Advertisement
১০ মে ২০২৪
Durga Puja 2022

দূরত্ব মুছে শহরে ফুল ফোটার স্বপ্ন দেখেন চিনা কন্যাও

স্টেফানির শাশুড়ি ইন্দ্রাণী চৌধুরী লাজুক হাসেন, “উত্তমকুমারের বাবা আর আমার দিদিমা মামাতো, পিসতুতো ভাইবোন!” দেওয়ালে সারদামণির পা ছড়িয়ে বসা চেনা ছবি।

বন্ধন: দুই সন্তানের সঙ্গে স্টেফানি চৌধুরী। ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকে

বন্ধন: দুই সন্তানের সঙ্গে স্টেফানি চৌধুরী। ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকে

ঋজু বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৯:২১
Share: Save:

খাঁটি বর্মি সেগুন কাঠের কবেকার টেবিল মানিয়েছে ভবানীপুরের গলির ২০০ বছরের বাড়িটায়। তাতে কুল, আমের আচারের বয়াম। স্টেফানি ওরফে ইয়োক হো তাঁর শাশুড়ি মায়ের সঙ্গে সেখানেই আলাপ করালেন। “মা ইজ রিলেটেড টু… কে বলো…উ-ত্তমকুমার!” উত্তম নামটা বৌমা বলতে পারায় শাশুড়ির চোখে শরতের রোদ।

স্টেফানির শাশুড়ি ইন্দ্রাণী চৌধুরী লাজুক হাসেন, “উত্তমকুমারের বাবা আর আমার দিদিমা মামাতো, পিসতুতো ভাইবোন!” দেওয়ালে সারদামণির পা ছড়িয়ে বসা চেনা ছবি। স-য়ে একটু জোর দিয়ে মিষ্টি বাংলা উচ্চারণে ‘শারদা মা’ও বলেন স্টেফানি। বর্মি টেবিলটা এসেছে বছর চারেক। ট্যাংরার একটি চিনে পরিবার চিরতরে কলকাতা ছাড়ার সময়ে টোফুমেকার, চায়ের বাসন, চেয়ার-টেবিল সহ চোখ জুড়ানো যত আসবাব কিনে নেন স্টেফানি ও অভ্রজিৎ ওরফে রাহুল। তেতলার ঘরে সেই টেবিল ঘিরে সরু, মোটা স্বরের আলাপে পুজোর ছুটির হাতছানি। শহরের অন্য পাড়ার এক ফুলও ভবানীপুরের বঙ্গভুবনে মিশে গিয়েছে।

স্টেফানি বলেন, ‘‘আমার ধর্ম, খাবারের অভ্যাস নিয়ে এ বাড়িতে কেউ মাথা ঘামায় না। অঞ্জলি, দশমীতে ঠাকুর বরণ বা বাড়ির কালীপুজোয় আই লাভ ড্রেসিং লাইক আ বেঙ্গলি।’’ মোচার ঘণ্ট, থোড় আর মাছের মুড়োর মতোই দুগ্গাপুজোকেও ভালবেসে ফেলেছেন কলকাতার তিন পুরুষের চিনা ঘরের কন্যা।

তবু বৌবাজার, বো ব্যারাকের শৈশব থেকে অনেক দূরে ভবানীপুরের এই জগৎ। চাউমিন, চিলি চিকেনের বঙ্গীয় সংস্করণে মাতলেও কয়েকশো বছর পাশাপাশি থাকা চিনারা অনেকের কাছেই পরবাসী। পুজো নাকি সবার উৎসব। তবু টেরিটিবাজার, কলুটোলা, ট্যাংরায় পুজোর রং এখনও ফিকে! বো ব্যারাকে নিজের জেঠামশাই ‘আঙ্কল রিচার্ডে’র বাড়ি স্টেফানির। হেয়ার স্ট্রিট থানার পাশে কপালিটোলার প্যান্ডেলের ঢাক ভেসে আসত ছোটবেলায়। না-গেলে জীবন বৃথা। তবু দূরত্বও ছিল! পুজো আর চাইনিজ় নিউ ইয়ারের ভিড়টা আলাদাই। কলকাতা শহরটা এমন আলাদা খোপ-কাটা ঘরে কেন বাঁচে, ভাবেন শহরের চিনাকন্যা।

সেন্ট জ়েভিয়ার্সের ছাত্র রাহুল আবার বলেন, “মহরম, পঁচিশে বৈশাখ থেকে চাইনিজ় নিউ ইয়ারের মানে স্কুলই চিনিয়েছে।” ক্লাস সিক্সে চিনা লায়ন ডান্সের দলে নাচেনও রাহুল। স্টেফানি তখন লরেটোয়। স্নাতক স্তরে বিলেতে পড়ার সুযোগ খুঁজছিলেন রাহুল। স্টেফানি কলেজে পড়তে পড়তে পড়ুয়াদের বিদেশে উচ্চশিক্ষার খবর দেওয়ার কাজ করতেন। রাহুলকে ফোনটা তিনিই করেন। ব্রিটেনে ইন্টারন্যাশনাল বিজ়নেস এবং এইচআর নিয়ে পড়ার সময়ে সেই মেয়েটিকে হালকা মনে পড়ত ভবানীপুরের ছেলের। চিনা মার্শাল আর্ট উ শু-র রেড স্যাশ জয়ী রাহুল চিনা ভাষাও শিখেছেন। ২০১২-য় দেশে ফিরে স্টেফানিকে পোশাকি ধন্যবাদ দিতেই ফোন করেছিলেন। কিন্তু সেই অভিঘাত অনেক দূর গড়াল।

স্টেফানির শাশুড়ি চুপিচুপি বলেন, ‘‘এমন বৌমা চেষ্টা করেও পেতাম না’’ কিন্তু বিয়ে নিয়ে যথেষ্ট টেনশনে ছিলেন রাহুল। চিনা পরিবারটিও ধন্দে ছিল। ’৬২র যুদ্ধ, দেওলির বন্দি-শিবিরে চিনাদের হেনস্থার দিনগুলি অনেক পিছনে। জীবনে চিন দেখেননি স্টেফানিরা। তবু চিন-ভারত সম্পর্কের সামান্য টানাপড়েনেই নড়ে ওঠে অবিশ্বাসের চোরাবালি। স্টেফানিদের চেনাজানা কারও কারও বাঙালি-বাড়িতে বিয়ে সুখেরও হয়নি। তুতো ভাইবোনেরা বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছিলেন। রাহুলের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে স্টেফানি ভাবছিলেন, এ তো উলটপুরাণ ঘটল।

৭৬ পল্লির পুজোয় বরণ, বাড়ির কালীপুজোর আলপনা, চালের নকশা আঁকায় চিনা বৌমা ছাড়া শাশুড়ি অন্ধ। আর স্টেফানি বরের সাহায্য ছাড়াই সব ‘ডায়ালগ’ বুঝে ‘অপরাজিত’ দেখছেন। পুজোয় ব্যোমকেশের ‘বই’ না-থাকায় খানিক মন খারাপও। চিনের সঙ্কট নিয়ে জল্পনাতেই বরং তাপ-উত্তাপ নেই ভারতীয় চিনা মেয়ের।

স্টেফানি-রাহুলের যৌথ ব্যবসা ছাড়াও গেরস্থালি জুড়ে দুই বাচ্চার দস্যিপনা। ন’বছরের আরিয়ানা মেই লিং চৌধুরী, দু’বছরের অরিন জুন কাই চৌধুরী। তাদের ধর্ম তারা পরে নিজেরাই ঠিক করবে, বলেন মা-বাবা। এ শহরে ক্রমশ কমছেন চিনারা। খুদেদের পুজোর জামা বাছতে বাছতে স্টেফানি ভাবেন, এই কুঁড়িরা কিন্তু ফুল হয়ে ফুটবে এখানেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Durga Puja 2022 woman China
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE