Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

কেন মিছিল, জবাব নেই কারও কাছেই

এসএমএসের ডাক বলছিল, এক কথা। মিছিল বলল, আর এক কথা। আয়োজকরা বলেছিলেন, সবাই মিলে জমিয়ে গান হবে ‘পথে এ বার নামো সাথী..!’ গান হয়নি। মিছিলে হাঁটার পরে এক গায়ক চুপিচুপি বললেন, “মিছিল যা হয়েছে, তাতে বরং কিশোরকুমারের ‘এ কী হল, কেন হল’ গাওয়া যেতে পারত।” শুক্রবারের বারবেলার মিছিলে সত্যিই কী হল, আর কেন হল বুঝতে বারবারই বিচিত্র ধন্দ তৈরি হয়েছে।

প্রতিবাদী মিছিলে অন্য উত্তাপ। অরিন্দম শীল ও রাহুল চক্রবর্তী। শুক্রবার অ্যাকাডেমি চত্বরে অরুণ লোধের তোলা ছবি।

প্রতিবাদী মিছিলে অন্য উত্তাপ। অরিন্দম শীল ও রাহুল চক্রবর্তী। শুক্রবার অ্যাকাডেমি চত্বরে অরুণ লোধের তোলা ছবি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০১৪ ০৩:৫৪
Share: Save:

এসএমএসের ডাক বলছিল, এক কথা। মিছিল বলল, আর এক কথা।

আয়োজকরা বলেছিলেন, সবাই মিলে জমিয়ে গান হবে ‘পথে এ বার নামো সাথী..!’ গান হয়নি। মিছিলে হাঁটার পরে এক গায়ক চুপিচুপি বললেন, “মিছিল যা হয়েছে, তাতে বরং কিশোরকুমারের ‘এ কী হল, কেন হল’ গাওয়া যেতে পারত।”

শুক্রবারের বারবেলার মিছিলে সত্যিই কী হল, আর কেন হল বুঝতে বারবারই বিচিত্র ধন্দ তৈরি হয়েছে।

প্রথমত বিভিন্ন সরকারি অনুষ্ঠান বা শাসক দলের প্রচার-সভায় ইদানীং যে মুখগুলো আকছার দেখা যায়, তাঁদের অনেকেই এ দিন অনুপস্থিতের তালিকায়। দ্বিতীয়ত, যাঁরা এসেছেন, তাঁরাও যেন খুব স্বস্তিতে ছিলেন না। এমনকী, তৃণমূলের জনপ্রতিনিধিদের একাংশও না। আর, সেলিব্রিটিদের বাইরে যাঁরা শহরের বুকে সম্ভবত সংক্ষিপ্ততম মিছিলের শরিক হলেন, তাঁরা আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে প্রতিবাদের কারণ ঠাউরে নিলেন।

মিছিলের এক দিন আগেই কবি শঙ্খ ঘোষ প্রশ্ন তুলেছিলেন, “প্রতিবাদীরা কি জানেন, কীসের জন্য এই প্রতিবাদ?” শুক্রবার বেলা আড়াইটে নাগাদ মিছিলে হাঁটা শেষ করেও নামী-অনামীদের বেশির ভাগই জবাবটা ঠিক খুঁজে পেলেন না।

বাংলা সংস্কৃতির উপরে আঘাতের প্রতিবাদে মিছিল ডাকা হয়েছিল। আঘাতটা কোথায়, গোড়ায় বুঝতে পারেননি মমতা-ঘনিষ্ঠ অভিনেতা রুদ্রনীল ঘোষ। এ দিন চুপচাপ হাঁটার পরে বললেন, “যা বলবার অরিন্দম শীলই বলবেন।” মিছিলের একেবারে সামনে সেই অরিন্দমের কাছাকাছিই হাঁটছিলেন গায়ক নচিকেতা। কেন এসেছেন? “তোমরা তো সবই জানো! একজোট হওয়ার ব্যাপার!” বলেই চুপ করে গেলেন।

মন্ত্রী ব্রাত্য বসু বা সাংসদ অর্পিতা ঘোষরাও গুটিয়েই থাকলেন কিছুটা। অর্পিতা বললেন, “আমি আজ ‘নো কমেন্টস’ বলিয়েদের দলে।” আর ব্রাত্যর কথায়, “সকলেই জানেন কেন আমরা মিছিলে।” সাংসদ দেব এসেছিলেন, জনতার সব চেয়ে বেশি নজরও টেনেছেন। তাঁকে দেখতে, তাঁর ছবি তুলতেই মিছিলে জড়ো হয়েছিলেন অনেকে। দেব হাসিমুখে থেকেছেন, কিন্তু বিশেষ কথা বলেননি। “যা বলার পরে বলব”, বলে পাশ কাটিয়েছেন। মিছিলের পরে তাঁকে আর পাওয়া যায়নি। দ্রুত গাড়িতে উঠে চলে গিয়েছেন নায়ক। মিছিলে হেঁটেছেন লোকসভা ভোটে তৃণমূলের পরাজিত প্রার্থী, ভূমি-র সৌমিত্র রায়। ‘কেন এসেছেন’, প্রশ্ন শুনে প্রথমে হাসলেন। তার পরে জবাব এল: ‘কর্তব্য!’

এ রাজ্যে বিভিন্ন প্রতিবাদী আন্দোলনে ধারাবাহিক ভাবে যাঁদের দেখা গিয়েছে, তেমন অনেক মুখই ছিলেন না এ দিন। বিভাস চক্রবর্তী-মনোজ মিত্রের মতো প্রবীণ নাট্যকর্মীরা ছিলেন না। সুবোধ সরকার ছাড়া লেখক-কবিও নেই বললেই চলে। প্রবীণ গায়কদের মধ্যে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় এর আগে মুখ্যমন্ত্রীর অনেক অনুষ্ঠানে থেকেছেন। রাজধানীতে মমতা এবং অমিত মিত্র হেনস্থা হওয়ার ঘটনায় প্রতিবাদে সামিলও হয়েছিলেন। এ দিন তাঁরা নেই। তৃণমূল সাংসদ দেবকে বাদ দিয়ে বিনোদন জগতেরও কিছু উঠতি বা মাঝারি স্তরের মুখ ছাড়া আর কাউকেই জোগাড় করতে পারেননি আয়োজকেরা। সন্ধ্যা রায়, সুপ্রিয়া দেবীর মতো প্রবীণদের তো ছেড়েই দেওয়া গেল। মমতার নানা গণ-বিনোদনী অনুষ্ঠানে বা ২১ জুলাইয়ের মঞ্চেও ইদানীং যে মাপের তারকা সমাবেশ দেখা যায়, এ দিন তা মোটেই ছিল না।

বেলা একটায় মিছিল শুরুর ‘কলটাইম’ পেরিয়ে গেলেও দেব আসা পর্যন্ত সংগঠকেরা তাই অপেক্ষা করেছেন। সামনে বড় ব্যানার রেখে দেবের গা ঘেঁষে হেঁটেছেন মিমি, পায়েল, নুসরত, সায়ন্তিকা বা ‘আঁচল’-খ্যাত ‘টুসু’রা। বিরোধীরা কেউ কেউ তা দেখে কটাক্ষ করেছেন, মুখ্যমন্ত্রী নানা পুরস্কারের ডালি সাজিয়ে যে সেলিব্রিটিদের কাছে টেনেছেন, তাতে কি ভাটা পড়ল? সম্ভাব্য উত্তরও দিয়েছেন অনেকে, “যাঁদের পুরস্কার পাওয়া হয়ে গিয়েছে, তাঁরা বেশির ভাগই নেই। যাঁরা এখনও পাননি, তাঁরা অনেকে আশা নিয়ে এসেছেন!”

কেন এসেছেন মিছিলে? প্রশ্ন করলে নানা রকম ব্যাখ্যা মিলেছে। নাট্যকর্মী দেবেশ চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন, “সাম্প্রদায়িকতার প্রতিবাদে এসেছি। মুখ্যমন্ত্রী কী চক্রান্তের কথা বলেছেন জানি না।” চিত্রপরিচালক বিরসা দাশগুপ্তের ঘোষণা, “কোনও একটা অবস্থান নিতেই হয়। যারা মাঝখানে থাকে তারা দালাল।” অভিনেতা সাহেব ভট্টাচার্যের কথায়, “একটা আপেল খারাপ মানেই তো সবাই খারাপ নয়! রক্তদান-শিবির বা এড্স-সচেতনতা শিবিরের মতোই বাংলার বিষয়ে সচেতন করতে এসেছি।” গায়ক সৈকত মিত্রর মন্তব্য, “যখনই দেশে অস্থিরতা তৈরি হয়, শিল্পীদের উপরেই প্রথম আঘাত লাগে। সেটা রুখতেই এসেছি।” অভিনেত্রী রিমঝিম মিত্র বললেন, “যাতে আমরা ভাল ভাবে কাজ করতে পারি, তার জন্যই আসা।” তৃণমূলের সংগঠনে যুক্ত নায়ক হিরণের আসার কারণ, বাংলার বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় বঞ্চনা। তিনি বলেন, “১০০ দিনের কাজের টাকা পাঠাচ্ছে না, শিল্পীদের জন্য নির্ধারিত টাকা দিচ্ছে না। তাই রাস্তায় নেমেছি।”

দেব ও তাঁর আশপাশে এই জটলাটুকু সামলাতেই এ দিন মিছিলের সংগঠকরা আগাগোড়া ব্যস্ত থেকেছেন। কিন্তু কয়েক পা পিছনেই মিছিলের কঙ্কালসার চেহারাটি বেরিয়ে পড়েছে। সেখানে শহর ও শহরতলির নানা ক্লাবের সদস্যদের ভিড়। কেউ বলছেন, ক্যারাটে সচেতনতা বাড়ানোর কথা। কেউ বলছেন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের কথা। মমতা জমানায় হাত উপুড় করে অজস্র ক্লাবকে অনুদান দেওয়া হয়েছে। তাঁরাও উপর থেকে ‘নির্দেশ পেয়ে’ জড়ো হয়ে গিয়েছেন। রণ-পা, ছৌ মুখোশ করে নেচে নেচে প্রতিবাদী মৌনমিছিলে অংশ নিয়েছেন। সরকারি খয়রাতি বা মন্ত্রী ‘মদনদা’র বদান্যতাই যে তাঁদের মিছিলে টেনে এনেছে, তা অনেকে স্বীকারও করেন। কাঁকুড়গাছির এক ক্লাব সদস্য যেমন বললেন, “মদনদা দু’লক্ষ টাকা না-দিলে ক্লাবটা বন্ধ হয়ে যেত।” অসুস্থ মন্ত্রী অবশ্য সবিনয়ে মিছিলের ব্যাপারে কিছু জানেন না বলেই দাবি করেছেন। কিন্তু চর্মচক্ষেই দেখা গিয়েছে, দল পাল্টানো কবি-গায়ক-অভিনেতা এবং টলিউডের এক প্রযোজক যে মিছিলের হর্তা-কর্তা, সেই মিছিলকে অনেকাংশে নির্ভর করতে হয়েছে মন্ত্রীর উপরেই। মদনের নাম করেই অনেকে নন্দন-চত্বরে ঢুকে শ্রীকান্ত-ইন্দ্রনীল-অরিন্দমদের ভরসা দিয়েছেন। খিদিরপুরের বাসিন্দা রঘুনাথ দত্ত মিছিলে হাঁটতে হাঁটতে সরল হেসে বলেছেন, “মদনদার উপর খুব অন্যায় হচ্ছে। অসুস্থ হয়ে পড়ছে লোকটা। আমাদের প্রতিবাদ জানাতে হবে না!”

হাটখোলা বা সাহাপুরের ব্যায়াম সমিতি, মহিলা ফুটবলারবাহিনী বা অ্যাথলেটিক্স থেকে ক্যারাটের কচিকাঁচারাও কাব্যে উপেক্ষিতের ঢঙে তারকাদের পিছু-পিছু হেঁটেছেন। প্রাক্তন ফুটবলার গৌতম সরকারের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে রাইফেল শু্যটার মাম্পি দাস বলেন, “যাঁরা আমার পাশে থাকেন, তাঁদের পাশে থাকব বলেই এসেছি।” বিদেশ বসু, মানস ভট্টাচার্য, সমরেশ চৌধুরীর মতো প্রাক্তন ফুটবলাররা অবশ্য বিশৃঙ্খলা ও ধাক্কাধাক্কিতে বেশ বিব্রত হয়েছেন। শ্রীকান্ত মোহতার সংস্থার কয়েকজন কর্মী তাঁকে ঠেলে সরিয়ে এগোতে গেলে মানস রুখেও দাঁড়ান।

তার একটু পিছনেই অনামীদের ভিড়ে হাঁটছিলেন দক্ষিণেশ্বরের হীরালাল শীল কলেজের এক ঝাঁক ছাত্রী। তাঁদের কিছু বলতে ইশারায় নিষেধ করলেন জনৈক মাস্টারমশাই। যাদবপুর থেকে আসা দুই মহিলা জানালেন, তাঁরা সত্য পথের পথিক! সারদা নিয়ে কী যেন হয়েছে, তাই এসেছেন! আর এক মহিলা নিজেকে পরিচয় দিলেন তৃণমূল কর্মী বলে। কেন এলেন মিছিলে? সঙ্গীকে দেখিয়ে বললেন, “ওরা বলল, তাই!’’

হাতে-ধরা একটি হোর্ডিং বলছিল, ‘বাংলার সংস্কৃতি ঐতিহ্য যারা চোখ বন্ধ করে নষ্ট করে তাদের জানাই ধিক্কার।’ রবীন্দ্র সদনের গায়ে সাঁটা একটি পোস্টারে জনৈক বিক্ষুব্ধ তৃণমূল নেতার কিন্তু অন্য ঘোষণা, ‘‘প্রতারক ও চোরেদের সর্দারের আদেশে এই মিছিলে যারা হাঁটছে তাদের জানাই হাজার ধিক্কার।” তাতে চোখ পড়তেই প্রায় বিষম খেলেন এক নাট্যকর্মী।

বাম জমানা বা মমতার জমানার নানা প্রতিবাদী কর্মকাণ্ডে শরিক আর এক নাট্যকর্মী কৌশিক সেন মিছিল থেকে দূরে ছিলেন। তাঁর পর্যবেক্ষণ, “যাঁদের মিছিলে হাঁটতে দেখলাম, তাঁদের কারও মুখে কোনও প্রত্যয়ের ছাপ নেই। এমনকী, আমার কোনও কোনও বন্ধুও কেন এসেছেন সে-ভাবে বলতে পারলেন না। সত্যিই এমন প্রতিবাদ দুর্লভ!”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE