বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করেছিল দুই কিশোর, কিশোরী। কিছুটা নিরুপায় হয়ে সেই বিয়ে মেনেও নেন অভিভাবকেরা। অপ্রাপ্তবয়স্ক যুগল একসঙ্গে থাকতে শুরু করে। ১৬ বছরের মেয়েটি সম্প্রতি হাসপাতালে পুত্রসন্তানের জন্মও দিয়েছে। এবং এর পরেই তদন্তে নেমে নাবালক বাবাকে আটক করেছে পুলিশ। ১৭ বছরের কিশোর পিতার বিরুদ্ধে পকসো (প্রোটেকশন অব চিলড্রেন ফ্রম সেক্সুয়াল অফেন্সেস) এবং বাল্যবিবাহ রোধ আইনে মামলাও করেছে পুলিশ। খাস কলকাতার হেস্টিংসে বাল্যবিবাহ এবং অপরিণত বয়সে সন্তানধারণের ঘটনাটি নিয়ে বিচলিত রাজ্যের শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশন। সেই সঙ্গে পারস্পরিক সম্মতিতে সম্পর্কে জড়ানো ১৮-র কাছাকাছি বয়সের যুগল ও তাদের পরিবারের ভোগান্তির বিষয়টিও গুরুতর সামাজিক সমস্যা বলেই অনেকে দেখছেন।
এ রাজ্যে বাল্যবিবাহের বেলাগাম সমস্যার সামনে নাবালক, নাবালিকাদের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার দিকটির কথা প্রায়ই বলেন সমাজকর্মী বা সরকারি প্রতিনিধিরাও। কারও যুক্তি, এ রাজ্যে কম বয়সি মেয়েরাও অনেক ক্ষেত্রে স্বাধীনচেতা। এ দেশের কোনও কোনও রাজ্যের মতো পশ্চিমবঙ্গে মেয়েদের সম্মান রক্ষায় খুনের ঘটনা সচরাচর ঘটে না। তার বদলে ১৮-র কিছু কম বয়সের ছেলেমেয়েদের মধ্যে ভালবাসা বা যৌন মেলামেশা বরং স্বাভাবিক।
কোনও কোনও সমাজকর্মী এ-ও মনে করেন, ১৮-র কাছাকাছি বয়সের কিশোর, কিশোরীদের সম্পর্ককে শুধুমাত্র অপরাধের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখাও ঠিক নয়। গত কয়েক বছরে একাধিক রাজ্যে পকসো মামলার পর্যবেক্ষণে হাই কোর্টও বয়ঃসন্ধির ভালবাসার দিকটিকে স্বীকৃতি দিয়েছে। বছর দুই আগে গৌহাটি হাই কোর্ট চারটি মামলায় অভিযুক্তদের জামিন মঞ্জুর করেছিল। মামলার রায় দিতে গিয়ে বিচারপতি ঘটনাটিকে যৌন হেনস্থা বলে দাগিয়ে দেওয়া নিয়ে প্রশ্নও তোলেন। সাম্প্রতিক অতীতে সুপ্রিম কোর্টেও পকসো আইনের পরিধি নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে বলে আইনজীবীরা জানাচ্ছেন।
রাজ্য শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশনের চেয়ারপার্সন তুলিকা দাস বলছেন, এ ক্ষেত্রে আইন মেনে চলা ছাড়া বিশেষ কিছু করার নেই। তাঁর কথায়, ‘‘১৮ বছরের কম বয়সি বিয়েই বেআইনি। অপ্রাপ্তবয়স্ক দু’জনের সম্মতি থাকলেও তার আইনি স্বীকৃতি অন্তত নেই।’’ সেই সঙ্গে তিনি সতর্ক থাকার কথা মনে করিয়ে বলেন, ‘‘মনে রাখতে হবে, বাল্যবিবাহের সঙ্গে মানব পাচারের মতো অভিযোগও জড়িয়েছে নানা সময়ে।’’ অপ্রাপ্তবয়স্ক যুগল স্বেচ্ছায় সম্পর্কে জড়ালেও তখনই বিয়ে বা মেয়েটির সন্তানসম্ভবা হওয়া ঠেকাতে অভিভাবকদের দায়িত্ব নিতে হবে বলে মনে করেন তুলিকা।
হেস্টিংসের ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, পুলিশের কাছে বয়ানে মেয়েটি বলছে, তার তথাকথিত স্বামীর সঙ্গে স্বেচ্ছায় যৌন সংসর্গের ফলেই সে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে। তবু অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েটির ক্ষেত্রে আইনত ‘সম্মতি’কে সম্মতি বলে ধরতে রাজি নয় পুলিশ। নাবালিকা ও শিশুদের উপরে যৌন হেনস্থা বন্ধে ২০১২ সালের পকসো আইন মেনেই এই সিদ্ধান্ত। বলা হচ্ছে, কিশোরী মা এ ক্ষেত্রে অভিযোগ না-করলেও আইনত তার নাবালক বরও ছাড় পেতে পারে না।
আইনজীবী কল্লোল বসু আবার মনে করাচ্ছেন, এক জন কিশোর বা কিশোরীর যৌন অভিজ্ঞতা অর্জনের আগ্রহ বা সম্মতির সঙ্গে বিয়ের আইনসিদ্ধ বয়সের সম্পর্ক নিয়ে দীর্ঘকাল ধরে চর্চা চলছে। নাবালিকার সঙ্গে যৌন সংসর্গ মাত্রেই আইনত অপরাধ। আবার ধর্ষণ, যৌন হেনস্থার সঙ্গে কাছাকাছি বয়সের যুগলের পারস্পরিক সম্মতিতে যৌন সংসর্গের ফারাকটা বোঝা দরকার। তাঁর কথায়, ‘‘এমন ঘটনার সঙ্গে আইনি ও সামাজিক দিক জড়িয়ে। সমাজের নানা স্তরে এই বিষয়গুলি এবং এর পরিণাম নিয়ে শিক্ষা, সচেতনতা প্রচারের গুরুত্ব আছে।’’ আইনজীবী নীলাদ্রিশেখর ঘোষও বলছেন, পকসো আইনের প্রয়োগের এই দিকগুলি নিয়ে সর্বোচ্চ আদালতেও আলোচনা হয়েছে। তাঁর মতে, অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলে ও মেয়ে, দু’জনেরই বোঝার কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে। কিছু ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগে সহমর্মিতা প্রকাশও গুরুত্বপূর্ণ।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)