প্রসূন মুখোপাধ্যায়।
তাঁর সঙ্গে শিল্পকলার সরাসরি কোনও যোগাযোগ রয়েছে, এমন ‘অভিযোগ’ শোনা যায় না। তবু প্রাক্তন পুলিশকর্তা প্রসূন মুখোপাধ্যায় এখন অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসের অছি পরিষদের প্রধান। এমনকী তাঁর দাবি, অ্যাকাডেমিতে সনাতন দিন্দার ভিডিও শো বন্ধের নির্দেশ প্রথম দিনেই দিয়েছিলেন তিনি। যদিও চেয়ারম্যান হিসেবে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার এক্তিয়ারই অ্যাকাডেমির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তাঁর নেই।
অবশ্য কলকাতার প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার প্রসূন মুখোপাধ্যায় এ ভাবে এক্তিয়ারের বাইরে গিয়ে হস্তক্ষেপ করার জন্য অতীতেই শিরোনামে এসেছেন। তিনি কমিশনার থাকাকালীনই রিজওয়ানুরের মৃত্যু হয় এবং আগ বাড়িয়ে সাংবাদিকদের ডেকে প্রসূনবাবু বলেন, ‘ওটা আত্মহত্যার ঘটনা।’ দুই প্রাপ্তবয়স্ক তরুণ-তরুণীর সম্পর্কে পুলিশ ঢুকবে কেন? সে দিনের পুলিশ-প্রধান প্রসূনবাবুর জবাব ছিল, ‘‘পুলিশ যাবে না তো কি পিডব্লিউডি যাবে?’’ পরে ওই ঘটনার প্রেক্ষিতেই তাঁকে কমিশনার পদ থেকে সরতে হয়।
কিন্তু ঢেঁকি যে স্বর্গে গেলেও ধানই ভানে, সেই আপ্তবাক্য আরও এক বার সত্যি প্রমান করে প্রাক্তন পুলিশকর্তা এখন অ্যাকাডেমির শিল্প প্রদর্শনীতে ভিডিও শো বন্ধ করার জন্যও উদ্যোগী হয়েছেন। মঙ্গলবার অ্যাকাডেমিতে প্রদর্শনী চলাকালীন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল বিবেকানন্দ সেতু ভেঙে পড়ার ঘটনা নিয়ে সনাতন দিন্দার ভিডিও। শুক্রবার প্রসূনবাবু নিজেই বলেছেন, তিনিই সেই ভিডিও বন্ধ করতে বলেন।
কেন? তাঁর পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘হুসেনের ছবি নিয়ে প্রদর্শনী হবে বলে ভাড়া নেওয়া হয়েছিল অ্যাকাডেমি। সেখানে কেন বিবেকানন্দ সেতু ভেঙে পড়ার ভিডিও দেখানো হবে?’’
তিনি কি ভিডিওটি দেখেছিলেন? প্রসূনবাবুর কথায়, ‘‘দরকার হয়নি। শুনেছি তো সেতু ভেঙে পড়া নিয়ে ভিডিও। আর্তনাদও শোনা যাচ্ছে।’’
বিশ্ব জুড়ে এখন শিল্পের ধরন দ্রুত বদলাচ্ছে। ভিডিও আর্ট সেখানে সগৌরবে স্থান পায়। এমনকী, বিদেশের বিভিন্ন প্রদর্শনীতে ‘লাইভ’ মডেল রাখার রেওয়াজও চালু হয়েছে। এ সব খবর প্রসূনবাবুর জানা আছে কি না, সে প্রশ্নের জবাব মেলেনি। তবে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, ‘‘সব ভিডিও তো এক নয়। এটা তো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে একটি ঘটনাকে রাজনীতির রং লাগানোর জন্য বানানো হয়েছে। সেটা কী করে আর্ট ফর্ম হয়?’’ চাকরি জীবনে তৎকালীন বামশাসকদের ‘কাছের’ বলে পরিচিত প্রসূনবাবুকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন সিএবি-র নির্বাচনে নামান। জগমোহন ডালমিয়ার কাছে প্রসূনবাবু হারায় বুদ্ধবাবু বলেছিলেন, ‘‘অশুভ শক্তির জয় হয়েছে।’’ অনেকের প্রশ্ন, এখন চাকরিতে না থাকলেও কি কারও থেকে ‘কিছু’ পাওয়ার আছে প্রসূনবাবুর। তাই কি এক শিল্পীর তৈরি ভিডিওতে তিনি এমন ‘রাজনীতির রং’ দেখতে পেলেন, যা অন্য কারও চোখে পড়ল না? এ বারও কি কোনও ‘অশুভ শক্তি’ মাথাচাড়া দিয়েছিল অ্যকাডেমিতে, প্রশ্ন শিল্পী মহলে।
১৯৩৩-এ তৈরি এই অ্যাকাডেমির গোড়াপত্তন করেন লেডি রাণু মুখোপাধ্যায়। ১৯৪৫-এ তৈরি গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, অছি পরিষদ শুধু অ্যাকাডেমির সম্পত্তি ও অ্যাকাডেমির আর্থিক বিষয় দেখভাল করবে। কারা সেখানে প্রদশর্নী করবেন, কারা নাটক করবেন— যাবতীয় বাদবাকি সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা কার্যনির্বাহী কমিটির। কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য হতে গেলে শিল্পের সঙ্গে ন্যুনতম সংযোগ থাকা জরুরি। কিন্তু অছি পরিষদের সদস্য হতে গেলে তার প্রয়োজন নেই। অছি পরিষদের কোনও সদস্য পদত্যাগ করলে বা মারা গেলে, তাঁর জায়গায় নতুন সদস্য বেছে নেন অন্য সদস্যেরাই। বছর দুয়েক আগে শেষ অছি পরিষদের ছ’জন সদস্য একসঙ্গে পদত্যাগ করে প্রসূনবাবুদের বসিয়ে দিয়ে যান।
নিজের অধিকারের গণ্ডি পেরোনোর পুরনো অভ্যাস জারি রেখেই শিল্পকলায় কোনটি ঠিক, কোনটি বেঠিক, তা নির্ধারণ করতে প্রসূনবাবু কুণ্ঠা বোধ করেননি। তিনি বলেন, ‘‘শনিবার আমি বলার পরেও ভিডিও দেখানো বন্ধ হয়নি। দু’দিন পরে আবার জানতে পারি যে ভিডিও তখনও দেখানো হচ্ছে। আবার বন্ধ করতে বলি। তার পরে মঙ্গলবার পুলিশ আসে। ততক্ষণে তিন দিন ধরে ভিডিও দেখানো হয়ে গিয়েছে।’’ কাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন বন্ধ করার জন্য? প্রসূনবাবুর কথায়, ‘‘সে কথা আপনাকে বলব না।’’
আপনি কি সরাসরি পুলিশকে ফোন করেছিলেন? প্রসূনবাবু জানান, তিনি ফোন করেননি। তাঁর মতে, কোনও দুর্ঘটনা নিয়ে কেউ ব্যথিত হতেই পারেন। কিন্তু তা দেখানোর জায়গা অ্যাকাডেমি নয়। বলেন, ‘‘লনের উপরে অনুমতি না নিয়ে তারস্বরে ভিডিও চলছিল। আসলে উদ্দেশ্য ছিল বাইরের পাবলিককে জড়ো করে একটা হইচই বাঁধানো।’’
সনাতনের কথায়, ‘‘ভয় পেয়ে গেলেন! এটুকু একটা ভিডিও দেখালে কি পায়ের তলার মাটি সরে যাবে?’’
কিন্তু কাকে ‘বাঁচাতে’ প্রসূনবাবুর এই তৎপরতা? কার কাছে, কী প্রমাণ করার জন্য ‘ব্যস্ত’ তিনি? সেই উত্তর এখনও মেলেনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy