ট্রেনে সহযাত্রীকে দশের কয়েন বদলে নোট দিচ্ছেন জাহির। ছবি তুলেছেন দীপঙ্কর মজুমদার।
রাতের ভিড়ে ঠাসা লোকালে প্রশ্নটা শুনে মুখ ঝামটা দিয়েছিলেন শোনপাপড়ি বিক্রেতা।
‘‘না না, দশ টাকার কয়েন নিতে পারব না। মার্কেটে ও সব চলছে না!’’
নিচু স্বরে জবাব আসে, ‘‘নিতে হবে না! দেবেন তো? যতগুলো আছে, সব ক’টাই দিন। বদলে দেব।’’
বিষয়টা তখনও যেন ঠিক মাথায় ঢুকছিল না ওই হকারের। সরু গোঁফের ছিপছিপে চেহারা এ বার হাসেন, ‘‘বুঝলেন না ভাই? আপনার ১০ টাকার কয়েনগুলো বদলে আপনাকে নোট দেব। ১০, ২০, ৫০, ১০০ যা আছে। এমন আমি সাহায্য করেই থাকি।’’
হকারের অবিশ্বাস তবু যায় না। সরু গোঁফধারী বোঝান, ‘‘কম টাকা দেব না। আপনি যত টাকার কয়েন দেবেন, ততটাই নোটে ফিরিয়ে দেব। লোকের বিপদ, এটুকু করব না?’’
আশপাশের লোক ততক্ষণে হাঁ করে দেখছেন মধ্য চল্লিশের ওই ব্যক্তিকে। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন তিনি, ‘‘চাইলে আপনারাও দিতে দশ টাকার কয়েন পারেন। আরও কিছু নোট রয়েছে সঙ্গে, অল্পস্বল্প সাহায্য করতে পারব।’’
সকাল-বিকেল খড়্গপুর, মেচেদা, পাঁশকুড়া বা বাগনান লোকালের অনেকেই চিনে গিয়েছেন তাঁকে। কেউ মজা করে ডাকেন ‘দশ নম্বরি দাদা’! কারও নামকরণ, ‘আরবিআই আর্মি’! তিনি নিজে লাজুক হেসে বলেন, ‘‘আমি সামান্য লোক। যা করছি নিজের ভাবনা থেকেই। আমার মোটেই নোট বা কয়েনের গাছ নেই।’’
আদতে বড়বাজারে মার্বেল কাটার মেশিনের ছোট্ট কারবারি। নাম শেখ জাহির আলি। রোজ বেলাবেলি হাওড়ার কুলগাছিয়া থেকে লোকাল ধরেন। ফেরেন সন্ধে পেরিয়ে। নিজের ঘুপচি দোকানে বসেই হোক বা ট্রেনে যেতে যেতে, হকার বা সহযাত্রীদের দশ টাকার কয়েন নেন যেচেই। যেন মূর্তিমান মুশকিল আসান!
পুরনো ৫০০ ও ১০০০-এর নোট অচল ঘোষণার পর থেকেই ১০ টাকার মুদ্রা নিয়ে গুজবের শুরু। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তরফে বারবার বলা হয়েছে, ১০ টাকার কয়েন বাতিলের পরিকল্পনাই নেই। ২০০৭ ও ২০১১ সালে দু’দফায় এই মুদ্রা চালু হয়েছিল। যাবতীয় বিভ্রান্তি উড়িয়ে আরবিআই জানিয়েছে, পুরনো বা নতুন সব ১০ টাকার কয়েনই ব্যবহার করা যাবে। তাতেও আমজনতাকে বোঝে কই! ব্যাঙ্ককর্তা থেকে ছোট দোকানদার, সকলেই একেবারে নাজেহাল। কেউই ভরসা করে ১০ টাকার কয়েন নিতে রাজি নন। জাহিরসাহেব তবু অকুতোভয়! ‘‘আজ বাদে কাল তো গুজব কেটেই যাবে। এটা কোনও সমস্যা নয়!’’
তিনি নিজে এমনিতে কাউকেই ‘কয়েন’ নিতে বাধ্য করেন না। উল্টে লোকের কাছে থাকলে নিজে নিয়ে নেন। জাহিরের কথায়, ‘‘এই যে আমি চেয়ে চেয়ে ১০ টাকার কয়েন নিচ্ছি, এটাই তো গুজবের মোকাবিলায় বার্তা।’’ তিনি বলছেন, দোকানে কেউ কেউ তাঁকে দেখে তাঁর কাছ থেকেও দশ টাকার মুদ্রায় খুচরো নিচ্ছেন। গুজব-বিরোধী অভিযানের ঢঙেই রোজ প্রায় ১০-১৫ জনের দশ টাকার মুদ্রা বদলে দিচ্ছেন জাহির।
এমনিতে কলকাতা বা মফস্সলে এক ধরনের নোট ভাঙানোর কারবারিদের দেখা যায়। ‘বাটা’র কারবারি বলে পরিচিত ওই ব্যক্তিরা এর জন্য নোট পিছু অল্প কমিশনও নেন। জাহির অবশ্য ১০ টাকার মুদ্রা বদলে দিচ্ছেন কোনও রকম লাভ না রেখে। স্রেফ সাহায্য করার তাগিদেই।
শুনে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের এক কর্তার মন্তব্য, ‘‘এ তো দারুণ! ১০ টাকার কয়েন নিয়ে গুজবের বাজারে ইনিই মোক্ষম স্বেচ্ছাসেবী।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy