কালীঘাটের মন্দিরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল তীর্থযাত্রীদের চাহিদা অনুসারে তৈরি নানা পণ্য। তার অন্যতম ছিল বিশেষ শৈলীতে আঁকা ছবি: ধর্মীয় বিষয়ভিত্তিক, জলরঙে আঁকা, যে ধারাকে আমরা চিনি কালীঘাট পটচিত্র নামে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তীর্থযাত্রীদের পাশাপাশি শহরের সাধারণ মানুষের মধ্যেও এই সব ছবির চাহিদা তৈরি হল। ক্রমশ মুদ্রণপ্রযুক্তি উন্নত ও সহজলভ্য হওয়ায় এসে গেল কাঠখোদাই, এনগ্রেভিং, লিথোগ্রাফ, ওলিয়োগ্রাফ ছবি।
ধর্মীয় বিষয়ের পাশাপাশি, সে কালের কলকাতার ‘বাবু’দের রুচির সঙ্গে তাল মিলিয়ে অন্য ছবিও আঁকতে শুরু করলেন শিল্পীরা। দেবদেবী, পুরাণনির্ভর বিষয়ের ছবির পাশে এল সমাজবাস্তবতা থেকে উঠে আসা ছবিও। সেই ধারাতেই আঁকা হল ‘পানসুন্দরী’ (মাঝের ছবি), ‘গোলাপসুন্দরী’ গোত্রের ছবি। বাবুদের হাবভাব-চালচলনের ব্যঙ্গও উঠে এল ছবিতে। ছবির বাজারে ‘বাবু’ হয়ে ওঠেন নিয়ন্ত্রক চরিত্র। বাবু-বিবি নাচের দৃশ্যের সঙ্গে, নারীর দাপটে বাঘে-গরুতে এক পাত্রে খাবার খাওয়ার তির্যক সামাজিক টিপ্পনীও ছবিতে তুলে ধরেন পটুয়ারা।
উনিশ শতকের কলকাতায় বাবু ও ছবির বাজারের এই বহুমাত্রিক সমীরকরণ তুলে ধরেছে দিল্লি আর্ট গ্যালারি (ডিএজি) আয়োজিত প্রদর্শনী ‘দ্য বাবু অ্যান্ড দ্য বাজ়ার: আর্ট ফ্রম নাইন্টিনথ অ্যান্ড আর্লি টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি বেঙ্গল’ শীর্ষক প্রদর্শনী। গত ২৬ সেপ্টেম্বর আলিপুর মিউজ়িয়মে শুরু হওয়া এই প্রদর্শনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে রয়েছে তৈলচিত্রের সম্ভার। ইউরোপীয় অ্যাকাডেমিক শৈলীতে বাংলার শিল্পীদের গোড়ার দিকের তেলরং ব্যবহারের নিদর্শনগুলি নজর কাড়ে। আলো-ছায়া ও দৃশ্যপটের ব্যবহারে ধর্মীয় বিষয়ের ছবিও নতুন মাত্রা পায়, পৌরাণিক চরিত্রও হয়ে ওঠে সমকালীন। যেমন, গোপিনীদের আদরে কিশোর কৃষ্ণের আনন্দে লাফানোর চিত্রায়ণে (উপরের ছবি) আমরা পটভূমি হিসাবে যে স্থাপত্য দেখতে পাই, ব্রজভূমির কোনও কুটিরের চেয়ে তা ঢের বেশি মনে করায় সে কালের কলকাতার ঔপনিবেশিক গৃহস্থাপত্যকে।
আঠারো শতকে কাচের উপর রিভার্স গ্লাস আর্টের সঙ্গে উপমহাদেশের শিল্পরসিকদের পরিচয় হয় চিনা, মতান্তরে পার্সি বণিকদের সূত্রে। পরবর্তী এক শতকে এই শিল্পধারা বেশ জনপ্রিয় হয়। প্রদর্শিত এই শৈলীর ছবিগুলি তৈরি হয়েছিল চিনের ক্যান্টন-এ, উনিশ শতকে ভ্রাম্যমাণ বাণিজ্যপসরা হিসাবে এসেছিল এ দেশে। আবার অনেক শিল্প-ইতিহাসবিদের মতে, ছবিগুলির হয়তো এ দেশে বসবাসকারী চিনা শিল্পীদের আঁকা। উৎস নিয়ে দ্বিমত থাকলেও পটচিত্রের সঙ্গে সাদৃশ্য থেকে বোঝা যায়, বাজার হিসেবে শিল্পীরা কলকাতা তথা বাংলাকে ভেবেই এঁকেছিলেন এ ছবি। অদিতি নাথ সরকারের কিউরেশনে তৈরি প্রদর্শনীটি উনিশ শতকের কলকাতার আর্থ-সামাজিক ইতিহাস তুলে ধরে চিত্রশিল্পের আলোয়। দেখা যাবে আগামী ৩ জানুয়ারি পর্যন্ত। ছবি, প্রদর্শনী থেকে।
সার্ধশতবর্ষে
মহামায়াকে যেমন স্বীকার করতে হয়, তেমনই তার অস্বীকারেও নিহিত সত্যের উন্মোচন— দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের এই ‘অল্টারনেশন’ তত্ত্বটি তর্কশাস্ত্রে কৃষ্ণচন্দ্র ভট্টাচার্যের (ছবি) মৌলিক অবদান। ১৮৭৫ সালে হুগলির শ্রীরামপুরে এক পণ্ডিত পরিবারে জন্ম, পারিবারিক সংস্কৃত-চর্চার পরম্পরা তাঁকে এগিয়ে দেয় দর্শন-চর্চার পথে। বিশ শতকের শুরুতেই পেয়েছিলেন প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ বৃত্তি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তৎকালীন ‘কিং জর্জ দ্য ফিফথ চেয়ার’ অধ্যাপক ছিলেন। আবু সয়ীদ আইয়ুবের মতে, কৃষ্ণচন্দ্র ‘নিঃসন্দেহে এ-দেশে নবযুগের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক’। তাঁর সার্ধশতবর্ষে (জন্ম ১৮৭৫) শিবনারায়ণ রায় প্রতিষ্ঠিত জিজ্ঞাসা পত্রিকা তাদের সাম্প্রতিক সংখ্যায় (সম্পা: সন্দীপ পাল) বিশেষ ক্রোড়পত্র করেছে, রয়েছে কৃষ্ণচন্দ্রের একটি দুষ্প্রাপ্য রচনা-সহ আরও ছয়টি প্রবন্ধে তাঁর দার্শনিক চিন্তার উৎস-সন্ধান। এ ছাড়াও ইমানুয়েল কান্ট-এর তিনশো বছর স্মরণে বিশেষ আলোচনা, নিয়মিত বিভাগে নিবন্ধ গল্প কবিতা গ্রন্থ-আলোচনাও।
শিল্প ও শিল্পী
একদা-বিখ্যাত সারকারিনা থিয়েটার আজ কোথায়! নব্বই দশকে পুড়ে গিয়েছিল স্টার; পরে বিশ্বরূপা, রঙমহলও। নতুন মঞ্চ তৈরি হল না, হল শপিং মল, আবাসন। শুধু শহরেই নয়, গ্রামেও নষ্ট হয়েছে লোকজীবন ও সংস্কৃতি, বহু শিল্প ও শিল্পীর জীবন। এমনই এক শিল্প দিনাজপুরের গমীরা নাচ, যা আজ প্রায় লুপ্ত। এই গমীরা ও মুখা নাচকে কেন্দ্র করেই ‘অনীক’ নাট্যদলের নতুন প্রযোজনা আঙিনা জুড়ে ভোর— অবিভক্ত দিনাজপুরের ঐতিহ্য খন পালাগান, শ্রীমতী নদীতীরের কোলাহল, গমীরা শিল্পীদের সংগ্রামই উপজীব্য। যুগ যুগ ধরে লালিত সংস্কৃতি কি পুঁজির আধিপত্যে হারিয়ে যাবে, নাকি অন্ধকার সরিয়ে ফের উজল হয়ে উঠবে! গৌরব দাসের রচনা ও নির্দেশনায় এই নাটকের অভিনয় আগামী ৩১ অক্টোবর সন্ধে ৬টায়, তপন থিয়েটারে।
চির সংগ্রামী
তেভাগা আন্দোলনের নেত্রী হিসেবে তাঁর লড়াই, কারাজীবনে অমানুষিক নির্যাতনের জবানবন্দির কথা বহুশ্রুত। ইলা মিত্রের অসাধারণত্ব আসলে আমৃত্যু ন্যায়ের পথে চলার নাছোড় মানসিকতায়। কমিউনিস্ট এই নেত্রী সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন ‘নাচোলের রানিমা’ পরিচয়ে, ১৯৪৬-এর দাঙ্গার প্রেক্ষাপটে। এই পর্বের ইলা মিত্রকে নতুন ভাবে চিনিয়ে দিলেন গবেষক-লেখক শর্মিষ্ঠা দত্তগুপ্ত, ‘ইলা মিত্র শতবর্ষ উদ্যাপন’ অনুষ্ঠানে। তেভাগার অবিসংবাদিত নেত্রীর জন্মদিনে গত ১৮ অক্টোবর আলোচনার উদ্যোগ করেছিল অশোকনগরের ‘অহর্নিশ গ্রন্থাগার’ ও ‘আনন্দধারা’। উপস্থিত বহু ছাত্রছাত্রী বসে শুনল ইলার কথা; অনল পাল বললেন ‘তেভাগার সাহিত্য’ নিয়ে।
গান-বন্ধু
গানে গানে পরিচয়। তার পর বন্ধুতা। অসমের জ়ুবিন গর্গকে তো চেনেই সারা কলকাতা তথা বাংলা, আর টুনাই দেবাশীষ গঙ্গোপাধ্যায় তাঁকে দেখেছেন-চিনেছেন বন্ধুতার নৈকট্য থেকে: এক সঙ্গে গানবাজনায়, স্টুডিয়োয় রেকর্ডিংয়ে, বাড়িতে গল্পগাছায় বা ঘোরাফেরায়। দুর্ঘটনায় সেই প্রিয় বন্ধুই ‘অতীত’ হয়ে গেলে, ঘটমান বর্তমান আচমকা ‘স্মৃতি’তে পর্যবসিত হলে সেই শোক আঘাত হয়ে আসে, দেবাশীষ ও তাঁর সঙ্গীত-প্রতিষ্ঠান ‘সমর্পণ’-এর সদস্য-শিক্ষার্থীরা তার উত্তরণে আয়োজন করেছেন অনুষ্ঠান, ‘অপরাজেয় জ়ুবিন’। শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণের এই যাত্রায় সঙ্গী আলোকচিত্রী অতনু পালের প্রতিষ্ঠান ‘থার্ড আই’ও। যতীন দাস রোডের উইজ়ডম ট্রি কাফে-তে, আগামী ২৮ অক্টোবর সন্ধ্যা ৬টায়।
মঞ্চে নতুন
ঝড়জলের এক সন্ধ্যায়, পার্টি থেকে ফেরার পথে খ্যাত লেখক সুপ্রকাশ মিত্র তাঁর দরজায় গোড়ায় আবিষ্কার করলেন অজ্ঞাতপরিচয় এক মৃতদেহ। সন্দেহের জেরে তাঁকেই গ্রেফতার করল পুলিশ, ও দিকে তদন্তভার নিয়ে কাজে নামলেন এক গোয়েন্দা, রবার্ট রামকৃষ্ণ হালদার। ঘটনা জটিলতর হয়ে ওঠে ক্রমে, জড়িয়ে পড়েন তিন বন্ধু, লেখকের স্ত্রী, অনেকেই। প্রচলিত পথে না হেঁটে এক মনঃসমীক্ষণ প্রক্রিয়া শুরু করেন গোয়েন্দা, আর দর্শকের সামনে ফুটে ওঠে এক উদ্ভট, বিচিত্র নাট্য‘থ্রিলার’, সরলরেখা বক্ররেখা। শেখর সমাদ্দারের রচনা; দেবাশিস রায়ের নির্দেশনায় প্রধান দু’টি চরিত্রে অভিনয় করছেন শঙ্কর চক্রবর্তী ও সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘আভাষ’ নাট্যগোষ্ঠীর প্রযোজনায় নাটকটির প্রথম অভিনয় আজ দুপুর ৩টেয় অ্যাকাডেমি মঞ্চে।
ছবির রবি
কবি, গীতিকার, নাট্যকার, গল্পলেখক, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক— রবীন্দ্রনাথ তো এই প্রতিটি পরিচয়েই বঙ্গ ও বিশ্বের শ্রদ্ধার্হ। গ্রামোন্নয়নের কান্ডারি, সমবায়-ভাবনার দিশারি, নতুন শিক্ষাচিন্তার চিন্তকও তিনি। রবীন্দ্রসৃষ্টিবিশ্বের চর্চায় আজ, এত কাল পরেও খানিক কমই আলোচিত, চিত্রকলায় তাঁর অবদানের (ছবি) বিষয়টি। পূরবী কাব্যের পাণ্ডুলিপির পাতায় কাটাকুটির মধ্য দিয়ে তৈরি হওয়া ছবি পরবর্তী কালে পেয়েছে স্বকীয় এক ধারা: প্রচুর ছবি এঁকেছেন, দেশে-বিদেশে প্রশংসা পেয়েছে সেই কৃতি। আগামী ২৭ অক্টোবর সোমবার সন্ধ্যা ৬টায় কালীঘাট পার্কের ‘টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট’-এ রবীন্দ্রনাথের শিল্পভাবনার স্বকীয়তা নিয়ে বলবেন শিল্পী-অধ্যাপক ইন্দ্রপ্রমিত রায়। বিশ্বভারতী ও মহারাজা সয়াজীরাও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী শিল্প-শিক্ষক তুলে ধরবেন ‘ছবির রবীন্দ্রনাথ’কে।
শারদ সুরে
কালীপুজো চলে গেল, এই সময়টায় পান্নালাল-ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের সঙ্গেই মনে ভাসে প্রতিমার সামনে গীতরত রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের (ছবি) স্মৃতি। সংগ্রাহক রামকুমার চট্টোপাধ্যায়কে ক’জন চেনেন! স্ব-সংগ্রহের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত, রাগপ্রধান, গজল, আখড়াই, আধুনিক, রঙ্গগীতি, আরও নানা ঘর-ঘরানার গান তিনি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন বাঙালির অন্দরমহলে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তাঁকে বলতেন ‘গানের সমুদ্র’। বাংলা ও ভারতীয় সঙ্গীতজগতের এমন বহু মণিকণা নানা লেখায় সাজিয়ে দিয়েছে হংসধ্বনি পত্রিকার (সম্পা: সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়) শারদ সংখ্যাটি। শ্রীচৈতন্যের সময় কীর্তনের রূপ, কালীসাধনা ও শ্যামাসঙ্গীত, আধুনিক বাংলা নাটকে গান, আবহসঙ্গীতের প্রচলন, দেশভাগ ও লোকায়ত গান ইত্যাদি নানা বিষয়ে লেখা, সঙ্গে বেতার জগৎ-এ প্রকাশিত নির্বাচিত নিবন্ধের পুনর্মুদ্রণ। সিদ্ধেশ্বরী দেবী, উস্তাদ ফৈয়াজ় খাঁ, শান্তিদেব ঘোষ প্রমুখের উপরেও আলোকপাত।
বিবেকী কণ্ঠ
১৯৪৬-এর ১৬ অগস্ট আবুল হাশিম দুই ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন কলকাতায়, ময়দানে মুসলিম লীগের বিশাল জনসমাবেশে। বদরুদ্দীন উমরের আত্মকথায় ধরা আছে সেদিনের স্মৃতি, এবং তার পরের ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, কংগ্রেস-মুসলিম লীগ ও কমিউনিস্ট রাজনীতির গতিপ্রকৃতিরও বিশদ বিবরণ। তার পর তো দেশভাগ হল, ১৯৫০-এর এপ্রিলে বর্ধমানের সর্বস্ব বিক্রি করে ঢাকায় চলে গেল পুরো পরিবারটি; পরের দুই দশকে ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের যাত্রাপথের শুধু সাক্ষীই ছিলেন না বদরুদ্দীন উমর, তাঁর রাজনৈতিক মননবলে হয়ে উঠেছিলেন জাগ্রত বিবেকী কণ্ঠ। গত সেপ্টেম্বরে প্রয়াত এই ‘র্যাডিক্যাল পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল’-এর স্মরণে আলোচনার আয়োজন করেছে সেন্টার ফর স্টাডিজ় ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস কলকাতা। ২৭ অক্টোবর বিকেল সাড়ে ৫টায় যদুনাথ ভবন মিউজ়িয়ম অ্যান্ড রিসোর্স সেন্টারের সভাকক্ষে বলবেন অধ্যাপক পার্থ চট্টোপাধ্যায়-সহ বিশিষ্টজন, দেখানো হবে তথ্যচিত্রও।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)