Advertisement
E-Paper

‘ঘরে বসেই যে কোনও মুহূর্তে মৃত্যু হতে পারে’

গড়িয়াহাট মোড়ের গুরুদাস ম্যানসনের ঘুপচি দরজা পেরিয়ে নড়বড়ে সিঁড়ি উঠে গিয়েছে ছাদ পর্যন্ত। ফাটল ধরা দেওয়ালে তারের জট দেখতে দেখতে পাঁচতলা পর্যন্ত পৌঁছে পা আটকে গেল।

নীলোৎপল বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৩:৩৬
গড়িয়াহাটে গুরুদাস ম্যানসনের দেওয়ালে তারের জঙ্গল

গড়িয়াহাটে গুরুদাস ম্যানসনের দেওয়ালে তারের জঙ্গল

গড়িয়াহাট মোড়ের গুরুদাস ম্যানসনের ঘুপচি দরজা পেরিয়ে নড়বড়ে সিঁড়ি উঠে গিয়েছে ছাদ পর্যন্ত। ফাটল ধরা দেওয়ালে তারের জট দেখতে দেখতে পাঁচতলা পর্যন্ত পৌঁছে পা আটকে গেল। আর এগোনোর উপায় নেই! ছাদের দরজা বন্ধ। শত ডাকাডাকিতেও দরজা খুলে দেওয়ার লোক পাওয়া গেল না!

বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়েই মনে পড়ে গেল স্টিফেন কোর্টের অগ্নিকাণ্ডের সেই ভয়াবহ ঘটনার কথা! সেখানে এ রকম বন্ধ থাকা সিঁড়ির দরজার সামনেই পুড়ে মরতে হয়েছিল ১৭ জনকে। তৎকালীন পুলিশ কমিশনার গৌতমমোহন চক্রবর্তী জানিয়েছিলেন, দ্রুত ছাদে পৌঁছে গিয়েও ওই সিঁড়ির দরজা খুলে দেওয়া যায়নি স্রেফ বাড়ির ‘প্ল্যান’ হাতে না থাকায়। সিঁড়িটি তাঁরা দেখতেই পাননি। পরে ওই সিঁড়িতেই মেলে একের পর এক দগ্ধ দেহ। কোনও বিপদ ঘটলে গুরুদাস ম্যানসনের এই সিঁড়ির দরজা দিয়েও তো ছাদে বেরোনোর উপায় নেই! বাড়ির দোতলার ভাড়াটে সুস্মিতা সাহা বললেন, ‘‘এই বাড়িতে প্রাণের নিরাপত্তা নেই। ছাদ পর্যন্ত যেতে হবে না। ঘরে বসেই যে কোনও মুহূর্তে মৃত্যু হতে পারে।’’

অথচ, বছর আটেক আগে গড়িয়াহাট মোড়ের এই বাড়িটিই অগ্নিবিধির দিক থেকে ‘বিপজ্জনক’ বলে ঘোষণা করেছিল প্রশাসন। ২০১০ সালের মার্চে স্টিফেন কোর্ট-কাণ্ডের পরে শহরের বাজারগুলির পাশাপাশি বহুতলগুলিরও স্বাস্থ্য খতিয়ে দেখতে একটি বিশেষজ্ঞ-দল তৈরি করেছিল প্রশাসন। কলকাতা পুলিশের তৎকালীন স্পেশ্যাল কমিশনার বাণীব্রত বসুর নেতৃত্বাধীন ওই দলে পুলিশ, দমকল, পুরসভা, সিইএসসি-র পাশাপাশি বিদ্যুৎ দফতরের কর্মীরাও ছিলেন। শহরের ৩৩টি বাজার ছাড়াও ১২টি বহুতলকে আগুন সংক্রান্ত নিরাপত্তার দিক থেকে ‘বিপজ্জনক’ ঘোষণা করেছিলেন তাঁরা। সেই তালিকাতেই ছিল গুরুদাস ম্যানসন।

পার্ক স্ট্রিটে কুইন্স ম্যানসনের মিটার বক্সে জড়িয়ে তারের জট।

আট বছর বাদে মঙ্গলবার সেখানে গিয়ে দেখা গেল, বিপদের নিরিখে ওই বহুতলটির কোনও পরিবর্তন ঘটেনি। আগের মতোই প্রাণ হাতে করে জীবন কাটছে বাড়ির অন্তত শতাধিক ভাড়াটের। ছাদ বিক্রি হয়ে গিয়েছে বিজ্ঞাপন সংস্থার কাছে। বাড়িতে তিনটি সিঁড়ি রয়েছে। সেগুলি ব্যবহারের অযোগ্য। অবস্থা এমনই যে, নীচের তলার বারান্দা দখল হয়ে গিয়েছে দীর্ঘদিন। বাড়ির বাসিন্দাদের একাংশের অভিযোগ, নিয়ম না মেনেই সেখানে খাবারের দোকান চলে। নীচের বারান্দায় ওই সব দোকানের ডাঁই করা বর্জ্যের গন্ধে টেকা দায়। তার সঙ্গে নোনা ধরা দেওয়াল জু়ড়ে বিদ্যুতের তারের জট। এমনকি, বাড়ির সিঁড়ি দখল করেই শুয়ে থাকেন ব্যবসায়ীরা। তাঁরা আদৌ ভাড়াটে কি না, উত্তর নেই।

বাড়ির অন্যতম মালিক অসিত কুণ্ডু চৌধুরী গুরুদাস ম্যানসনে থাকেন না। পরিবার সূত্রে ৩৬টি ফ্ল্যাটের ভাগ পেয়েছেন তিনি। সঙ্গে একতলার কয়েকটি ভাড়ায় দেওয়া দোকানঘরও তাঁর অধীনে। বাড়ির এ হেন অবস্থার দায় তিনি অবশ্য ভাড়াটেদের উপরেই চাপিয়েছেন। বললেন, ‘‘অনেক ভাড়াটে রেন্ট কন্ট্রোলে ভাড়া দেন। সেই টাকা পেতে বহু ঝক্কি। সেই কারণে টাকা নিতেও যাই না। নিজের খরচে আর কত মেরামত করব!’’ ভাড়াটে সুস্মিতা অবশ্য জানাচ্ছেন, অসিতবাবু কোন ভাড়াটেদের কথা বলছেন, তাঁর জানা নেই। তাঁর ঘরের মাসিক ভাড়া সাত হাজার টাকা তিনি মালিকের হাতেই দেন। অসিতবাবুর দিকের ছাদের দরজা বন্ধ। বিপদ ঘটলে কী হবে? মালিকের বক্তব্য, ‘‘বিপদের সময়ে কেউ ছাদ ঠিক খুলে দেবেন। অত ভয়ের কিছু নেই।’’

গুরুদাস ম্যানসনের মতোই প্রশাসনের বিপদ-তালিকায় ছিল স্টিফেন কোর্টের পাশের কুইন্স ম্যানসনও। পড়শির অগ্নিদগ্ধ চেহারা দেখেও এই বাড়ি যে কিছুই শেখেনি, তা দেখা গেল এ দিনের পরিদর্শনেই। পার্ক স্ট্রিটের বিশাল জায়গা জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছ’তলা বাড়িটিতে পাঁচটি গেট। প্রতিটি গেটে ঢুকতেই চোখে পড়ে তারের জট। মিটার বক্সের সঙ্গে জড়ানো তারের জট দেখে বটগাছের ঝুরি বলে ভ্রম হতে বাধ্য। কুইন্স ম্যানসনের প্রতিটি তলেই অগ্নিনির্বাপক রয়েছে, তবে অধিকাংশই মেয়াদ-উত্তীর্ণ। যে ক’টি নতুন, সবই বহুতলের নীচে নিরাপত্তারক্ষীদের ঘরে রাখা। প্রধান নিরাপত্তারক্ষী বিশ্বজিৎ নস্করের দাবি, দিন পনেরো আগেই কুইন্স ম্যানসনের একতলায় আগুন লেগেছিল। দমকলের ইঞ্জিন আসার আগে তাঁরাই আগুন নিভিয়ে ফেলেন। ওই বাড়ির দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক অসীম মিশ্র বললেন, ‘‘পুরনো অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রচুর সংস্কার করা হয়েছে। তেমন ভয়ের ব্যাপার নেই।’’ তবে অন্য নিরাপত্তারক্ষীরা বলছেন, ‘‘এমনি সবই ভাল। এক বার আগুন লাগলে নেভানো যাবে কি না, কেউ জানে না।’’

—নিজস্ব চিত্র।

Bagri Market Fire Kolkata fire gariahat Gurudas mansion
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy