Advertisement
E-Paper

আবেশের অপমৃত্যুতে দুর্ঘটনারই পুলিশি ইঙ্গিত, খুনের তত্ত্বে অনড় পরিবার

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০১৬ ০৪:২০
সানি পার্কের আবাসনে এই পাঁচিল টপকাতে গিয়েই ‘দুর্ঘটনা’। —নিজস্ব চিত্র

সানি পার্কের আবাসনে এই পাঁচিল টপকাতে গিয়েই ‘দুর্ঘটনা’। —নিজস্ব চিত্র

সানি পার্কের আবাসনে আবেশ দাশগুপ্তের অপমৃত্যুর নেপথ্যে শেষমেশ দুর্ঘটনার তত্ত্বই জোরালো হয়ে উঠল পুলিশের তদন্তে।

বৃহস্পতিবার লালবাজারে সাংবাদিক সম্মেলনে একটি সিসিটিভি ফুটেজ পেশ করেন কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা-প্রধান বিশাল গর্গ। তিনি জানান, গত শনিবার সানি পার্কের বহুতলটির লনের কাছে থাকা ওই সিসিটিভি-র ফুটেজ চার দিন ধরে পরীক্ষা করা হয়েছে। তাতে ২০ সেকেন্ডের একটি স্বল্প ফাঁক ছাড়া বাকি সময়ের ঘটনাপ্রবাহ পরিষ্কার। আর সেই পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে গোয়েন্দাদের প্রাথমিক ভাবে মনে হয়েছে, এটি কোনও পূর্ব পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড নয়। বাকি ২০ সেকেন্ডে কী ঘটেছিল, তার জন্য পুলিশের ভরসা প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান। তবে সব মিলিয়ে দুর্ঘটনার তত্ত্বই ক্রমশ প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে বলে লালবাজারের দাবি।

এ দিন গোয়েন্দা-প্রধান বলেন, আবেশের বাঁ হাতের তেলো ও ডান হাতের আঙুলে দু’টো ক্ষত রয়েছে। সে দু’টো পড়ে গিয়ে হয়েছে, না আঘাত ঠেকাতে গিয়ে, তা জানতে ফরেন্সিক-বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নেওয়া হচ্ছে। সেই রিপোর্ট হাতে পেলে তাঁরা চূড়ান্ত ভাবে জানাতে পারবেন, আসলে কী হয়েছিল। ইতিমধ্যে আবেশের মায়ের অভিযোগের ভিত্তিতে খুনের মামলা রুজু করে পুলিশ তদন্তে নেমেছে। ফরেন্সিক রিপোর্ট না-আসা ইস্তক সেই তদন্ত চালু থাকবে বলে পুলিশ কর্তারা জানিয়েছেন।

পুলিশের দেওয়া ‘দুর্ঘটনা’র সম্ভাবনার তত্ত্ব অবশ্য উড়িয়ে দিচ্ছে আবেশের পরিবার। ‘‘পোস্ট মর্টেম আর ফরেন্সিকের পুরো রিপোর্ট আসার আগেই পুলিশ কী ভাবে দুর্ঘটনার তকমা দিয়ে দিল?’’ এ দিন গোয়েন্দা প্রধানের কথা শুনে প্রশ্ন তুলেছেন মৃত কিশোরটির দিদিমা কৃষ্ণা পাল। তাঁর দাবি, ‘‘এটা খুনই। পুলিশের তদন্তকে প্রভাবিত করা হয়েছে।’’ কৃষ্ণাদেবী এ-ও জানান, সুবিচার পাওয়ার জন্য প্রয়োজনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বারস্থ হওয়ার কথাও ভাবছেন তাঁরা।

এ দিন সন্ধ্যায় আবেশের মা ও মামাকে লালবাজারে ডেকে পাঠানো হয়। সিসিটিভি ফুটেজটি দেখানো হয় তাঁদেরও। পরে আবেশের মা রিমঝিম দাশগুপ্ত বলেন, ‘‘ওই ছেলেটি যে আবেশ, সাদা-কালো ফুটেজে তা পরিষ্কার হয়নি। সে যে বোতল হাতে পড়ে যাচ্ছে, তা-ও দেখা যায়নি।’’

পুলিশি তদন্তে জানা গিয়েছে, গত শনিবার সানি পার্কে লেখক অমিত চৌধুরীর মেয়ের জন্মদিনের পার্টিতে মোট ১৯ জন কিশোর-কিশোরী হাজির ছিল। সকালে অমিতবাবুর বাড়িতে জড়ো হওয়ার পরে দুপুরে দু’টি গাড়ি চড়ে তারা বেরোয় টালিগঞ্জের এক ক্লাবে লাঞ্চ সারতে। মাঝ পথে গাড়ি থামিয়ে শরৎ বসু রোডের একটি দোকান থেকে মদ কেনে। কয়েক জন গাড়িতেই মদ খাওয়া শুরু করে।

গোয়েন্দা-প্রধান এ দিন বলেন, টালিগঞ্জের ক্লাবটিতে পৌঁছলেও তাদের কিন্তু ঢুকতে দেওয়া হয়নি। কারণ, পোশাকবিধি ঠিক ছিল না। তখন আনোয়ার শাহ রোডের প্রিন্সটন ক্লাবে গিয়ে সকলে খাওয়া-দাওয়া করে। দুই বন্ধু কার্ডে বিল মেটায়। বেরিয়ে বালিগঞ্জের এক দোকান থেকে ফের তিন বোতল মদ কেনা হয়।

বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ ছেলে-মেয়েরা ফের পৌঁছয় সানি পার্কে। তিন জন ফিরে যায়। কয়েক জন যায় অমিতবাবুর ফ্ল্যাটে। বাকিদের কেউ কেউ বেসমেন্ট লাগোয়া লনে মদ্যপান শুরু করে। তাদেরই মধ্যে ছিল আবেশ।

আবেশ যখন আঘাত পায়, তখন আবাসনের নীচের লনে ছিল সে ছাড়া চার জন। দু’জন দোলনায় দুলছিল, অন্য দু’জন আশপাশে দাঁড়িয়েছিল। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গিয়েছে, আবাসনের বেসমেন্ট লাগোয়া লনটিতে আবেশ হাঁটছে। ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে লন সংলগ্ন ঢালু অংশের দিকে। বাঁ হাতে ধরা একটা বোতল। ঢালের দু’দিকে সিমেন্টের পাঁচিল। আবেশ পাঁচিল টপকে লনে লাফিয়ে পড়ল। হাত থেকে খসে পড়ল বোতলটাও।

এর পরের কুড়ি সেকেন্ড সিসিটিভি কিছু দেখায়নি। কুড়ি সেকেন্ড পরে দেখা যায়, আবেশ রক্তাক্ত অবস্থায় উঠে আসছে। হেঁটে হেঁটে বেসমেন্ট লাগোয়া লনে উঠে এল। তার দিকে নজরে পড়তেই ছুটে গেল বন্ধুরা। সিসিটিভি ফুটেজে এ-ও দেখা গিয়েছে, আবেশ হাত নাড়িয়ে তাদের আশ্বাস দিচ্ছে। বোঝাতে চাইছে, এমন কিছু হয়নি। এর পরে সে একটা পিলারের কাছে বসে পড়ল। ফের উঠে হাঁটল।

রেকর্ড না-থাকা ওই বিশ সেকেন্ডে কী হয়ে থাকতে পারে?

গোয়েন্দাদের প্রাথমিক অনুমান, আবেশ লাফ দিয়ে সিমেন্টের পাঁচিল পেরনোর সময় টাল সামলাতে পারেনি। হাতের বোতলটি পড়ে ভেঙে যাওয়ার পরে সে নিজেও লনের ভেজা মাটিতে পিছলে আছাড় খেয়ে পড়ে। সেই সময়েই ভাঙা বোতলের টুকরোয় আহত হয়। কারণ, এর পরেই সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, আবেশ নিজেই উঠে আসছে এবং তার হাতের বাঁ দিকটা রক্তে ভেজা।

গোয়েন্দাদের দাবি, সেই দৃশ্য দেখেই বন্ধুরা ছুটে গিয়েছিল। আবেশ তখন তাদের আশ্বস্ত করে কিছুটা হেঁটে যায়। উঠে যায় বেসমেন্টের আর এক অংশে। কিছুক্ষণ বাদে সেখানেই লুটিয়ে পড়ে। বমি করে। আধ ঘণ্টাখানেক বাদে যখন তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, ততক্ষণে সে মারা গিয়েছে।

লালবাজার সূত্রে বলা হয়, সানি পার্ক আবাসন থেকে সিসিটিভি ফুটেজটি রবিবারই বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। কিন্তু তার ছবি পরিষ্কার ছিল না। সিআইডি’র সাইবার-বিশেষজ্ঞদের সাহায্যে ফুটেজ পরিষ্কার করিয়ে ফের খতিয়ে দেখা হয়েছে। তার পরে এ দিন তা হাজির করা হয়েছে সাংবাদিকদের সামনে।

এ দিকে শনিবারের পার্টিতে উপস্থিত ১৬ জন কিশোর-কিশোরীর মোবাইল ইতিমধ্যে পুলিশের কব্জায়। সেগুলির মাধ্যমে চালাচালি হওয়া বিভিন্ন বার্তাও উদ্ধার করেছে সিআইডি’র সাইবার সেল। সে সবও দুর্ঘটনার পক্ষেই যাচ্ছে বলে লালবাজারের দাবি। ‘‘ওই মেসেজগুলো থেকেও পরিষ্কার যে, আবেশকে খুনের কোনও পরিকল্পনা তার কোনও বন্ধুর ছিল না।’’— মন্তব্য করেছেন গোয়েন্দা-প্রধান।

Abesh Dasgupta Murder Police CCTV
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy