E-Paper

এক ডাম্পার বালি তুললেই ১০-১২ হাজার টাকা, খাদান মাফিয়াদের দাপটে ভয়াবহ ক্ষতি গঙ্গার

ঘটনাটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, বর্তমানে গঙ্গা থেকে বালি তোলার জন্য কতটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে অবৈধ খাদানের মাফিয়ারা।

দেবাশিস দাশ

শেষ আপডেট: ২০ মে ২০২৩ ০৭:৩২
An image of labours

মর্মান্তিক: শ্রমিকেরা বালি তুলছেন সেই দুর্ঘটনাগ্রস্ত নৌকায়। এর কিছু পরেই ঝড়ের দাপটে ডুবে যায় সেটি।  ছবি: সংগৃহীত।

গঙ্গার চর থেকে বালি তুলতে গিয়ে কালবৈশাখী ঝড়ে নৌকা উল্টে যাওয়ায় নিখোঁজ দুই শ্রমিকের সন্ধান মেলেনি ঘটনার চার দিন পরেও। শুধু তা-ই নয়, নিখোঁজ শ্রমিকদের পরিজনদের অভিযোগ, যে বালি-মাফিয়াদের খাদানে ওই শ্রমিকেরা কাজ করেন, তাদের লোকজন এখন বিষয়টি ধামাচাপা দিতে তাঁদের খুনের হুমকি দিচ্ছে। এই ঘটনায় পুলিশ অবশ্য এখনও কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। তাদের মধ্যে বিশেষ হেলদোলও দেখা যায়নি। অথচ, ঘটনাটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, বর্তমানে গঙ্গা থেকে বালি তোলার জন্য কতটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে অবৈধ খাদানের মাফিয়ারা। যে দুই শ্রমিক নিখোঁজ হয়ে গিয়েছেন, তাঁরা খুবই সামান্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে নদী থেকে বালি তোলার এই কাজ করতেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। এক পুলিশকর্তা যদিও নিয়ম মাফিক জানিয়েছেন, ঘটনার তদন্ত হচ্ছে।

গঙ্গা থেকে কী ভাবে বালি তোলে মাফিয়ারা? এ ভাবে বালি তোলায় নদীরই বা কতটা ক্ষতি হচ্ছে? অবৈধ বালি খাদানের নৌকার মাঝি, নদী বিশেষজ্ঞ এবং হাওড়ার গঙ্গাতীরের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, গঙ্গা থেকে পলি বা সাদা বালি তোলার ঘটনা নতুন নয়। রুজি-রুটির জন্য দীর্ঘদিন ধরেই এই কাজ করছেন কিছু মানুষ। মূলত ছোট দেশি নৌকায় নদীর যে জায়গায় পলি বেশি জমে, সেখান থেকে তাঁরা বালি তোলেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, নাজিরগঞ্জ ফেরিঘাট এলাকার এক মাঝি বললেন, ‘‘রাজাবাগান থেকে উলুবেড়িয়া পর্যন্ত এলাকায় নদীর বালি তোলার কাজে কয়েক হাজার দরিদ্র পরিবার জড়িত। কিন্তু মাস সাতেক আগে কলকাতা বন্দর কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ প্রশাসন আচমকা এই কাজ বন্ধ করে দেন। তার পরেই দেখা যায়, যন্ত্রচালিত কয়েকটি বড় নৌকা নদীতে নেমে বালি তুলতে শুরু করেছে।’’ নদী থেকে মাছ ধরে বা বালি তুলে যাঁরা জীবনধারণ করেন, তেমনই এক ব্যক্তি একটি নৌকা দেখিয়ে বললেন, ‘‘এই ধরনের এক-একটি নৌকায় চার ট্রাক বালি ধরে। দিনে দু’বার করে বালি তোলা হয়। বালি তোলার পরে তা জমা রাখা হয় নাজিরগঞ্জের পোদরার কাছে, দু’টি প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া ইটভাটার পাশে। সেখানে ডাম্পারে ভর্তি হয়ে বালি চলে যায় অন্যত্র। এক ডাম্পার বালি বিক্রি হয় ১০ থেকে ১২ হাজার টাকায়।’’

কিন্তু এ ভাবে গঙ্গা থেকে বালি তোলার ক্ষেত্রে কলকাতা বন্দর কর্তৃপক্ষ কি অনুমতি দিয়েছেন? বন্দর কর্তৃপক্ষের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘অনুমতি দেওয়ার প্রশ্নই নেই। বালি তোলার অভিযোগ গেলে স্থানীয় প্রশাসনের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা।’’ গত সোমবারের ঝড়ে মানিকপুর চরে নৌকা উল্টে নিখোঁজ শ্রমিকদের পরিবারের তরফে এই ঘটনার বিষয়ে যে অভিযোগ করা হয়েছিল, তা নিয়ে সাঁকরাইলের তৃণমূল বিধায়ক প্রিয়া পালের আবার বক্তব্য, ‘‘এই খবর কতটা ঠিক, তা খতিয়ে দেখা দরকার। কারণ, মানিকপুর বা সাঁকরাইল এলাকায় কোনও চর নেই। তাই বালি তোলার প্রশ্নই নেই।’’ অথচ, গঙ্গা নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন, তাঁদের মতে, বালি থেকে উলুবেড়িয়া পর্যন্ত গঙ্গার বিভিন্ন জায়গায় চর তৈরি হয়েছে। অনেক জায়গায় এত বেশি পলি জমেছে যে, নৌকা আটকে যাওয়ার মতো অবস্থা। ওই সমস্ত চর থেকেই মূলত বালি তোলা হয়। বেহিসেবি ভাবে বালি তোলার ফলে বহু জায়গায় নদীর প্রবাহ স্বাভাবিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে। যার ফলে নানা ধরনের বিপর্যয় দেখা দিতে পারে।

নদী বিশেষজ্ঞ সুপ্রতিম সরকারের মতে, বালি যেখান থেকেই তোলা হোক না কেন, নির্দিষ্ট আইন মেনে ও অনুমতি সাপেক্ষে তুলতে হয়। তিনি বলেন, ‘‘ওয়েস্ট বেঙ্গল মাইনস্ অ্যান্ড মিনারেলস্ রুলস্ অনুযায়ী বালি কতটা তোলা যাবে, তা সরকার ঠিক করে দেবে এবং সেই মতো অনুমতি নিতে হবে। কত মিটার পর্যন্ত বালি তোলা যাবে, তা নির্দিষ্ট ভাবে বলা থাকবে এবং সেই বাবদ নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হবে। কিন্তু এ সব কিছুই না মেনে প্রশাসনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বালি তোলার কাজ চলছে।’’ সুপ্রতিমের মতে, এটা বন্ধ না হলে নদীর ভারসাম্য নষ্ট হবে, যা নদীর স্বাস্থ্যের পক্ষে অত্যন্ত বিপজ্জনক।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Sand Theft Labours River Ganga Boat Drowning Missing

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy