেম্বরের সাতসকাল।

ঢাকুরিয়া রেল কলোনি তখনও ভোরের কুয়াশায় ঢাকা।

রেল লাইনের একেবারে গা ঘেঁষে মাটিতেই রোদে দেওয়া হয়েছে জামাকাপড়। পাশে খেলে বেড়াচ্ছে এক দল শিশু। হাড়-জিড়জিড়ে, প্রায় উলঙ্গ। তাদের মায়েরা পরিচারিকার কাজ করেন। তৈরি হচ্ছেন কাজে বেরোতে।

বছর বারোর শবনমের সঙ্গে দেখা হল সেখানেই। উড়ালপুলের নীচ দিয়ে ঢাকুরিয়া স্টেশনের দিকে কয়েক পা এগোতেই ওদের ‘বাড়ি’। ‘বাড়ি’ বলতে রেল লাইনের গা ঘেঁষা সার সার ঝুপড়ির একটা।

‘স্কুলে যাও?’

‘না।’

‘কী কর সারা দিন?’

‘মা, বাবা কাজে যায়। আমি ভাইবোনকে দেখি।’

আরও কয়েক পা এগিয়ে আরেক দঙ্গল ছেলেমেয়ের মধ্যে খোঁজ মিলল টুকাই, বাপন, বিলকিসের।

গোবরডাঙা রেল কলোনির কাছেই ছোট্ট একটা সরকারি স্কুলে যায় ওরা। জানাল, রোজই ওদের মিড-ডে মিল দেওয়া হয় স্কুলে। ভাতের সঙ্গে সয়াবিনের তরকারি। ডিমের ঝোলও।

‘কেমন লাগে খেতে?’

‘ভাল না। বাজে, খুব বাজে।’ একে অপরের মুখ চাওয়াচায়ি করে প্রায় সমস্বরেই বলে উঠল কয়েকটি শিশু।

ওদের মধ্যেই বিলকিসকে পেলাম। বিলকিস নিয়ে গেল ওদের ঝুপড়িতে। ওদের ঝুপড়ির দরজায় পৌঁছে দেখা হল ওর মায়ের সঙ্গে। কোলে তাঁর আরও দু’টি শিশু। ছেলে, মেয়ে।

‘ওদের নিয়েই অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে যান?’

কথাটা শুনে কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন মধ্যবয়সী রাজিয়া বিবি। ‘অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র’ কথাটার মানেই বুঝতে পারছিলেন না! খেই ধরিয়ে দিল মেয়ে বিলকিস। বলে উঠল, ‘ওই যে রে খিচুড়ি সেন্টার!’

বোঝা গেল, ওঁরা অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রকে ‘খিচুড়ি সেন্টার’ বলেই জানেন!

মুখে কাপড় চাপা দিয়ে কথায় কথায় রাজিয়া জানালেন, ‘গোবরডাঙা এলাকার ‘খিচুড়ি সেন্টারে’ (পড়ুন, আইসিডিএস কেন্দ্র) শিশুরা যায় ঠিকই। খিদে পায় তো, খিচুড়ি খেতে যায়। আমার মেয়েও যায়। কিন্তু, ওদের ওজন-টোজন মাপা হয় বলে তো জানি না। তা হলে তো মেয়ে বলত। আমার মেয়ের এখন কত ওজন, জানি না। আমি মা। কিন্তু ‘খিচুড়ি সেন্টার’ আমাকে কিছুই জানায় না।’


বর্ণ পরিচয়। ঢাকুরিয়ায় রেল লাইনের ধারের বস্তি শিশুরা।

মায়েদের তো অনেক কিছুই জানতে হয়! তাঁদের শিশুরা অপুষ্টির শিকার কি না, ওই শিশুদের জন্য বিকল্প পুষ্টির প্রয়োজন রয়েছে কি না, প্রসূতি মায়েদের স্বাস্থ্যের ওপর নিয়মিত নজর রাখার জন্য বিশেষ কোনও পরিষেবা চালু রয়েছে কি না- রাজিয়া বিবি কি জানেন এত কিছু? তাঁকে ওই সব জানানো হয়?

প্রশ্ন শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লেন রাজিয়া বিবি! মুখ থেকে অস্ফূটে বেরিয়ে এল, ‘কই, দেখিনি তো কখনও। কেউ কোনও দিন কিছু জানায়ওনি।’

আজ ‘শিশু দিবসে’ খোঁজ নিতে গিয়েছিলাম, কলকাতায় কেমন রয়েছে শবনম, টুকাই, বাপন, বিলকিস, শাহজাদের মতো বস্তিতে থাকা শিশুরা?

একটি সর্বভারতীয় শিশু অধিকার রক্ষা সংস্থার হালের সমীক্ষায় যে সব তথ্য মিলেছে, তা মোটেই আশাব্যঞ্জক নয়। সমীক্ষা রিপোর্ট জানাচ্ছে, শহরের বস্তি এলাকায় থাকা ছ’বছরের কম বয়সী শিশুদের ৪৯ শতাংশই অপুষ্টির শিকার। তাদের মধ্যে ৩৩ শতাংশের ক্ষেত্রে অপুষ্টির অভাব রীতিমতো ভয়াবহ।


কলকাতার যিশু! সেই সব মুখ। বালিগঞ্জ লেকের কাছে পঞ্চানন তলা বস্তিতে।

আরও উদ্বেগজনক ছবি টিকাকরণের ক্ষেত্রেও। সমীক্ষা রিপোর্ট বলছে, শহর কলকাতায় বস্তিতে থাকা তিন বছরের কম বয়সী শিশুদের ৪০ শতাংশের ক্ষেত্রেই টিকাকরণ কর্মসূচি শেষ হয়নি। ৫৮ শতাংশ শিশু মাত্র একটি ‘ভ্যাক্সিন’ পেয়েছে। ছেলেদের ক্ষেত্রে যেখানে টিকাকরণ হয়েছে ৬১.২ শতাংশের, মেয়েদের ক্ষেত্রে তা আরও কম- ৫৬.৫ শতাংশ।

এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়। ঝাঁ চকচকে ঢাকুরিয়া থেকে বনেদি বালিগঞ্জের আশপাশের এলাকায়। স্টেশন চত্ত্বর আর বালিগঞ্জ লেকে।

ছবিটা দেখলাম একই রয়েছে বালিগঞ্জ লেক লাগোয়া পঞ্চানন তলা বস্তিতেও। সেখানেও খাতায়-কলমে চালু রয়েছে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র। কিন্তু সেখানেও ঘুরে ঘুরে খোঁজ-খবর নিয়ে দেখলাম, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের পরিষেবার গুণমান নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে। ওই সব সুবিধার কথা যাঁদের জানার কথা, তাঁরা পুরোপুরি অন্ধকারে রয়েছেন। তাঁদের কিছুই কোনও দিন জানানো হয়নি।

ওঁদেরই এক জন সুকিয়া বিবি আমাকে নিয়ে গেলেন অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের ‘দিদি’দের কাছে। সেই ‘দিদি’রা কথা শুরুই করলেন ‘সব ঠিক হ্যায়’ দিয়ে! ভ্রূক্ষেপই করলেন না আমাদের পাশে দাঁড়ানো সুকিয়া বিবিকে! সেই সুকিয়া বিবি, যিনি একটু আগেই বলছিলেন, ‘আমার ছেলে শাহজাদ জানে ওখানে (অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র) গেলেই খিচুড়ি মেলে। ওখানে আর কিছু পাওয়া যায় বলে ও জানে না। আমিও জানি না। আমাকে কেউ কিছু জানায় না।’ অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের ‘দিদি’দের কথা শুনে সুকিয়া বিবি শুধু মুখ টিপে হাসছিল। বেফাঁস কিছু বলে ফেললে যদি ওর ছেলে শাহজাদের খিচুড়ি মেলা বন্ধ হয়ে যায় ‘খিচুড়ি সেন্টারে’! ‘দিদি’রা বললেন, ‘সামর্থের মধ্যে যত রকম পরিষেবা দেওয়া সম্ভব, সবই দেওয়া হয়। মা, বাবাদের সব কিছু জানানো হয়। শিশুদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো হয়।’ তখন ‘দিদি’দের সামনেই দাঁড়িয়ে কয়েকটা হাড় জিরজিরে শিশু! দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, তারা ভয়াবহ অপুষ্টির শিকার। ডাক্তারি পরিভাষায় যাকে বলে, ‘সিভিয়ারলি অ্যাকিউট ম্যালনারিশ্‌ড চাইল্ড’ (এসএএমসি বা ‘স্যাম্‌স’)।


খিচুড়ি খাওয়া শেষে...কলকাতার বস্তির শিশু।

ওই সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ঘাটতি রয়েছে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র থেকে ভিটামিন, কৃমিনাশক ওষুধ এবং আয়রন ও ফোলিক অ্যাসিড সাপ্লিমেন্টেশনের বিলি-বণ্টনের ক্ষেত্রেও। কলকাতার বস্তি এলাকার প্রায় ৬০ শতাংশ শিশুই যখন আয়রন ও ফোলিক অ্যাসিড সাপ্লিমেন্টেশনের আওতার বাইরে, সেখানে ভিটামিন-এ পৌঁছয়নি ৩১ শতাংশ শিশুর কাছে। ৩৯ শতাংশ শিশুকে দেওয়া হয়নি কৃমিনাশক ট্যাবলেট।

সমীক্ষার ফলাফল শহরের বস্তি এলাকায় অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের পরিষেবা নিয়েও প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। ৪৫ শতাংশেরও বেশি মা জানিয়েছেন, তাঁদের সন্তানের স্বাস্থ্যের হাল-হকিকৎ তাঁদের জানায় না অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র। যেটা আরও উদ্বেগের, ৭৬ শতাংশ মা জানিয়েছেন, তাঁদের সন্তান যে অপুষ্টির শিকার, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র থেকে সে ব্যাপারে তাঁদের ন্যূনতম সতর্ক বার্তাও দেওয়া হয়নি।

নমুনা সমীক্ষা থেকে সার্বিক চিত্র পাওয়াটা তেমন সম্ভব না হলেও, সামগ্রিক একটি প্রবণতা সেখান থেকে ধরা পড়ে। সেই প্রবণতার কথা মাথায় রাখলে এ কথা বলাই যায়, অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে থাকা শিশুদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সুনিশ্চিত করার প্রশ্নে এখনও অনেক পথ হাঁটা বাকি শহর কলকাতার।

সমীক্ষক সংস্থার সিইও এবং পূর্বাঞ্চলীয় অধিকর্তা পূজা মারওয়াহা ও অতীন্দ্র নাথ দাসের কথাতেও সেই উদ্বেগের সুর স্পষ্ট। পূজা এবং অতীনবাবু জানালেন, ‘‘শুধু সরকার বা সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক মহল নয়, এ বিষয়ে দায়িত্ব রয়েছে সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের। আমাদের প্রত্যেকের। শিশুর জীবনের প্রথম ছ’টি বছর যেহেতু তাদের বৃদ্ধি ও বিকাশের ক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরি সময়, তাই এই সময়ে তাদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি যাতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পায়, তা সুনিশ্চিত করতে সরকারকে যেমন এগিয়ে আসতে হবে, তেমনই সতর্ক হতে হবে আমাদেরও।’’

তা না হলে, শবনম, টুকাই, বাপন, বিলকিস, শাহজাদদের সুস্থ, সুন্দর ও সম্পূর্ণ জীবনের দিকে এগিয়ে দেওয়ার কাজ অসম্পূর্ণই থেকে যাবে!

তথ্য সৌজন্য: ‘ক্রাই- চাইল্ড রাইটস অ্যান্ড ইউ’।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

kolkata slum children suffers dhakuria
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE