স্বাধীনতা সংগ্রামীর পোঁতা প্রায় ৮০ বছরের পুরনো বিশালাকার তেঁতুলগাছ। বাঘা যতীনের বিদ্যাসাগর কলোনির ঘিঞ্জি এলাকায় গজিয়ে ওঠা একাধিক বহুতলের মাঝে আজও মাথা উঁচিয়ে থাকা এই বৃক্ষ বহু পাখি, পোকামাকড়ের আশ্রয়স্থল। তবে তার ভবিষ্যৎ এখন নির্ভর করছে প্রোমোটারের মর্জির উপরে। তাই সেই গাছ বাঁচাতে সেখানে প্রায়ই বসে গানের আসর, আলোচনাসভা। এ বার সেই তেঁতুলগাছকে কেন্দ্র করেই ১৬ ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী ‘গ্রেট ব্যাকইয়ার্ড বার্ড কাউন্ট’-এ (জিবিবিসি) যোগ দেবেন পক্ষীপ্রেমীরা।
বিদ্যাসাগর কলোনির বাড়ির উঠোনে নিজের হাতে তেঁতুলগাছটি একদা লাগিয়েছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী পারুল মুখোপাধ্যায়। অনুশীলন সমিতির সঙ্গে যুক্ত এই অগ্নিকন্যা ১৯৩৫ সালে টিটাগড় বোমা ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেফতার হন আরও দুই বিপ্লবীর সঙ্গে। কয়েক বছর জেল খেটে অবশেষে মুক্তি পান ১৯৩৯ সালে। স্বাধীনতার পরে থাকতে শুরু করেন এই বিদ্যাসাগর কলোনিতে। সেখানে একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকাও ছিলেন তিনি। এলাকায় পরিচিত ছিলেন ‘পারুলপিসি’ হিসাবে। ১৯৯০ সালে তিনি মারা গেলেও রয়ে গিয়েছে তাঁর স্মৃতিবিজড়িত তেঁতুলগাছখানি।
কিন্তু সেই গাছের ভবিষ্যৎ নিয়ে বর্তমানে চিন্তায় প্রকৃতিপ্রেমীরা। ওই এলাকার বাসিন্দা তথা চলচ্চিত্র পরিচালক দেবলীনা জানাচ্ছেন, পারুলদেবীর বাসস্থানটি প্রোমোটারের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন তাঁর পরিবার। তাই জমির এক প্রান্তে থাকা এই তেঁতুলগাছের ভবিতব্য কী হতে চলেছে, তা নিয়ে সন্দিহান তাঁরা। দেবলীনার কথায়, ‘‘গাছ বাঁচাতে, ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রাখতেই তার নীচে ‘তেঁতুলতলার গান’, ‘তেঁতুল-টক’ শুরু করেছি আমরা। গাছটিকে ঘিরে সংস্কৃতিমনস্ক মানুষের আনাগোনাও বেড়েছে।’’ তবু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, উন্নয়নের থাবায় বদলাচ্ছে কলোনির মানচিত্র। তাই অদূর ভবিষ্যতে এই গাছটির পরিণতি কী হবে, তা নিয়ে আশঙ্কায় ভুগছেন অনেকে।
তাই অস্তিত্বসঙ্কটে ভোগা তেঁতুলতলায় এ বার পাখি গণনা করবেন পক্ষীপ্রেমীরা। ‘বার্ড ওয়াচার্স সোসাইটি’ নামে রাজ্যের একটি পাখিপ্রেমী সংস্থার সদস্য তিতাস চক্রবর্তী বলছেন, ‘‘জিবিবিসি-র মূল কথাই হল, বাড়ির আশপাশে থাকা পাখিদের গণনা। তাই ওই তেঁতুলগাছে আসা পাখিদের গণনা করতেই ছোট-বড় সকলকে নিয়ে কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছে। ১৬ তারিখ সকালে-বিকেলে সেখানে আসা বিভিন্ন প্রজাতির পাখিদের চেনা ও গণনা করা হবে। তবে আসন সংখ্যা সীমিত, কারণ বেশি ভিড় হলে পাখিরা আসবে না।’’ যদিও দেবলীনা জানাচ্ছেন, কয়েক বছর আগেও ওই তেঁতুলগাছে আশ্রয় নিত নীলচুটকি, কমলা দামা, দুধরাজ, হাঁড়িচাচা, ডাহুক, নিশিবকের মতো অচেনা পাখিরা। সে সময়ে তাদের বহু ছবি তুলেছেন তিনি। কিন্তু এখন তেঁতুলতলায় সে সব পাখির দেখা মেলা ভার। গত শীতে বসন্তবৌরির দেখা মিললেও এ বছর তারা তেমন আসেনি। অর্থাৎ, উন্নয়নের থাবায় তেঁতুলতলায় কমছে পাখিদের আনাগোনা— মত দেবলীনার।
পাখিদের চিহ্নিত করতে আমেরিকার কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় ও অডবন বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে ১৯৯৮ সাল থেকে প্রতি ফেব্রুয়ারিতে হয় এই জিবিবিসি। ২০১৩ সাল থেকে এই গণনায় অংশ নিচ্ছে ভারতও। এ বছর ১৪-১৭ ফেব্রুয়ারি, মোট চার দিন ধরে যে কোনও প্রান্ত থেকে ১৫ মিনিট করে পাখি দেখা ও চেনার কাজ চলবে। তার পরে তা নথিভুক্ত করতে হবে ই-বার্ড পোর্টালে। ‘বার্ড ওয়াচার্স সোসাইটি’র সদস্য ও পেশায় চিকিৎসক কণাদ বৈদ্য বলছেন, ‘‘জিবিবিসি-র মাধ্যমে বাড়ির আশপাশে থাকা পাখি সম্পর্কে যেমন সম্যক ধারণা পাওয়া যায়, তেমনই কত মানুষের মধ্যে পাখি নিয়ে সচেতনতা বেড়েছে, তা-ও বোঝা যায়। ২০২৩ সালের তুলনায় গত বছরে যেমন শুধু এ রাজ্যেই অতিরিক্ত ১০২ জন এই গণনায় অংশ নিয়েছিলেন। পাখিকে চিনতে শিখলে প্রকৃতি নিয়েও মানুষ সচেতন হবে, এটাও অন্যতম উদ্দেশ্য।’’
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)