বেহাল: টালির চালে ফুটো, জীর্ণ কাঠের বিম। এমনই অবস্থা সরোজনলিনী মিরপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের। নিজস্ব চিত্র
পড়ুয়ার সংখ্যা ২৭২। শিক্ষিকার সংখ্যা ৭! তাঁদের মধ্যে যিনি সবচেয়ে পুরনো, তিনি চাকরিতে ঢুকেছিলেন দেড়শো টাকা বেতনে। ৩৫ বছর চাকরি করার পরে সেই অঙ্কটা দাঁড়িয়েছে দু’হাজার টাকায়। এটাই সর্বাধিক। সব চেয়ে কম বেতন ৮০০ টাকা। এমনই অবস্থায় চলছে দক্ষিণ ২৪ পরগনার সরোজনলিনী মিরপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়।
অভিভাবকদের অভিযোগ, স্কুল অবশ্য চলে নামেই। ভাঙাচোরা ক্লাসঘরে নেই বেঞ্চ। মাথার উপরে ভাঙা টালি থেকে বাঁচতে দেওয়া রয়েছে মোটা প্লাস্টিকের আচ্ছাদন। বৃষ্টিতে ভেসে যায় সব। এ ভাবেই চলে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পঠনপাঠন। আরও অভিযোগ, স্কুলের পরিচালন সমিতি সরোজনলিনী দত্ত মেমোরিয়াল অ্যাসোসিয়েশনের কাছে একাধিক বার ক্লাসঘর সংস্কারের আবেদন জানানো হলেও কাজ হয়নি। বর্তমানে একটি হলঘরেই চলে তিনটি শ্রেণির ক্লাস। শিক্ষিকারাও অভিযোগ করছেন, তাঁদের বেতন হাতে পেতে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ গড়িয়ে যায়।
স্থানীয়েরা জানাচ্ছেন, এক সময়ে স্কুলের যথেষ্ট নাম ছিল। অ্যাসোসিয়েশনের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট আরতি দত্তের সময় থেকে এলাকার উন্নয়ন এবং শিক্ষার প্রসারে কাজ করছিল সংস্থাটি। ২০০৭ সালে শুরু হয় মিরপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়। নার্সারি-১ থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনার ব্যবস্থা আছে এখানে। সকাল ১১টা থেকে সাড়ে তিনটে পর্যন্ত চলে স্কুল। বিনামূল্যে পড়ুয়াদের স্বাস্থ্য পরীক্ষারও ব্যবস্থা আছে। কিন্তু অভিযোগ, গত কয়েক বছরে বন্ধ হয়েছে বিভিন্ন প্রকল্প। পাশাপাশি স্কুলের প্রতি অবহেলাও প্রকট হয়েছে। যার জেরে অভিভাবকদের আশঙ্কা, যে কোনও সময়ে স্কুল বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
প্রধান শিক্ষিকা প্রণতি বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘চলতি বছরের গোড়ায় বালিগঞ্জে সংস্থার সদর দফতরে আমাদের ডেকে পাঠিয়ে বলা হয়, এ বার থেকে প্রতিটি শ্রেণির জন্য এক জন করেই শিক্ষিকা থাকবেন। তিনিই ১১টা থেকে সাড়ে তিনটে পর্যন্ত পড়াবেন। অতিরিক্ত হিসেবে থাকবেন এক জন শিক্ষিকা, যিনি বাচ্চাদের পুষ্টিকর খাবার দেওয়া এবং তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার দিকটি (‘সেফ সাইড’ প্রকল্প) দেখভাল করবেন। আবার কোনও শিক্ষিকা অনুপস্থিত থাকলে তাঁর কাজও করবেন। কিন্তু অভিভাবকেরা এই ব্যবস্থা মানতে চাইলেন না।’’
মাসখানেক আগে বালিগঞ্জের অফিস থেকে স্কুল পরিদর্শনে এসেছিলেন সংস্থার আধিকারিকেরা। স্কুলের পরিকাঠামো এবং এক শ্রেণি, এক শিক্ষিকা নীতি নিয়ে তাঁদের কাছে অভিযোগ জানান অভিভাবকেরা। তাঁদের বক্তব্য, এর পরেই কোনও কারণ ছাড়াই বন্ধ করে দেওয়া হয় রুগ্ণ শিশুদের পুষ্টিকর খাবার দেওয়া এবং পড়ুয়াদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা। এক অভিভাবক বর্ণালী ঘোষ বলেন, ‘‘একই ঘরে তিনটি ক্লাস চলায় সমস্যা তো হচ্ছেই। তার উপরে এক জন শিক্ষিকার কাছে টানা সাড়ে চার ঘণ্টা পড়তে গিয়ে বাচ্চারা মন দিতে পারছে না। বিশেষত, ওই শিক্ষিকা অনুপস্থিত থাকলে সমস্যা হচ্ছে আরও বেশি। কারণ পরিবর্তে যিনি পড়াচ্ছেন, তাঁর কোন বিষয় কতটা পড়ানো হয়েছে, সেটা বুঝে উঠতেই সময় লেগে যাচ্ছে।’’
স্কুল পরিচালনায় সমস্যার কথা মেনে নিয়েছেন সরোজনলিনী দত্ত মেমোরিয়াল অ্যাসোসিয়েশনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট সুমিতা সান্যাল। তিনি বলেন, ‘‘এটা লাভজনক সংস্থা নয়। তাই শিক্ষিকাদের বেতন এত কম। তা বাড়াতে হলে পড়ুয়াদের ফি বাড়াতে হবে।’’ পাশাপাশি তিনি আশ্বাস দিয়েছেন, ‘‘আগামী মাসেই স্কুলের বাড়ি মেরামত করা হবে। কিছু সমস্যার কারণে সেফ সাইড প্রকল্প এবং পড়ুয়াদের চিকিৎসা পরিষেবা বন্ধ আছে। নতুন বছরে দুটোই শুরু হবে।’’
সুমিতাদেবীর আরও বক্তব্য, স্কুল বন্ধের আশঙ্কা অমূলক। যোগাযোগের অভাবে কিছু সমস্যা হচ্ছে। তা মেটাতে শিক্ষিকাদের তরফে দু’জন, অভিভাবকদের দু’জন এবং পরিচালন সমিতির দু’জন প্রতিনিধির উপস্থিতিতে প্রতি দু’-তিন মাস অন্তর প্রধান কার্যালয়ে বৈঠক করা যেতে পারে। এক শ্রেণিতে এক শিক্ষিকা নীতি প্রসঙ্গে তাঁর দাবি, প্রাথমিকের নিয়ম মেনেই এমন হচ্ছে। যদিও স্কুলশিক্ষা দফতরের এক কর্তা জানাচ্ছেন, এমন কোনও নিয়ম নেই। তা ছাড়া বিরতি না দিয়ে একটানা ক্লাস নেওয়া শিক্ষার অধিকার আইনকে লঙ্ঘন করে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy