E-Paper

৮১ শতাংশ নম্বর পেয়ে বেথুনকে জিতিয়ে দিল হুইলচেয়ার নির্ভর শ্রেয়া

মা-বাবার সঙ্গে এ দিন উচ্চ মাধ্যমিকের মার্কশিট নিতে এসেছিল শ্রেয়া। বাবা সঞ্জয় সাহার নিমতলা ঘাট স্ট্রিটেই একটি ছোট মুদির দোকান আছে।

শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০২৫ ০৭:৪৭
অভিনন্দন: উচ্চ মাধ্যমিকে ৮১ শতাংশ নম্বর পাওয়া শ্রেয়া সাহার হুইলচেয়ার ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে

অভিনন্দন: উচ্চ মাধ্যমিকে ৮১ শতাংশ নম্বর পাওয়া শ্রেয়া সাহার হুইলচেয়ার ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে নবম স্থানাধিকারী সৃজিতা দত্ত। বৃহস্পতিবার, বেথুন স্কুলে। ছবি: সুমন বল্লভ

বেথুন কলেজিয়েট স্কুলের খোলা চাতালের দিকে তখন সদ্য উচ্চ মাধ্যমিক পাশ শ্রেয়া সাহার হুইলচেয়ার ঠেলে নিয়ে যাচ্ছিল তারই বন্ধু সৃজিতা দত্ত। শ্রেয়াকে ঘিরে তার বন্ধু ও শিক্ষিকারা তখন হাততালি দিচ্ছে।

নিমতলা ঘাট স্ট্রিটের বাসিন্দা, সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত শ্রেয়ার সতেরো বছরের জীবনের পুরোটাই হুইলচেয়ার নির্ভর। স্কুলেও আসে সে হুইলচেয়ারে। এমন পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করেও উচ্চ মাধ্যমিকে ৮১ শতাংশ নম্বর পেয়েছে শ্রেয়া। তার মা জোনাকি সাহা বললেন, ‘‘মাধ্যমিকে ৭২ শতাংশ নম্বর পেয়েছিল মেয়ে। উচ্চ মাধ্যমিকে ৮১ শতাংশ পেয়ে আরও একটু ভাল করল।’’

শ্রেয়ার বন্ধু, উচ্চ মাধ্যমিকে নবম হওয়া সৃজিতার কথায়, ‘‘আমি নবম হয়েছি ঠিকই। কিন্তু শ্রেয়া যে প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে ৮১ শতাংশের উপর নম্বর পেল, তার জন্য আমরা সবাই ওকে কুর্নিশ জানাচ্ছি।’’ একটু দূরে দাঁড়ানো শ্রেয়ার মা জোনাকির চোখে তখন জল।

মা-বাবার সঙ্গে এ দিন উচ্চ মাধ্যমিকের মার্কশিট নিতে এসেছিল শ্রেয়া। বাবা সঞ্জয় সাহার নিমতলা ঘাট স্ট্রিটেই একটি ছোট মুদির দোকান আছে। সঞ্জয় বলেন, ‘‘মেয়ে টেস্ট পরীক্ষা কিন্তু নিজে লিখে দিয়েছে। মাথা ঝুঁকিয়ে এক গালে পেন চেপে রেখে অন্য হাত ব্যবহার করে লিখতে পারে। তবে উচ্চ মাধ্যমিকে রাইটার নিয়েই লিখেছে।’’

বেথুন স্কুলের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষিকা শবরী ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘অসম্ভব মনের জোর শ্রেয়ার। রোজ ওর সঙ্গে মা স্কুলে আসতেন। ক্লাসের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতেন তিনি।’’ সঞ্জয় বলেন, ‘‘যে অটো করে শ্রেয়া স্কুলে আসত, সেই অটোচালক লবকুশ সাউকেই বা ভুলি কী ভাবে? শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষায় লবকুশ ওকে রোজ স্কুলে নিয়ে এসেছেন। হুইলচেয়ার তুলে ক্লাস পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছেন।’’ নিমতলা-মানিকতলা রুটে অটো চালান লবকুশ। তিনি বলেন, ‘‘শ্রেয়া আমার মেয়ের মতো। আগে ওকে স্কুলে পৌঁছে দিতাম। তার পরে রুটে ভাড়া খাটতে শুরু করতাম। ছুটির পরেও শ্রেয়াকে স্কুল থেকে বাড়ি দিয়ে আসতাম।’’

উচ্চ মাধ্যমিকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস এবং কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশন ছিল শ্রেয়ার বিষয়। ৪০৪ নম্বর পেয়ে গ্রেড ‘এ প্লাস’ পেয়েছে সে। দর্শন-সহ মোট তিনটি বিষয়ে লেটার পেয়েছে শ্রেয়া। জোনাকি বলেন, ‘‘মেয়ে তো দাঁড়াতে বা বসতে পারে না। ওর পড়াশোনা বা সব কিছুই হুইলচেয়ারে বসে অথবা বিছানায় শুয়ে। পরীক্ষার আগে রাত ২টো পর্যন্ত পড়ে আবার ভোরে উঠত মেয়েটা। মাধ্যমিকের থেকেও ভাল ফল করার জেদ ছিল ওর।’’ শ্রেয়ার কথায়, ‘‘দর্শন প্রিয় বিষয়। বেথুন কলেজে দর্শন নিয়ে পড়তে চাই।’’

বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংয়ের নাম জানে শ্রেয়া। জানে, ওই বিজ্ঞানী হুইলচেয়ারে বসেই যাবতীয় পড়াশোনা ও গবেষণা করতেন। শ্রেয়া বলল, ‘‘স্টিফেন হকিং তো হুইলচেয়ারে বসেই কত গবেষণা করেছেন! তা হলে আমি কেন হুইলচেয়ারে বসে উচ্চ শিক্ষা নিতে পারব না?’’ পাশে দাঁড়ানো বাংলার শিক্ষিকা সংহিতা চক্রবর্তী বলে উঠলেন, ‘‘ফার্স্ট, সেকেন্ড তো কতই হয়। ও হল প্রকৃত বিজয়ী। আমাদের বেথুন স্কুলকে শ্রেয়াই জিতিয়ে দিল।’’

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bethune Collegiate School

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy