আলিপুর চিড়িয়াখানা চত্বর থেকে ‘নিখোঁজ’ হয়ে গিয়েছে ৩২১টি প্রাণী। ছিল ৬৭২। কিন্তু চলতি বছরের বার্ষিক হিসাবের ঠিকুজি বলছে, সংখ্যাটা নেমে দাঁড়িয়েছে ৩৫১। হিসাবের এই গরমিলের স্পষ্ট কোনও ব্যাখ্যা দিতে না পারায় দেশের প্রাচীনতম চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেছে কলকাতার একটি প্রকৃতিপ্রেমী সংগঠন।
‘স্বজন’ নামের সেই সংগঠনের তরফে বুধবার এক সভার আয়োজন করা হয় কলকাতার ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন প্রেক্ষাগৃহে। বিভিন্ন বন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সভায় উপস্থিত ছিলেন রাজ্যসভার প্রাক্তন সাংসদ জহর সরকার। আজ, বৃহস্পতিবার স্বজন-এর আনা জনস্বার্থ মামলার শুনানি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে কলকাতা হাই কোর্টে।
আলিপুর চিড়িয়াখানা এবং সেখানকার পরিচালন সমিতির উদাসীনতা ঘিরে বিতর্ক নতুন নয়। চিড়িয়াখানা থেকে কখনও বিপন্ন প্রজাতির মারমোসেট বাঁদর চুরি (২০০৯) কখনও বা অতি বিরল টুকন পাখি পাচার (২০২১) নতুন ঘটনা নয়। বিতর্কের তালিকায় রয়েছে, পশুপাখিদের অস্বাস্থ্যকর বাসস্থান, পশু চিকিৎসালয়ে গাফিলতির মতো অজস্র অভিযোগ। দীর্ঘ সেই তালিকায় পশুদের হিসাবে এই গরমিল নব্য সংযোজন।
মামলাকারী সংগঠনের দাবি, ২০২৩-’২৪ অর্থবর্ষে ৬৭২টি প্রাণী ছিল। ২০২৪-’২৫ সালে তা নেমে এসেছে ৩৫১-এ। এই গরমিলের হিসাব চলছে গত ২৯ বছর ধরে। ওই সংগঠনের দাবি, আদালত চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের কাছে এই গরমিলের স্পষ্ট হিসাব চায়। সংগঠনের পক্ষে স্বর্ণালী চট্টোপাধ্যায়ের অভিযোগ, প্রাণীর সংখ্যা কম দেখিয়ে আদতে জমি বিক্রি করার তাল করছে রাজ্য সরকার। গরমিলের নেপথ্যে পাচারের আশঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না তাঁরা। হিসাবের এই তফাত প্রথম চোখে পড়ে ‘সেন্ট্রাল জ়ু অথরিটি’র (সিজেডএ) বার্ষিক ‘অ্যানুয়াল ইনভেন্ট্রি অব অ্যানিমালস ইন জু়’র রিপোর্টে। ওই রিপোর্টে আলিপুর চিড়িয়াখানায় বহাল তবিয়তে থাকা বাঘ, সিংহ, সাদা বাঘ, গন্ডার, হাতির মতো বেশ কিছু প্রাণীর নামই নেই!
চিড়িয়াখানার অধিকর্তা অরুণ মুখোপাধ্যায়ের সাফাই, ‘‘এটা নিছকই গণনার ভুল। আমাদের অভ্যন্তরীণ হিসাব সিজেড-এ কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানোর পরে তাঁরাও ব্যাপারটা খতিয়ে দেখেননি। ভুল রিপোর্টই প্রকাশ পেয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব সংশোধন করে সিজেডএ-র কাছে সংশোধিত রিপোর্ট পাঠাচ্ছি।’’
চিড়িয়াখানায় হিসেবের এই গরমিল ১৯৯৫-’৯৬ অর্থবর্ষ থেকেই লক্ষণীয়। ১৯৯৬ সালের ৩১ মার্চ আলিপুর চিড়িয়াখানায় ১৮০৫টি প্রাণী ছিল, কিন্তু ১ এপ্রিলেই সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ১,৮৭২। প্রাণীর সংখ্যা কমানোর পিছনে রাজ্য সরকারের অন্য ‘অভিসন্ধি’র ইশারা দেখছে ওই সংগঠন। সিজেডএ-র নির্দেশিকা অনুসারে, কোনও চিড়িয়াখানায় সাতশোর বেশি প্রাণী ও দেশি-বিদেশি প্রজাতির প্রাণী থাকলে তা ‘লার্জ সাইজ় জ়ু’ হিসাবে ধরা হয়। আগে আলিপুর চিড়িয়াখানার প্রাণী-সংখ্যা এই মানদণ্ডে পড়লেও এখন পশুপাখি কমে এটি ‘মিডিয়াম সাইজ জ়ু’ হিসাবে নথিভুক্ত।
সরকার-চালিত ‘ইচ্ছাকৃত সঙ্কোচন’ হিসাবেই সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে ওই পিটিশনে। তাঁদের দাবি, আলিপুর চিড়িয়াখানার ৩৪-এ, বেলভেডিয়ার রোডে ৩ একর জমির উপরে রয়েছে চিড়িয়াখানার ভেটেরিনারি হাসপাতাল, পুনর্বাসন কেন্দ্র এবং সুবিশাল মাছঘর বা অ্যাকোয়ারিয়াম। রাজ্য সরকারের ‘চোখ পড়েছে’ সেখানে। ‘হিডকো’র তত্ত্বাবধানে ই-টেন্ডার ডেকে সেখানে বহুতল কিংবা বিপণি তৈরির চেষ্টা হচ্ছে বলে সংগঠনের দাবি। যদিও চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন বলে এড়িয়েছে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)