পাদরিবাবু কোথায় গেলেন? বাংলার গির্জার যাজক বা পুরোহিতমশাইয়ের আজও খোঁজ পড়ে এ ভাবেই। তবে, আজকের কলকাতার প্রাচীনতম প্রোটেস্ট্যান্ট গির্জা, লালবাজার পাড়ার ওল্ড মিশন চার্চে কথাটা পুরোপুরি খাটবে না। অ্যাসোসিয়েট ভিকার মৌমিতা বিশ্বাস বলেন, “পাদরি হলেও আমি তো আর বাবুহতে পারব না! আমায় রেভারেন্ড বলুন, পাস্টর বলুন, শুধু মৌমিতা বললেও ক্ষতি নেই!”
গির্জার অন্যতম ট্রাস্টি, বিশপ প্রবালকান্ত দত্ত রয়েছেন ভিকার হিসেবে। এ গির্জার ২৫৫ বছরের ইতিহাসে অ্যাসোসিয়েট ভিকার হিসেবে প্রথম নারী মৌমিতাই। হিন্দুদের মধ্যে গুটিকয়েক মহিলা পুরোহিত শাস্ত্রচর্চা করে, নানা আপত্তি ঠেলে উঠে এসেছেন। মেয়েদের নমাজ পরিচালনা করেন, এমন মহিলা ইমামও বিরল। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পরিচালনায় মেয়েদের পুরোভাগে রাখা নিয়ে খ্রিস্টান সমাজেও জড়তা রয়েছে। তবু খাস কলকাতার প্রধান একটি গির্জায় যাজক হিসেবে উঠে এসেছেন রেভারেন্ড মৌমিতা। এই গির্জার সেক্রেটারি অঞ্জলি শিকদার। পুরুষ এবং মহিলা পুরোহিত, আধিকারিকদের মধ্যে ভারসাম্য রেখে গির্জার কর্মকাণ্ড মসৃণ ভাবেই চলছে বলে জানালেন চার্চ কমিটির সদস্য অজিত শিকদার।
ঈশ্বর সেবায় মেয়েরা ব্রাত্য নন, তা বলা হয়েছে নিউ টেস্টামেন্টে জিশুর বাণীতে। ধর্মাচরণের পরিসরেও মেয়েরা অর্ধেক আকাশ বলে আজকাল অনেকে মানছেন খ্রিস্টীয় সমাজে। মৌমিতা কৃতজ্ঞ, ওল্ড মিশন চার্চের ট্রাস্টি, ভেস্ট্রি কমিটি (আধিকারিক) সব সময়ে গির্জার কর্মকাণ্ডে মেয়েদের এগিয়ে দিতে সাহায্য করছেন। গির্জার হোলি কমিউনিয়ন, দীক্ষা, কারও শেষকৃত্যে সহায়তাও করেছেন তিনি। গির্জার বাইরে বিয়েতেও পৌরোহিত্য করেন। তবে, মৌমিতার কথায়, “গির্জার সদস্যদের আধ্যাত্মিক তাগিদ বা মানসিক কষ্টে পাশে থাকাটাও পাদরিদের খুব বড় কাজ। মনে হয়েছে, কেউ কেউ মায়ের মতো বা মেয়ের মতো ভেবে অনেক কথা বলে অকপটে সান্ত্বনা খুঁজেছেন। দুঃখী, কমবয়সি বা অসুস্থ, বয়স্কদের পাশে থাকা গির্জার কর্তব্য।”
সেন্ট জ়েভিয়ার্স কলেজের প্রাক্তনী মৌমিতা কলকাতার বিশপ কলেজ, আমেরিকার পিটসবার্গ থিয়োলজিক্যাল সেমিনারিতে পড়াশোনা করেছেন। শিলংয়ে চার্চ অব নর্থ ইন্ডিয়ার ডায়োসিস অব নর্থ-ইস্ট ইন্ডিয়ায় তিনি পাদরি হন ৮-৯ বছর আগে। কিশোরী কন্যার মা মৌমিতা এখন সেনেট অব শ্রীরামপুরে গৃহ-হিংসায় নির্যাতিতাদের জন্য গির্জার কর্তব্য নিয়ে ডক্টরেট করছেন। বড়দিনের আগমন কাল (অ্যাডভেন্ট সিজ়ন) জুড়ে গির্জা পরিষ্কার, ক্রিসমাস ট্রি সাজানো থেকে বৃদ্ধাশ্রমে দুঃখিনীদের পাশে থাকার উদ্যোগেও সবার সঙ্গে পুরোভাগে তিনি।
ক্লাইভের আমলের গির্জা ওল্ড মিশন চার্চের প্রতি পাথরে অমূল্য ইতিহাস জড়িয়ে। এর আগে সিরাজের হামলার সময়ে ক্ষতি হয় তৎকালীন সন্ত অ্যানের গির্জার। সুইডিশ যাজক কিয়েরনান্ডরের চেষ্টায় বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রোটেস্ট্যান্টদের জন্য এই গির্জাটির পত্তন হয়। রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় এ গির্জার প্রথম বাঙালি পাস্টর। ১৮৪৩-এর ৯ ফেব্রুয়ারি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ধর্মান্তরণও হয় এই গির্জাতেই। ১৮৯৭-এর ভূমিকম্পে চুড়োটি ভাঙলেও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে এই উপাসনালয়। অ্যাঙ্গলিক্যান চার্চের এ গির্জার অনুষ্ঠানে এখনও বেজে ওঠে উনিশ শতকীয় পাইপ অর্গ্যান। শ’দুয়েক সদস্যের মধ্যে বুড়োবুড়িরা অনেকেই কাল, বৃহস্পতিবার বড়দিনের প্রার্থনায় আসবেন। ইতিহাস, ঐতিহ্যের এই অঙ্গনেই মাত্রা জুড়ছে নারীর ক্ষমতায়নের ছোঁয়াচ।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)