Advertisement
E-Paper

প্ল্যাটফর্মের স্কুল থেকে পড়েই মাধ্যমিকে গুড়িয়া

দমদম স্টেশনের পাশে স্কুলগুলির বাইরে ঘুরতে দেখা যেত একরত্তি মেয়েটিকে। লালচে, উসকোখুসকো চুল। খালি গা, পরনে ছেঁড়া একটা প্যান্ট।

অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:২১
মগ্ন: পড়ায় ব্যস্ত গুড়িয়া। সোমবার। ছবি: শৌভিক দে

মগ্ন: পড়ায় ব্যস্ত গুড়িয়া। সোমবার। ছবি: শৌভিক দে

দমদম স্টেশনের পাশে স্কুলগুলির বাইরে ঘুরতে দেখা যেত একরত্তি মেয়েটিকে। লালচে, উসকোখুসকো চুল। খালি গা, পরনে ছেঁড়া একটা প্যান্ট। মাঝেমধ্যে টিকিট কাউন্টারের সামনে হাত পেতে পয়সা নিতে দেখা যাওয়া মেয়েটিকে কেউ আমল দিত না।

সেই মেয়েই এক দিন স্কুল ফেরতা এক ছাত্রীর হাত ধরে বলেছিল, ‘‘তোমাদের দিদিমণির কাছে নিয়ে যাবে? আমিও পড়ব।’’ দমদম জংশন স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের চাতালে পড়াশোনা করে গুড়িয়া মাহাতো নামের সেই মেয়েটিই আজ, মঙ্গলবার মাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছে।

সিঁথির মোড়ে স্মৃতি কস্তুরবা কন্যা বিদ্যাপীঠ থেকে পরীক্ষায় বসছে সে। পরীক্ষাকেন্দ্র বরাহনগর শিক্ষা সদন হাইস্কুল। মেধাবী ছাত্রীটি যে ভাল ফল করবে, তা নিয়ে নিশ্চিত দিদিমণি এবং অন্য ছাত্রীরাও। ‘বড়’ পরীক্ষার আগে তাই গুড়িয়াদিকে জ্যামিতি বাক্স বা ‘সাজেশান’ ফোটোকপি করে এনে দিচ্ছে প্ল্যাটফর্মের সহপাঠী দোয়েল, টুনটুনিরাই।

‘‘এটাও আসতে পারে’’— মনে করিয়ে দিয়ে গুড়িয়াকে অঙ্ক, ইংরেজি দেখিয়ে দিচ্ছেন প্রীতিকুমারী। এই প্ল্যাটফর্মের স্কুল থেকেই গত বছর উচ্চ মাধ্যমিকে প্রথম বিভাগে পাশ করে এখন কলেজে পড়ছেন প্রীতি। তাঁর হাত ধরেই বছর দশেক আগে প্ল্যাটফর্মে পড়তে এসেছিল ছোট্ট গুড়িয়া।

আরও পড়ুন: মাধ্যমিকে নকল রুখতে পরীক্ষাকেন্দ্রের জানলায় বসানো হয়েছে জাল!

দিদিমণির কথায়, সেই গুড়িয়াই এখন স্কুলের ‘সেরা ছাত্রী’। মিতভাষী, মিষ্টি ব্যবহারের গুড়িয়াকে ভালবাসেন সবাই। আর গুড়িয়া ভালবাসে সুকুমার রায়ের লেখা। প্রিয় বিষয় ভূগোল। কেন? ‘‘পৃথিবীর কত কিছু, দেশ, প্রকৃতি সম্পর্কে জানা যায়’’— দমদম স্টেশনের এককোণে বসে বলে সে।

প্রীতি, গুড়িয়াদের সেই দিদিমণি কান্তা চক্রবর্তীর প্ল্যাটফর্মের স্কুলে এখন রয়েছে ২০ জনেরও বেশি পড়ুয়া। এক দিকে ট্রেন, অন্য দিকে মেট্রোর যাত্রীদের জন্য তিল ধারণের জায়গা থাকে না দমদম স্টেশনে। তাই প্ল্যাটফর্মে নয়, প্রতিদিন বিকেলে পড়তে বসা হয় স্টেশন সংলগ্ন চাতালের এক কোণে, শৌচাগারের পাশেই। সেখানে খোলা আকাশের নীচে একসঙ্গে এতগুলি মেয়েকে পড়াশোনা করতে দেখে পড়াতে, আঁকা শেখাতে, গান শেখাতে এগিয়ে এসেছেন আরও কয়েক জন।

পড়তে বসার পলিথিনের আসন পেতে দিতে, পানীয় জল এনে দেওয়ার কাজে এগিয়ে আসেন স্থানীয় হকারেরাও। কেবল পড়াশোনা, গান কিংবা ছবি আঁকাই নয়, নিয়ম করে প্রতিদিন খেলাধূলার প্রশিক্ষণ নিতে হয় প্রতিটি মেয়েকেই। এই মেয়েরাই ক্যারাটে, সাঁতারে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় পদকও পেয়েছে। স্টেশনের পাশেই ছোট্ট একটি ঘরের কোণে বাক্সবোঝাই হয়ে রয়েছে সোনা, রূপো আর ব্রোঞ্জের সেই সব পদক।

সেই ছোট ঘরেই রাতে কোনও মতে ঠাসাঠাসি করে ঘুমোয় মেয়েরা। গভীর রাত পর্যন্ত জেগে পড়াশোনা করে শুধু গুড়িয়া। পাশে বসে কান্তা দিদিমণি বলেন, ‘‘স্কুল থেকে ছুটি নিয়েছি। পরীক্ষার দিনগুলোয় ওর জন্য একটু স্পেশ্যাল কেয়ার নিতে হচ্ছে।’’ কেমন সেই বিশেষ যত্ন?

গুড়িয়ার জন্য রোজ একটা করে আপেল আসছে। ‘‘সবার জন্য কিনতে পারি না’’— কেঁদে ফেলেন কান্তা দিদিমণি। বলেন, ‘‘সে দিন দেখি, আপেলের অর্ধেকটা ময়নাকে খাইয়ে দিচ্ছে গুড়িয়া।’’ প্ল্যাটফর্মের স্কুলে সবার চেয়ে ছোট, নতুন সদস্য এখন ময়নাই।

বড় হয়ে দিদিমণির মতোই ময়নাদের পড়াতে চায় গুড়িয়া।

Education Girl Dumdum Station Madhyamik
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy