গোধূলির আলোয় তখন ক্রমশ রঙিন হচ্ছে শহিদ মিনার চত্বর। পড়ুয়াদের জমায়েত থেকে ভেসে আসছে ‘হাল্লা বোল’। ভিড় ঠেলে সে দিকে এগোতে না পারলেও শহিদ মিনারের ঠিক নীচে একটা বেঞ্চে টুপি-মাফলার-সোয়েটার পরা বৃদ্ধ কাঁপা গলায় তাল মেলাচ্ছেন নতুন প্রজন্মের সঙ্গে।
নতুন নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতায় ছাত্র ও যুব সংগঠনের মিছিল শুরু হতেই লাঠি হাতে পা মেলালেন বৃদ্ধ। কিন্তু মেরুদণ্ডে একাধিক বার অস্ত্রোপচার হওয়া শরীরে কয়েক মাস আগে ফের ক্যানসারের জন্য কাটাছেঁড়া হওয়ায় তেমন জোর পেলেন না। কিন্তু তা বলে তো থেমে যাওয়া যায় না। তাই শনিবার বিকেলে রেড রোডের ডিভাইডারের উপরে বসে পড়ে মুঠিবদ্ধ হাত উপরে তুলে স্লোগান দিলেন, ‘লড়কে লেঙ্গে আজাদি’। তিনি, ৮৮ বছরের ‘যুবক’ সমর বাগচী। তাঁর কথায়, ‘‘একটাই চিন্তা— কোন ভবিষ্যৎ রেখে যাচ্ছি পরবর্তী প্রজন্মের জন্য?’’
পরবর্তী প্রজন্মের হাত আরও শক্ত করতেই তাই শরীরের বাধাকে পিছনে ফেলে বেরিয়ে পড়েছিলেন বিড়লা ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড টেকনোলজিক্যাল মিউজ়িয়ামের প্রাক্তন অধিকর্তা সমরবাবু। মনকে শক্ত করে ভবানীপুর থেকে বাস ধরে হাজির হয়েছিলেন শহিদ মিনার চত্বরে। আগেও বহু মিছিল, আন্দোলন দেখেছেন। নিজেও হেঁটেছেন কয়েকটা মিছিলে। প্রথম মিছিলে হাঁটেন পঞ্চাশের দশকে ছাত্রাবস্থায়। সোভিয়েত জাহাজ তখন গম নিয়ে কলকাতায় ভিড়েছিল। তা দেখতে মিছিল করে গিয়েছিলেন সমরবাবু। বললেন, ‘‘সোভিয়েত ইউনিয়ন, চিন কী অসাধারণ উন্নতি করেছিল, বার্লিনের আন্দোলন— সব দেখেছি।’’
আরও পড়ুন: নাগরিকত্বের কাঁটা উৎসবের অ্যাংলো পাড়ায়
তাই শহিদ মিনার চত্বরে কয়েক হাজার পড়ুয়ার কাউকে গান গাইতে, কাউকে পোস্টার লিখতে কিংবা স্লোগান দিতে দেখে আশার আলো জ্বলে উঠছিল সমরবাবুর। কারণ তিনি মনে করেন, ছাত্রেরা আরও একটু সংগঠিত হলে দেশ এবং পৃথিবীকেও বদলাতে পারে। পড়ুয়াদের সঙ্গে পুরোটা পথ পা মেলাতে না পারলেও ফিরেছেন একরাশ উৎসাহ নিয়ে।
রবিবারও বৃদ্ধের চোখেমুখে অটুট সেই উৎসাহ। বললেন, ‘‘ছাত্র-যুবদের মুখের ভাব, চিৎকারে মনে হচ্ছিল সবটা আঁধার নয়। এখনও আশা আছে।’’ হিন্দুস্থানী মার্গসঙ্গীতের ভক্ত সমরবাবু ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র করার পরিকল্পনার তীব্র বিরোধী। রানিকুঠিতে মেয়ের বাড়িতে বসে কথা বলার মাঝেই চোয়াল শক্ত করে বললেন, ‘‘বড়ে গোলাম আলি যখন ‘হরি ওম’ গাইছেন, তখন তিনি কি কোনও ধর্মের কথা ভাবছেন? কোনও ধর্মেই কখনও মানুষকে মেরে দেশকে টুকরো করার কথা বলা হয়নি।’’
আরও পড়ুন: ইস্ট-ওয়েস্ট শুরুর বাধা কি নাগরিক বিক্ষোভ
দেশটাকে আর কোনও ভাবেই টুকরো হতে দিতে চান না সমরবাবুও। তাই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রের ফোন পেয়েই মনকে শক্ত করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তিনিও হাঁটবেন ছাত্র-যুবদের সঙ্গে।
বিহারের পূর্ণিয়ায় জন্ম। তবে ১৯৪৮ সাল থেকে কলকাতার বাসিন্দা। স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে বিএসসি পাশ করে মাইনিং ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যান ধানবাদে। কয়লা খনিতে আড়াই বছর ম্যানেজারের চাকরি করার পরে বিআইটিএমে যোগ দেন ১৯৬২-তে। জীবনের দীর্ঘ যাত্রাপথে সমাজের বদল দেখেছেন বামপন্থী ভাবধারায় বিশ্বাসী সমরবাবু। যিনি বলছেন, ‘‘মানুষ তো ধর্ম খায় না। একটু চাল খায়, ডাল খায়, সঙ্গে থাকে একটুখানি পেঁয়াজ-লঙ্কা। মানুষকে চিরদিন বোকা বানানো যায় না।’’ রবীন্দ্রনাথ-গাঁধীর আদর্শে অনুপ্রাণিত এই অশীতিপর বৃদ্ধ এখনও ভোরে উঠে লেখালেখি করেন। জলবায়ু পরিবর্তনের সচেতনতায় স্কুলের ছাত্রদের নিয়ে মাস কয়েক আগেও মিছিল করেছেন। গ্রামে গিয়েও স্কুলে ছাত্রদের পড়ান।
কারণ অশীতিপর ‘যুবক’ স্বপ্ন দেখেন একটা সুস্থ ভারত নির্মাণের।