পাখির চোখ: এক ঝলকে ধর্মতলা চত্বর। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
‘‘এ শহরটার কোনও ডিসিপ্লিন নেই। ভিড় থিকথিক করছে। জনসংখ্যা হঠাৎ অস্বাভাবিক বেড়েছে। ফুটপাত সব দখল হওয়া।’’ গলায় আফশোসের সুর নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন বর্ষীয়ান ইতিহাসবিদ রজতকান্ত রায়।
রজতবাবুর মতো অনেকেরই মতে, একটি পুরনো শহর হঠাৎই পাল্টে নতুন চেহারা নিয়েছে। যেখানে জন-বিস্ফোরণ, যান-বিস্ফোরণ, দিল্লির সঙ্গে পাল্লা দেওয়া দূষণ, পাড়া-সংস্কৃতি ভুলে যাওয়া, উড়ালপুল-আতঙ্ক, ধর্মীয় বিভাজনের আতঙ্ক, নিজস্ব ঐতিহ্য ধরে রাখতে না পারার মতো অক্ষমতা রয়েছে। যেমন রয়েছে নতুন রং করা উড়ালপুল বা ঐতিহ্যশালী ভবনের দেওয়াল পান-গুটখার পিকে ময়লা হয়ে যাওয়া, যেখানে যত ‘প্রস্রাব করিবেন না’ বোর্ড ঝোলানো, সেখানেই তত বেশি মূত্রত্যাগের চিত্র। ‘ডিসিপ্লিন’ থাকলে এ সব হয় না কি!
মেট্রোর সম্প্রসারণ হচ্ছে তো হচ্ছেই। কবে শেষ হবে, কেউ জানে না। ‘বিপন্ন’ আদিগঙ্গা কবে দূষণমুক্ত হবে, তা-ও জানা নেই কারও। সবই যেন হচ্ছে, হবে। ‘‘ভাস্কর চক্রবর্তীর ‘আমাদের স্বর্গ নেই, স্যারিডন আছে’ কবিতার পংক্তি একটু পাল্টে যদি বলি, ‘আমাদের বর্তমান নেই, শুধু ভবিষ্যৎ আছে।’, তা হলে সেটা কি ভুল হবে?’’, বললেন উল্টোডাঙার বাসিন্দা অরুণিমা রায়। কিন্তু সেই ভবিষ্যতে খাঁটি বাংলাটা থাকবে কি না, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। ভাষাবিদ পবিত্র সরকার বলছিলেন, ‘‘হিন্দি, ইংরেজি মিলিয়ে একটা অদ্ভুত বাংলা ভাষা তৈরি হয়েছে। সব স্কুলগুলো ইংরেজি মাধ্যম হয়ে যাচ্ছে!’’
ফলে বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় রয়েছে, যেমন রয়েছে রোজ রাজনৈতিক মিটিং-মিছিল-যানজট, সঙ্গে টেলিভিশনের ব্রেকিং নিউজ, ‘অ্যাম্বুল্যান্সও আটকে রয়েছে ভিড়ে’! রাস্তায় লাগাতার হর্ন, অহেতুক গালাগালি-চিৎকার। নাট্যকর্মী সোহিনী সেনগুপ্তের কথায়, ‘‘কোথাও অসহিষ্ণুতা বেড়ে গিয়েছে। সকলে যেন দ্রুত রেগে যাচ্ছে বা চটজলদি পরিচিতি চাইছে।’’
দ্বাদশ শ্রেণির পরে ভিন্ রাজ্যে পড়তে যেতে চান তিয়াষ মুখোপাধ্যায়। সদ্য আঠেরোয় পা-রাখা তিয়াষ বলেন, ‘‘এ শহরে সুযোগ খুব কম।’’ দক্ষিণ কলকাতার বাঘা যতীনের বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব রুমা রায়ও সেই সুরেই বলেন, ‘‘আমার নাতিও বাইরেই চলে যেতে চায়। খোঁজ নিয়ে দেখুন, যাঁরাই নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবছেন, তাঁরাই কিন্তু শহরটা ছেড়ে পালাচ্ছেন।’’
তা হলে কি এ শহরকে আর ভালবাসা যায় না?
‘‘প্রেমিকা পাল্টে গেলেও কি তাকে আমরা ছাড়তে পারি? পারি না তো। প্রেম তো আর হারিয়ে যায় না।’’ পাল্টা প্রশ্ন লেখক স্মরণজিৎ চক্রবর্তীর। কবি জয় গোস্বামীরও যেমন দৃঢ় উত্তর, ‘‘যতই পাল্টাক এ শহর, একে ভাল না বেসে উপায় নেই।’’ তাঁদের মতো শহরবাসীদের একটি বড় অংশই মনে করেন, ‘‘হয়তো আমার মায়ের থেকে অনেক ভাল রান্না করেন ভালকাকিমা বা আমার প্রেমিকার থেকে অনেক বেশি সুন্দরী পাড়ার তাপসদার প্রেমিকা। আমার বাবার থেকে অনেক বেশি টাকা দাসবাবুর।’’
তবু, রাত্তিরে বাড়ি ফিরে মা খেতে না দেওয়া পর্যন্ত খাওয়াটা কী রকম খাপছাড়া থাকে। দুপুরে নির্দিষ্ট সময়ের পরে প্রেমিকার একটা মেসেজ না এলে মনে হয়, কী সে এত ব্যস্ত বাপু যে এক বার খোঁজ নেওয়া যাচ্ছে না! ফলস্বরূপ, তিন দিন কথা বন্ধ। বাবার শরীরটা ভাল না থাকলে একতলা বাড়ির পুরোটাই কেমন যেন থমথম করে।
শহরবাসীর কাছে, এ যেন শিকড়ের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়েছে সারাটা অরণ্যে। এ যেন একটাই বারান্দা মিলেমিশে গিয়েছে। এ যেন একটাই আলোর রেখা ঢেকে দিচ্ছে সমস্ত অন্ধকার। কিছু না হয়ে থাকাটাই তো একসঙ্গে থাকা। কিছু হলে বোঝা যায়, কে কতটা জুড়ে রয়েছে। শ্বাস নিই বুঝি, শ্বাসকষ্ট হলে। নইলে কখন শ্বাস নিচ্ছি কে আর তার খেয়াল রাখে।
তাই ধোঁয়ার মধ্যে দাঁড়িয়েই ফুচকাওয়ালার হাতে মাখা আলু, দশমীর মন খারাপ করা বাবুঘাট, শ্যামবাজারে একলা ফেরা ট্রাম, প্রথম মেট্রো, পুরনো পাড়ার নির্জন গলি, চৌরাস্তার চায়ের ঠেক, ছোটবেলায় জমানো বাসটিকিট, ভিক্টোরিয়ার মন কেমন করা শীতের রোদ্দুর, কোনও কারণ ছাড়াই হেসে ওঠা নন্দন, রোজ গুরুদায়িত্ব নিয়েও একলা থাকা হাওড়া ব্রিজ, রঙিন ধর্মতলা... সব মিলেমিশে কী যেন একটা রয়েছে। কলকাতা-গবেষক হরিপদ ভৌমিক বলছিলেন, ‘‘এ শহরের প্রতিটা ইটে ইতিহাস রয়েছে। আর কোনও শহরে এমনটা আছে বলে জানা নেই।’’
তাই হাজারো সমস্যার পরেও ভালবাসার প্রশ্নে সকলে যখন এক বাক্যে বলেন, ‘‘এক বার এ শহরকে ভালবাসলে সে টান থেকেই যাবে। কারণ, বাবা-মায়ের কোনও সমস্যা থাকলেও তাঁদের কি ছেড়ে যাওয়া যায়? এখানেই তো আমাদের শিকড়!’’
তখন পুরনো শহরে দাঁড়িয়েই ফের নতুন ভাবে বিশ্বাস হয়, সময় হয়তো পাল্টেছে, কিন্তু মানবজমিন একই রয়েছে।— শহরের প্রতি অমোঘ প্রেমের মতো, শিকড়ের ঘ্রাণের মতো, মায়ের হাতের রান্নার মতো, বান্ধবীর মেসেজের মতো, বাবার চিন্তাটুকুর মতো, হাজারদুয়ারি ভালবাসার মতো।
কারণ, ওই যে সেই কবেই তো কবীর সুমন লিখেছিলেন,—‘এই শহর জানে আমার প্রথম সবকিছু/পালাতে চাই যত সে আসে আমার পিছু পিছু...’
সত্যি। ‘এই শহর জানে আমার প্রথম সব কিছু’!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy