Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
অদৃশ্য হানাদার ঠেকাতে চলছে যুদ্ধ। যাঁরা প্রথম সারিতে দাঁড়িয়ে লড়ছেন, তাঁদের আত্মত্যাগ যেন যথাযথ সম্মান পায়। এই থাক প্রতিজ্ঞা।
doctor

বেহিসেবি হয়ে জীবনকে ছোট করবেন না

অদৃশ্য হানাদার ঠেকাতে চলছে যুদ্ধ। যাঁরা প্রথম সারিতে দাঁড়িয়ে লড়ছেন, তাঁদের আত্মত্যাগ যেন যথাযথ সম্মান পায়। এই থাক প্রতিজ্ঞা।

প্রতীকী চিত্র।

অরুন্ধতী দে
কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ জুন ২০২১ ০৫:৫৪
Share: Save:

মানুষ তো বন্য নয়। বলা হয়, ইহজগতের সব থেকে বুদ্ধিমান, সামাজিক জীব। তবু তাদের নিয়মের শিকলে বেঁধে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়! শিকল সামান্য আলগা হলেই বেপরোয়া হয়ে উঠতে দেরি হয় না মানুষের! যে কারণে এক বছরেও ঠিক মতো মাস্ক পরা এবং হাত জীবাণুমুক্ত করা রপ্ত হল না অনেকের। আর এই উদাসীনতাই ডেকে আনছে সংক্রমণের একের পর এক ঢেউ। দেশ জুড়ে কোভিড ১৯-এ এখনও পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে সাড়ে সাতশোরও বেশি চিকিৎসকের। এ দেশে প্রতি এক হাজার নাগরিকের জন্য রয়েছেন এক জন করে চিকিৎসক। সেই হিসেব ধরলে সাড়ে সাত লক্ষেরও বেশি মানুষ চিকিৎসকহীন হলেন বলাই যায়। এর পরেও কিন্তু অনেকের মাস্ক থুতনিতে এসে নামছে। তথাকথিত শিক্ষিত লোকজনও দেখি, মাস্ক নামিয়ে কথা বলেন বা হেঁচে নেন। পকেটে স্যানিটাইজ়ার রাখা নাগরিকদের খুঁজতে তো দূরবীনে চোখ রাখতে হয়।

পরিবারকে কার্যত ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়েই কর্তব্য করছি আমরা, প্রথম সারির যোদ্ধারা। অথচ, যাঁদের জন্য এই লড়াই, তাঁদের বড় অংশেরই সমাজের প্রতি তো দূর, নিজের পরিবারের প্রতিও ন্যূনতম দায়িত্ববোধ নেই। আমি নিজে, আমার ছ’বছরের ছেলে আর মা যে দিন একসঙ্গে পজ়িটিভ হয়েছিলাম, সে দিন থেকেই এই চিন্তাগুলো মাথায় ঘুরছিল। যমে-মানুষে টানাটানির পরে ফিরিয়ে এনেছি মাকে। একটা করে দিন যেন এক-একটা অন্ধকার যুগ পেরোচ্ছিলাম।

অ্যাপোলো গ্লেনেগলস হাসপাতালের ক্যানসার চিকিৎসক আমি। প্রতিদিনের মতোই হাসপাতালে যাচ্ছিলাম সে দিন। কাজে বেরোনোর জন্য তৈরি হওয়ার সময়েই টের পেলাম ডিয়োডোর‌্যান্টের গন্ধ উবে গিয়েছে। তাতেই বিপদের গন্ধ পেলাম। হাসপাতালে ঢুকেই কোভিড পরীক্ষার ব্যবস্থা করে মা, ছেলে আর পরিবারের সঙ্গী দিদিকে আনিয়ে পরীক্ষা করাই। বাড়ি ফিরে নিজে আইসোলেশনে চলে যাই। অনুমান করেছিলাম, বিপদ আমার হাত ধরেই ঢুকেছে। ওই সন্ধ্যায় রিপোর্ট আসে। দিদি নেগেটিভ, কিন্তু আমরা তিন জনই পজ়িটিভ। অথচ, গন্ধ চলে যাওয়া ছাড়া তেমন কিছু উপসর্গ ছিল না আমার।

তবে দিন পাঁচেক ধরে অল্প সর্দি ছিল, আর মাঝেমধ্যে হাঁচি হচ্ছিল। শীতকাল, তাই এটা স্বাভাবিক ধরেই চলছিলাম। অন্য দু’জনের সেই উপসর্গও ছিল না। বাড়ি পাঠিয়ে দিলাম কাজের দিদিকে। দিন কয়েক পর থেকে মায়ের শরীরে অক্সিজেনের
পরিমাণ কমতে শুরু করল। বাগুইআটির একটি বেসরকারি হাসপাতালে মাকে ভর্তি করি ৩০ নভেম্বর। অবস্থার অবনতি হলে ৭ ডিসেম্বর আমার হাসপাতালেই আইসিইউ শয্যার ব্যবস্থা করে সেখানে নিয়ে আসি। ১১ দিন পরে বাড়ি ফেরেন মা। মাঝের সময়টা বিনিদ্র রজনী কেটেছে। কল্যাণীতে থাকা বৃদ্ধ বাবা এবং আমাদের কাছে সেই বিভীষিকা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। কোভিডের সেই ভয়াবহ ধাক্কা মা এখনও বয়ে চলেছেন।

আমার স্বামী বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক। ফলে দিনের লড়াইটা আমাকে একাই সামলাতে হয়। তাই ছবি আঁকার শখ থাকলেও এখন সব বন্ধ। প্রতিদিন হাসপাতাল আর রোগী সামলে বাড়ি ফেরার পরে ছেলেকে পড়িয়ে আর মায়ের সঙ্গে সময় কাটিয়েই মন ভাল হয়ে যায়। কখনও কখনও রাত জেগে বই পড়তে পারি। প্রথম দিকে কষ্ট হলেও এখন অক্ষরে অক্ষরে নিয়ম মেনে চলতে আর তেমন সমস্যা হয় না।

আলাদা করে বলতেই হবে প্রতিবেশীদের কথা। যখন চিকিৎসক হিসেবে ডিউটিতে যাই বা যখন সংক্রমিত হয়েছিলাম, চিনার পার্কের এই আবাসনের বাসিন্দারা তখন অনেক সাহায্য করেছেন। তাঁদের কাছে আমরা চিরকৃতজ্ঞ। এমনই বেঁধে বেঁধে থাকুন সবাই।

অথচ, জীবন যে ক্ষণস্থায়ী, তা ভুলে যাই। বিধি ভাঙা তো আমাদের মজ্জাগত। এ ছাড়া, এটা ওর কেন আছে, এ তো আমার পাওয়ার কথা— অনর্থক এ সবে বেহিসেবি হয়ে জীবনকে আর ছোট করবেন না। জরুরি বিষয় নিয়ে ভাবুন। তাতেই নিস্তরঙ্গ কেটে যাবে এই জীবন।

(লেখক একজন চিকিৎসক)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

doctor coronavirus
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE