E-Paper

কলকাতার কড়চা: মানুষের হাতে মানুষের শিল্প

গত কয়েক দশকে ধরে মানুষের জীবনশৈলী অতি দ্রুত বদলাচ্ছে। পরিবর্তনের এই গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে জীবনযাপনের পরম্পরাগত উপাদান।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৫:০৭

একটা সময় ছিল, যখন গ্রামের ঘরে ঘরে মুড়ি ভাজা হত। তার আগে চলত একাধিক বার ধান ভেজানো, সেদ্ধ করা আর শুকানোর প্রক্রিয়া। ধান ভিজিয়ে রাখার জন্য বিশেষ আকারের বড় পোড়ামাটির পাত্র তৈরি হত কুমোরপাড়ায়। সেদ্ধ করা চাল শুকনো করে বাড়িতেই কোটা হত। তার পর বালিতে ভেজে তৈরি হত মুড়ি। এখন বাড়িতে মুড়ি ভাজার চল কমেছে। আর তাই চাল ভেজানোর সেই বড় মৃৎপাত্রের সঙ্গে আর পরিচয় হয় না নতুন প্রজন্মের। একই ভাবে বাড়িতে কাঁথা সেলাই করার প্রচলনও কমে এসেছে। বিশেষ করে নকশিকাঁথা সেলাই করার মানুষ শহর অঞ্চলে আজ বেশ বিরল। ফলে লোকশিল্পের এই ধারাটি ক্রমে সরে যাচ্ছে অপরিচয়ের অন্ধকারে।

গত কয়েক দশকে ধরে মানুষের জীবনশৈলী অতি দ্রুত বদলাচ্ছে। পরিবর্তনের এই গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে জীবনযাপনের পরম্পরাগত উপাদান। ছোটদের ঝুলন সাজানোর মতো রীতি, অথবা চাকা লাগানো টেমটেমি বাজনার মতো খেলনাকে সরিয়ে জায়গা করে নিয়েছে নানা মোবাইল গেম। অন্য দিকে ধর্মস্থানে মাটির তৈরি নানা ধরনের পশুমূর্তি উৎসর্গ করার রেওয়াজও কমে আসছে, হারিয়ে যাচ্ছে সেই পুতুলগুলি। এমন তালিকা করতে বসলে তা কেবলই দীর্ঘ হবে।

মানুষের সামনে পারম্পরিক শিল্পকে তুলে ধরে, তাদের পুনরুজ্জীবনের লক্ষ্যে ব্রতী বারুইপুরের ‘স্টুডিয়ো ক্যালিক্স’। গত ১ ডিসেম্বর থেকে সেখানে শুরু হয়েছে তাদের পঞ্চম বার্ষিক প্রদর্শনী, ‘রিভাইভাল’। বাংলার লোক-ঐতিহ্যধারার প্রতিনিধি চারু ও কারুশিল্পই উপজীব্য এই প্রদর্শনীর। এক দিকে থাকছে বাসন, নকশি কাঁথার (মাঝের ছবি) মতো পারম্পরিক গৃহস্থালি দ্রব্য-প্রভাবিত শিল্পসামগ্রী, অন্য ভাগে খেলনা, পুতুলের মতো ঐতিহ্যশালী বিনোদনবস্তুর নব উপস্থাপন। স্টুডিয়ো প্রাঙ্গণ জুড়ে প্রদর্শিত বিভিন্ন ইন্সটলেশন ও ম্যুরালে লোকশিল্প ও আধুনিক শিল্পের মেলবন্ধনেই এই প্রয়াস। টেরাকোটা আর সেরামিক্সও পেয়েছে গৌরবের ঠাঁই।

প্রদর্শনীর একটা বড় অংশ জুড়ে ছোটদের জন্য পরিকল্পনা। প্রায় হারিয়ে যাওয়া ঝুলন সাজানোর রীতি ফিরিয়ে দেওয়ার অন্যতম ধাপ, পুতুলের সঙ্গে তাদের সখ্য গড়ে তোলা। ২১ ডিসেম্বর হবে কর্মশালাও, রাহুল সর্দার শেখাবেন ষষ্ঠীপুতুল বা ছলনের পশুর মতো পুতুল তৈরি।

লোকশিল্প, গ্রামীণ ঐতিহ্য নিয়ে গবেষণামূলক কাজ হচ্ছে দেশে-বিদেশে। সেই সূত্র ধরেই প্রদর্শনীর পরিকল্পনা ও রূপায়ণ করেছেন শিল্পী তমাল ভট্টাচার্য। মানুষের কাছে বাংলার শিল্পধারাগুলি তুলে ধরতে পারলে যেমন ঐতিহ্য সংরক্ষণ হবে, তেমনই সৃষ্টিশীল কাজে যুক্ত করা যাবে ছোটদেরও। এ কাজে যুক্ত শিল্পীদের জীবিকার নিশ্চয়তাও বাড়বে। বারুইপুরের আগেই, বেনের চাঁদনি মোড়ের কাছে স্টুডিয়ো ক্যালিক্সে প্রদর্শনী আগামী ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত, রোজ দুপুর ৩টে-সন্ধ্যা ৭টা। উপরে প্রদর্শনীর ছবি।

তব জ্যোতি

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের (ছবি) মৃত্যুর একশো বছরে তাঁর গান ফিরে শোনানোর ব্যবস্থা করছে ‘ইন্দিরা’ গোষ্ঠী, ঠাকুরবাড়ির সঙ্গীত-রচয়িতাদের গান নিয়ে যাদের ব্যতিক্রমী উদ্যোগ কয়েকটি যুগ পার করল। নেতৃত্বে ছিলেন সুভাষ চৌধুরী, তাঁর প্রয়াণের পরেও জাগরূক সেই ব্রত। রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর জ্যোতিদাদার সাঙ্গীতিক বিনিময় তুলনায় কম আলোচিত, তা মাথায় রেখেই আগামী ১৩ ও ১৫ ডিসেম্বর যথাক্রমে যাদবপুরে ত্রিগুণা সেন মঞ্চে ও সিএলটি অবন মহলে সন্ধ্যা ৬টায় অনুষ্ঠান ‘তব জ্যোতি নেহারে’। মূল আকর্ষণ রবীন্দ্রনাথের কথায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সুরারোপিত গান; বাংলা গানে বাণীর ব্যবহার, সুরনির্মাণ ও ছন্দ নিয়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের কুশলী নানা নিরীক্ষার নমুনা শোনা যাবে। শুক্রবারের অনুষ্ঠানে গাইবেন আমন্ত্রিত শিল্পীরাও: প্রমিতা মল্লিক শ্রীরাধা বন্দ্যোপাধ্যায় অলক রায়চৌধুরী অগ্নিভ বন্দ্যোপাধ্যায় ও স্নিগ্ধদেব সেনগুপ্ত।

সেতু

দুই শতকেরও বেশি যোগাযোগ জার্মানি ও ভারতের। দেশে দেশে সংযোগসূত্রগুলি যেখানে ভ্রমণ বা বাণিজ্য, জার্মানি ও ভারতের ক্ষেত্রে তা বিদ্যাচর্চা, মননের অনুশীলনও। ‘স্কলার্স, টেক্সটস অ্যান্ড আইডিয়াজ়’ শিরোনামে ৬ ও ৭ ডিসেম্বর এক সিম্পোজ়িয়ামে সেই শতাব্দীপ্রাচীন সেতুই ফিরে দেখছে গ্যোয়টে ইনস্টিটিউট-ম্যাক্সমুলার ভবন কলকাতা। গতকাল আলোচনা হল ভারতে জার্মান স্টাডিজ়-এর বিবর্তন, জার্মান ভারতত্ত্ববিদ জোহান জর্জ বিউলার, কেশবচন্দ্র সেন ও ম্যাক্সমুলারকে ঘিরে। আজ সকাল সাড়ে ৯টা থেকে দিনভর আলোচনা ভারত-জার্মানি প্রেক্ষাপটে মার্ক্স, কান্ট, ইয়ুং প্রসঙ্গে: বলবেন শোভনলাল দত্তগুপ্ত অরিন্দম চক্রবর্তী সোনু সামদাসানি প্রমুখ বিশিষ্টজন।

পরিক্রমা

১৯৮৪-তে শুরু, চার দশক ধরে মঞ্চগানের সংরক্ষণ ও চর্চায় মগ্ন একাডেমি থিয়েটার। গড়ে তুলেছে গান থিয়েটার যাত্রা সিনেমার সমৃদ্ধ আর্কাইভ: ৩৫ হাজার বই ও পত্রিকা, ডিস্ক রেকর্ড, পোস্টার ফোটো ক্যামেরা গ্রামোফোন বাদ্যযন্ত্র, কী নেই! মঞ্চগান কাব্যগান লোকগান যাত্রাগান ও সিনেমার গানভিত্তিক নানা প্রযোজনাও হয়েছে তাদের উদ্যোগে, দেবজিত্‌ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাবনায়। আগামী ১২ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৬টায় জ্ঞান মঞ্চে, ঋদ্ধি বন্দ্যোপাধ্যায় প্রোডাকশনের সঙ্গে একত্রে তাদের অপেরাধর্মী পরিবেশনা ‘কানন থেকে কেয়া’। কানন দেবী থেকে শুরু করে কেয়া চক্রবর্তী পর্যন্ত এ এক অনন্য মঞ্চপরিক্রমা, ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাবে নরীসুন্দরী আশ্চর্যময়ী প্রভা দেবী নীহারবালা আঙুরবালা ইন্দুবালা ও তাঁদের সমগোত্র বহু শিল্পীর জীবনকথা: অভিনয় নাচ গান ভাষ্যে।

ইতিহাস ছুঁয়ে

নবনাট্য আন্দোলনের পঁচাত্তরের পৌঁছফলকে দাঁড়িয়ে যখন আদিপর্বের প্রযোজনাগুলি ফের উঠে আসছে, তখন ‘রঙ্গপট’ নাট্যগোষ্ঠী ইতিহাস থেকে তুলে আনছে নবধারার নাট্য। তথাগত, আওরঙ্গজেব, ধর্মাশোক, চতুষ্পাপ, মেদেয়া-র পরম্পরায় তাদের নতুন প্রযোজনা হে সিন্ধুসারস। মস্কো আর্ট থিয়েটারের চালচিত্রে চেকভের দ্য সিগাল নাটকের সূত্রে গড়ে ওঠা। তৎকালীন রাশিয়ার বিনোদনমূলক থিয়েটারের বিপরীতে আধুনিক ভাবনায় জারিত মস্কো আর্ট থিয়েটারের অন্যতম উদ্গাতা ছিলেন স্তানিস্লাভস্কি। সেখানে উনিশ-বিশ শতকে চেকভ ও স্তানিস্লাভস্কির দ্বন্দ্ব নতুন দ্যোতনা আনে নাট্যভাষায়। লিখেছেন উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়, নির্দেশনায় তপনজ্যোতি। প্রথম অভিনয় আগামী কাল ৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায়, অ্যাকাডেমি মঞ্চে।

সিনেমাময়

মালটা পোল্যান্ড বুলগেরিয়া ডেনমার্ক রোমানিয়া স্পেন অস্ট্রিয়া ফিনল্যান্ড জার্মানি ফ্রান্স পর্তুগাল আয়ারল্যান্ড বেলজিয়াম সাইপ্রাস— ইউরোপ এখন কলকাতায়। কলকাতা আন্তর্জাতিক ফিল্মোৎসব তো চলছেই, তারই গায়ে গায়ে শহরে চলছে ‘ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’ও। গত কয়েক দিন তার ঠিকানা ছিল কেসিসি ও ক্রিয়েটিভ আর্টস অ্যাকাডেমি, আর আজ থেকে আগামী তিন দিন নিউ টাউনের আর্টস একর ফাউন্ডেশনে, দুপুর আড়াইটা আর বিকেল সাড়ে ৫টায় দেখা যাবে একটি করে ছবি। ৯-১০ ডিসেম্বর উৎসবস্থল গ্যোয়টে ইনস্টিটিউট, দুপুর দেড়টা থেকে শীতের সন্ধ্যা জুড়ে; আবার ১২-১৩ ডিসেম্বর ঠিকানা পাল্টে আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ়-এ, দু’দিনই বিকেল ৫.৪৫ থেকে। একটি শীতসপ্তাহ— কেবলই সিনেমাময়!

জাপানি পুতুল

জাপানি ভাষায় ‘নিনগিয়ো’ শব্দটার আক্ষরিক অর্থ মানুষের আদল, বৃহদর্থে পুতুল। পুতুল যে সব দেশ আর সংস্কৃতিরই অপরিহার্য অঙ্গ তা তো জানা কথাই, মানুষ আর তার চার পাশের পরিবেশের সব কিছুই উঠে আসে তার গড়নে, রঙে, মেজাজে। ভারতের মতোই জাপানের ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতিও ভরা হরেক পুতুলে, আমাদের মতোই নির্মাণবৈচিত্রে সমৃদ্ধ তারাও। এই পুতুল-সংস্কৃতিই এ বার সামনে থেকে দেখার সুযোগ: কলকাতাস্থিত কনসুলেট জেনারেল অব জাপান, জাপান ফাউন্ডেশন ও ইন্ডিয়ান মিউজ়িয়মের যৌথ উদ্যোগে। আজ থেকে ইন্ডিয়ান মিউজ়িয়মে শুরু হচ্ছে জাপানি পুতুলের প্রদর্শনী (ছবি), ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত, সোমবার বাদে রোজ সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা। জানা যাবে জাপানের পুতুল-সংস্কৃতির নানা দিক, কাতাশিরো আর আমাগাতসু-র মতো জাপানি পুতুলের আদিকল্প, দেখা যাবে সে দেশের নানা অঞ্চলের স্থানীয় পুতুল।

বিদায়

অর্থনীতিবিদ অমিয় কুমার বাগচির (ছবি) স্মরণে আগামী ৯ ডিসেম্বর দুপুর ৩টেয় ইনস্টিটিউট অব ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ় কলকাতা (আইডিএসকে)-র সল্টলেক ক্যাম্পাসে সমবেত হবেন তাঁর প্রাক্তন ও বর্তমান সহকর্মীরা। উপস্থিত থাকবেন তাঁর অগণিত ছাত্র এবং পাঠক। এই শহরেই কেটেছে তাঁর সুদীর্ঘ শিক্ষকতা এবং গবেষণার জীবন। পড়িয়েছেন প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সেন্টার ফর স্টাডিজ় ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস-এ। শেষোক্ত প্রতিষ্ঠানটির অধিকর্তার দায়িত্বও পালন করেছেন কিছু কাল। ২০০২ সালে আইডিএসকে-র প্রতিষ্ঠাতা-অধিকর্তা হিসাবে দায়িত্বগ্রহণ করেন, আমৃত্যু যুক্ত ছিলেন সেখানে। ঐতিহাসিক তথ্যসম্ভার নিয়ে ম্যাক্রোইকনমিক্সের গবেষণা এবং পলিটিক্যাল ইকনমি-র চর্চায় তিনি ছিলেন দেশের অগ্রগণ্য চিন্তক। প্রাইভেট ইনভেস্টমেন্ট ইন ইন্ডিয়া ১৯০০-১৯৩৯, দ্য পলিটিক্যাল ইকনমি অব আন্ডারডেভলপমেন্ট-সহ বহু গুরুত্বপূর্ণ বই এবং গবেষণাপত্রে রেখে গিয়েছেন বিপুল অবদান।

নতুন করে

সৃষ্টির কর্তা ব্রহ্মা, মৃত্যুর যম। জীবন-মরণের আঁক কষেন তাঁরা, হিসাব রাখেন চিত্রগুপ্ত। কিন্তু এই নাটকে ব্রহ্মা ব্যস্ত গদির অঙ্কে! মর্তের মৃত ভণ্ড দালাল জোতদার পুনর্জন্ম নিয়ে ফিরতে চায় পৃথিবীতে, অপহরণ করে যমজায়াকে। অসহায় যম যান ব্রহ্মার দরবারে, আর নারদ ছদ্মবেশে নরকে। সত্তর দশকে মনোজ মিত্রের লেখা নাটক নরক গুলজার আসলে সমকালীন বঙ্গ তথা দেশের সমাজ-রাজনীতির ‘স্যাটায়ার’। বিভাস চক্রবর্তীর নির্দেশনায় ‘থিয়েটার ওয়ার্কশপ’ প্রযোজিত নাটকটি তো মাইলফলক, এ বার প্রয়াত নাট্যকারের আপন দল ‘সুন্দরম’ মঞ্চে আনছে তাকে, বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশনায়। পুরনো নাটকের গানে সুর করেছিলেন দেবাশিস দাশগুপ্ত, মঞ্চসজ্জা মনু দত্ত; তাঁদেরই উত্তরসূরিরা এ বার নতুন নাটকেও, আশ্চর্য যোগসূত্র! ১১ ডিসেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায়, অ্যাকাডেমি মঞ্চে সুন্দরমের নরক গুলজার।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Baruipur Jyotirindranath Tagore Japan

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy