Advertisement
১৮ মে ২০২৪
বিজয়গড়

বাইরের চেহারা বদলালেও পাল্টায়নি অন্তরের চরিত্র

আমার পাড়া বিজয়গড়। সেই ১৯৪৯ সাল থেকে এখানে বসবাস। তবে সে সময় ও আজকের বিজয়গড় যেন ভিন্ন দুই জগৎ। আমূল পরিবর্তন ঘটেছে আমাদের সেই আটপৌরে পাড়াটার। তবু বদলায়নি সম্পর্কের নৈকট্য, ভাবনাচিন্তার বিনিময়, পারস্পরিক দেখা-সাক্ষাৎ আর ষাট-পঁয়ষট্টি বছর পুরনো প্রতিবেশীদের সঙ্গে থাকার অভ্যেসটা।

উৎপল রায়
শেষ আপডেট: ১৮ জুন ২০১৬ ০৭:২১
Share: Save:

আমার পাড়া বিজয়গড়। সেই ১৯৪৯ সাল থেকে এখানে বসবাস। তবে সে সময় ও আজকের বিজয়গড় যেন ভিন্ন দুই জগৎ। আমূল পরিবর্তন ঘটেছে আমাদের সেই আটপৌরে পাড়াটার। তবু বদলায়নি সম্পর্কের নৈকট্য, ভাবনাচিন্তার বিনিময়, পারস্পরিক দেখা-সাক্ষাৎ আর ষাট-পঁয়ষট্টি বছর পুরনো প্রতিবেশীদের সঙ্গে থাকার অভ্যেসটা।

অসংখ্য বহুতল, নতুন-পুরনো বাড়ি, আলো ঝলমলে দোকান, প্রশস্ত রাস্তাঘাট নিয়ে বিজয়গড় এলাকায় রয়েছে মোট এগারোটি ওয়ার্ড। মূলত পূর্ববাংলা থেকে আসা মানুষের বসবাস এখানে। সেই সময়ে আশেপাশের অব্যবহৃত জমিতে গড়ে উঠেছিল উদ্বাস্তু কলোনি। বেশির ভাগ বাড়ি ছিল দরমার বেড়া ও টালির ছাউনির। পাকা বাড়িগুলি তো তৈরি হয়েছে পরবর্তী কালে। কয়েকটি সরু পিচের রাস্তা থাকলেও, বেশির ভাগই ছিল কাঁচা। দু’পাশে ছিল খোলা নর্দমা। পল্লিশ্রীতে তখন ছিল বেগুন খেত। এক কালের এই কলোনি এলাকা এখন কিন্তু যে কোনও উন্নত পাড়ার সঙ্গে তুলনীয়। তবে এখানে প্রত্যেকের অতীতের সঙ্গে মিশে আছে দেশভাগের মর্মান্তিক প্রেক্ষাপট, যা সকলকে একটি সূত্রে গেঁথে রেখেছে। হয়তো এ কারণেই মানুষে মানুষে রয়েছে সহনশীলতা, সহানুভূতি আর একে অপরকে সাহায্য করার মানসিকতা। সময় বদলালেও বদলায়নি বিপদে-আপদে পাশে দাঁড়ানোর অভ্যেসটাও।

এ পাড়ায় আসার পরে দেখেছি রাস্তায় কোনও আলো ছিল না। সন্ধ্যার হলেই ঝুপ করে পাড়াটা ডুব দিত অন্ধকারে। শোনা যেত শিয়ালের ডাক। রাস্তার ধারের বাড়িগুলির মৃদু আলো আর সহস্র জোনাকিই ভরসা ছিল পথচলতি মানুষের। বৈদ্যুতিক আলো তো এসেছে অনেক পরে। আর এখন তো পাড়াটা আলো ঝলমলে, ঝাঁ চকচকে। এলাকার উন্নয়নে কাউন্সিলর মৃত্যঞ্জয় চক্রবর্তী ভাল কাজ করছেন। মানুষের সমস্যার সমাধানেরও চেষ্টা করেন। নিয়মিত রাস্তা পরিষ্কার, জঞ্জাল অপসারণ হয়। দেখে ভাল লাগে যে এলাকার মানুষ আগের তুলনায় বেশি সচেতন হওয়ায় পাড়াটা পরিচ্ছন্ন থাকে।

অতীতে এ অঞ্চলের নাম ছিল আরাকপুর। আগে এলাকায় ছিল মিলিটারি ক্যাম্প এবং কয়েকটি কাঠের বাড়ি। ক্যাম্পের একটি বড় হলঘরে ছিল স্টেজ। পরে সেখানেই তৈরি হয় নিরঞ্জন সদন। পরিত্যক্ত মিলিটারি ক্যাম্পে দরমার বেড়া ঘিরে শুরু হয় বিজয়গড় বাস্তুহারা বিদ্যাপীঠ যা বিজয়গড় বিদ্যাপীঠ নামে পরিচিত। তেমনই মিলিটারি ব্যারাকেই শুরু হয় বিজয়গড় জ্যোতিষ রায় কলেজও।

ভিটেমাটিহারা এই মানুষগুলির ছিল দূরদর্শীতা। তাঁরা জানতেন, আগামী প্রজন্মের ভিত শক্ত করতে শিক্ষার প্রয়োজন। তাই অন্নসংস্থানের ব্যাপারে অনিশ্চয়তা থাকলেও তাঁদেরই উদ্যোগে একে একে গড়ে ওঠে স্কুল। এলাকায় এক বর্গ মাইলের মধ্যে রয়েছে ১১টি স্কুল। আসলে শিক্ষা, মানবিক মূল্যবোধ, আর সংগ্রামী মানসিকতাই ছিল এ অঞ্চলের মানুষের মূলধন।

সত্তরের দশকের গোড়া দিকে তো এখানে দিনগুলি ছিল উত্তপ্ত। নকশাল আন্দোলনের সময়ে এলাকার মানুষ আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাতেন। এমনকী দিনের বেলাতেও দোকানপাট ঠিক মতো খুলত না। সন্ধ্যার পরে কেউ পাড়ায় বেরোতেনও না। আজকের পাড়াটা কিন্তু নির্ঝঞ্ঝাট এবং শান্তিপূর্ণ। বাসিন্দাদের মধ্যে ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকলেও তা নিয়ে কোনও সমস্যা নেই।

এখন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জনসংখ্যা বাড়ায় এ পাড়ায় আর ফাঁকা জায়গা নেই। বেড়েছে জমির দামও। কিছু বাড়ি ভেঙে বহুতল তৈরি হলেও জমিগুলি কিন্তু হাতবদল হয়নি। এসেছে কত পরিবারও। তবু পাড়া পাড়া ব্যাপারটা এখনও পূর্ণমাত্রায় রয়েছে। ফলে পরিবর্তনের জোয়ারে আশেপাশের অনেক পাড়াই যখন বদলে যাচ্ছে, তখন আমাদের পাড়ার বাইরের চেহারাটা বদলালেও, অন্তরের চরিত্রটা কিন্তু বদলায়নি। আগের তুলনায় খানিক কমে গেলেও হারায়নি আড্ডার ঐতিহ্যটাও। বিশেষত রবিবার তা আরও ভাল ভাবে বোঝা যায়। আড্ডাটা বসে পাড়ার মুখে কর্পোরেশনের একটি পরিত্যক্ত পাইপের উপরে। এ ছাড়াও কিছু দোকানের সামনে বসে জমাটি আড্ডা। এখন আড্ডা দেন মূলত নবীন এবং মাঝবয়সীরা। হয়তো দেখা-সাক্ষাৎ হয় বলেই মানুষে মানুষে যোগাযোগ আর টান আজও রয়ে গিয়েছে।

আমাদের পাড়ায় বরাবরই রয়েছে ক্লাব কালচার। আশেপাশের অভিযাত্রী, জাগরণী, অগ্রগামী, চৈতালির মতো বিভিন্ন ক্লাব এক সময়ে এলাকার মানুষের উপরে সাংস্কৃতিক ও নান্দনিক প্রভাব বিস্তার করেছিল। তেমনই মানুষে মানুষে ঐক্য সৃষ্টিতেও তাদের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। পাড়ায় ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের চল। যা এখন কিছুটা কমলেও সমাজ সেবামূলক কাজের সঙ্গে এখনও যুক্ত এখানকার ক্লাবগুলি। এলাকায় খেলাধুলোর চলটা কিন্তু আগের তুলনায় অনেকটাই কমেছে। শুধু ছুটির দিনগুলিতে আশেপাশের মাঠে ছেলেমেয়েদের খেলতে দেখা যায়। এ পাড়ায় পার্কিং সমস্যা না থাকলেও অন্য পাড়ার অনেকেই এখানে গাড়ি রাখেন। তবে রাস্তাটি চওড়া হওয়ায় যাতায়াতে কোনও অসুবিধা হয় না। তবে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত যত বাড়ে, বাইক বাহিনীর দাপট এবং বেপরোয়া বাইক চলাচলের জন্য হাঁটাচলার অসুবিধা হয়।

এখানে কিন্তু প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে পুজো হয়। আমাদের পাড়ার পুজোটিও সমান আকর্ষণীয়। নবমীর দিন হয় পংক্তি ভোজন। মনে পড়ে কৈশোরে দুর্গাপ্রতিমার বিসর্জনের পরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিজয়া করার সে কি ধুম! প্রতি বাড়িতে তৈরি হত নারকেল নাড়ু, কুচো নিমকি। বিজয়া পর্ব সারতে রাত দুটো-আড়াইটে বেজে যেত। এখন অবশ্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিজয়া করার প্রচলন অনেক কমেছে।

শহরের অন্যত্র, অভিজাত এলাকায় থাকার সুযোগ সত্ত্বেও এ পাড়াটা ছেড়ে যাবার কথা ভাবতে পারিনি। শিকড়ের টান, অতীতের জীবনসংগ্রামের সাক্ষী এ পাড়াটা। সে সব স্মৃতি আজও পিছু ডাকে। তাকে উপেক্ষা করা কি সহজ ব্যাপার?

প্রাক্তন অধ্যাপক
ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Bijoygarh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE