বাণিজ্যিক বরফের রং হবে নীল। ইতিমধ্যেই কেন্দ্রীয় খাদ্য নিরাপত্তা কমিশনের তরফে এ বিষয়ে নির্দেশিকা জারি করা হয়েছে। আগামী ২০ জুন থেকে শুরু হবে সেই প্রক্রিয়া। কিন্তু সেই নীল রং আসল না নকল, তা দেখবে কে, বা আদৌ তা দেখা সম্ভব কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে নানা মহলে।
কারণ, খাদ্য কমিশনের তরফে উল্লিখিত একটি সূত্র অনুযায়ী, বাণিজ্যিক বরফকে আলাদা ভাবে চিহ্নিত করার জন্য তাতে ‘ইন্ডিগো কারমাইন’ নামে একটি রাসায়নিক ১০ পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন) পর্যন্ত মেশাতে হবে। প্রসঙ্গত, ‘ইন্ডিগো কারমাইন’ বা চলতি কথায় ‘ব্রিলিয়ান্ট ব্লু’ ফুড-গ্রেড রং। অর্থাৎ, নির্দিষ্ট মাত্রায় ওই রং খাবারে ব্যবহার করা যেতে পারে। ফুড টেকনোলজির গবেষক-অধ্যাপকদের একাংশ জানিয়েছেন, প্রতিষ্ঠিত মিষ্টি প্রস্তুতকারক থেকে নামী আইসক্রিম সংস্থা— প্রয়োজন অনুযায়ী অনেকেই খাবারে ওই রং ব্যবহার করে। যদিও সেই রং কতটা সুরক্ষিত, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে ‘ইন্ডিগো কারমাইন’ অন্যান্য দেশেও খাবারে মেশানো হয়।
বিশেষজ্ঞেরা জানিয়েছেন, এই রঙের দামও বেশ বেশি। প্রায় হাজার টাকা কেজি। সেখানে সাধারণ বাণিজ্যিক নীল রঙের দাম মাত্র ৫০-১০০ টাকা! দামের এই বিপুল ফারাকের কারণেই প্রশ্ন উঠেছে, বরফকল মালিকেরা কি আদৌ ইন্ডিগো কারমাইন ব্যবহার করতে পারবেন? সে ক্ষেত্রে তাঁরা যদি সাধারণ নীল রং ওই বরফে মেশান, তা হলে মানুষের শরীরের পক্ষে তা মারাত্মক ক্ষতিকর হতে পারে। চিকিৎসকদের মতে, বাণিজ্যিক বরফ পেটে গেলে তা শরীরের ক্ষতি করতে পারে। কিন্তু বাণিজ্যিক বরফে বাণিজ্যিক রং যদি মেশানো হয়? তা হলে তা কয়েক গুণ বেশি ক্ষতিকর বলে জানাচ্ছেন ফুড টেকনোলজির গবেষক-অধ্যাপকেরা।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ফুড টেকনোলজি অ্যান্ড বায়ো-কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং’ বিভাগের শিক্ষক প্রশান্তকুমার বিশ্বাস বলেন, ‘‘মাছ-মাংস সংরক্ষণের বরফে বাণিজ্যিক নীল রং ব্যবহার করা হলে তাতে মারাত্মক ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ, আঁশ বা চামড়া দিয়ে মাছ-মাংসের ভিতরে ওই নীল রং প্রবেশ করতে পারে, যা খেলে ক্যানসার তো বটেই, সীসা থেকে বিষক্রিয়া হওয়ারও আশঙ্কা থাকে। ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে লিভার বা কিডনিও।’’ ওই বিভাগেরই অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক উৎপল রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘আসল নীল রং, অর্থাৎ ইন্ডিগো কারমাইন মেশানো বরফ ও বাজারচলতি নীল রং মেশানো বরফ যদি আলোয় ধরা হয়, তা হলে তাদের বিচ্ছুরণে একটা পার্থক্য থাকে। সেই পার্থক্য দেখেই বলা সম্ভব কোনটা আসল, কোনটা নকল। কিন্তু সেই নজরদারিটা ঠিকঠাক চালানোটা খুব প্রয়োজন।’’ খাবারের বরফের পরিবর্তে বাণিজ্যিক বরফকে নীল রং করতে বলা হয়েছে কেন? কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে খড়্গপুর আইআইটি-র ‘এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং’ বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক সুশান্ত দাস বলেন, ‘‘দীর্ঘদিন ধরে যে কোনও রং ব্যবহারেরই একটা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া রয়েছে। সংরক্ষণের বরফ যে হেতু সরাসরি খাওয়া হচ্ছে না, তাই ওই বরফকেই রং করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে আমার অনুমান।’’
শহরের পথেঘাটে বিক্রি হওয়া শরবত, আখের রসে বাণিজ্যিক বরফ মেশানোর বিরুদ্ধে পুরসভার তরফে দফায় দফায় অভিযান চালানো হলেও তা আটকানো যায়নি। গত জুলাইয়ে পুরসভা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত বরফ ও খাওয়ার বরফকে আলাদা ভাবে চিহ্নিত করার জন্য বরফে রং করা হবে। কিন্তু নানা কারণে তা বাস্তবায়িত হয়নি। এর মধ্যে মহারাষ্ট্র সরকার বাণিজ্যিক বরফে নীল রং করা বাধ্যতামূলক করায় ফের নড়েচড়ে বসে পুরসভা। তার মধ্যেই কেন্দ্রীয় খাদ্য নিরাপত্তা কমিশনের এই নির্দেশ।
যদিও এ ব্যাপারে রাজ্য সরকারের নির্দেশ মতোই এগোনো হবে বলে জানাচ্ছেন পুরকর্তাদের একাংশ। এক পুরকর্তার কথায়, ‘‘এত দিন হাতে কোনও অস্ত্রই ছিল না। এখন তবু কিছু একটা পাওয়া গেল। এ বার এর বাস্তবায়ন কী ভাবে হবে, সেটা তো নীতি নির্ধারণের ব্যাপার। কেন্দ্র-রাজ্য এ বিষয়ে যা সিদ্ধান্ত নেবে, সে ভাবেই এগোনো হবে।’’
ধর্মতলা, রবিনসন স্ট্রিট ও গণেশ টকিজে। মঙ্গলবার। ছবি: রণজিৎ নন্দী ও বিশ্বনাথ বণিক