দু’জনে ‘গুরু-ভাই’। এক গুরু-ভাইয়ের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের তদন্ত অন্য গুরু-ভাই কী ভাবে করবেন, তা নিয়ে তোলপাড় কলকাতা পুলিশের নিচুতলা।
এক জন আলিপুরের দোর্দণ্ডপ্রতাপ তৃণমূল নেতা প্রতাপ সাহা। অন্য জন আলিপুর থানার ওসি বুদ্ধদেব কুণ্ডু। প্রথম জন রাজ্যের পুরমন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিমের ঘনিষ্ঠ বলে এলাকায় পরিচিত। আর দ্বিতীয় জন পুলিশ মহলে। ১৪ নভেম্বর আলিপুর থানায় তাণ্ডব চালান স্থানীয় বিধানচন্দ্র রায় কলোনির বাসিন্দারা। সেই কলোনি কমিটির সভাপতি প্রতাপ। তাঁর বিরুদ্ধে সে দিন অভিযোগ লেখা না হলেও ওই দিন থানায় উপস্থিতি পুলিশের নিচুতলা জানাচ্ছে, ঘটনার পিছনে প্রতাপেরই উস্কানি রয়েছে। তা হলে এমন গুরু-ভাইয়ের বিরুদ্ধে কী ভাবে তদন্ত করবেন বুদ্ধদেববাবু?
আলিপুর কাণ্ডের পর পুলিশমহলে কয়েকটি ঘটনা পরম্পরায় এই প্রশ্ন আরও উঠছে। হামলা হয় গত শুক্রবার। পরদিনই লালবাজারে পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ করপুরকায়স্থ পদস্থ অফিসারদের নিয়ে জরুরি বৈঠক ডেকে জানতে চান, কী করণীয়। লালবাজার সূত্রের খবর, এক আইপিএস অফিসার স্পষ্ট বলেন, “ওসি-র অপদার্থতার জন্যই এত বড় কাণ্ড ঘটে গিয়েছে। তিনি পরিস্থিতি সামলাতে পারেননি।” বেশ কয়েক জন আইপিএস-ও তাঁকে সমর্থন করেন।
সোমবার পর্যন্ত ওসি-র কাছে কোনও ব্যাখ্যা তো তলব করেইনি লালবাজার, উল্টে তাঁকেই এই ঘটনা তদন্ত সামলাতে বলা হয়েছে!
প্রাথমিক ভাবে কী ভাবে তদন্ত চালান বুদ্ধদেববাবু? থানার পুলিশদের তিনি বুঝিয়ে দেন, ঘটনার গুরুত্ব লঘু করে দেখাতে হবে। থানার নিচুতলার পুলিশদের কেউ কেউ বলেছেন, তাঁর বলে দেওয়া কথাই যেন বলা হয়, সে কথাই পইপই করে বুঝিয়ে দেন ওসি। এমনকী, এক পুলিশ কর্মী কেন ফাইল দিয়ে মুখ আড়াল করতে টেবিলের তলায় লুকিয়েছিলেন, তার কী ব্যাখ্যা দিতে হবে তা-ও থানার প্রতিটি কর্মীকে বলে দেওয়া হয়েছিল। এক পুলিশকর্মীর অভিযোগ, “ক্যামেরায় যাতে মুখ দেখা না যায়, তার জন্যই ফাইল দিয়ে মুখ আড়াল করে টেবিলের নীচে যেতে হয়েছিল এমন কথাই বলতে বলা হয়েছিল আমাদের।” কিন্তু আদতে কী ঘটেছিল? ওই পুলিশকর্মী বলেন, “যে ভাবে হামলাকারীরা থানার কাচ ভাঙছিল, তাই নিজেকে বাঁচাতে ওই পুলিশকর্মী আশ্রয় নেন টেবিলের নীচে।” ঘটনার ন’ঘণ্টা পরে কেন পুলিশ অভিযোগ লেখে, সেই প্রশ্নও তুলেছেন নিচুতলার পুলিশ কর্মীরা। সূত্রের খবর, পুলিশের নিচুতলার এই ক্ষোভের আঁচ অন্য থানা এবং লালবাজারের গায়েও লেগেছে।
তবু লালবাজার তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছে বুদ্ধদেববাবুকেই। কেন? সেই জবাব খুঁজতে গিয়ে উঠে এসেছে আর এক তথ্য। দেখা যাচ্ছে, এ বছর জুনে চেতলা থানার অতিরিক্ত ওসি-র পদ থেকে সরাসরি আলিপুর থানার ওসি করা হয় বুদ্ধদেববাবুকে। অথচ আলিপুর থানার ওসি-র পদ ধারে ও ভারে শহরের অন্য বহু থানার থেকে অনেকটাই এগিয়ে। তাই দুই বা তার বেশি থানায় ওসি ছিলেন, এমন কোনও সিনিয়র ইন্সপেক্টরকেই এখানে ওসি করা হয়। পাঁচ বছরেরও বেশি কলকাতা পুলিশে কাজ করা এক আইপিএস বলেন, “২০১৪-র আগে আলিপুর থানার ওসি করা হয়েছে কোনও সিনিয়র ইন্সপেক্টরকে। বুদ্ধদেব কুণ্ডুর ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম হল।” পদটির গুরুত্ব বোঝা যায় একটি ঘটনাতেই। যাঁর জায়গায় বুদ্ধদেব এলেন, সেই নমরোজ খান এখান থেকে সহকারী কমিশনার পদমর্যাদায় গিয়েছেন।
বুদ্ধদেবের এমন পদোন্নতি কেন? লালবাজারের একটি সূত্র জানাচ্ছেন, কলকাতা পুলিশের ডিসি, ওসি কারা হবেন, তা তৃণমূলের তরফে নিয়ন্ত্রণ করেন ববি হাকিম এবং দলের অন্য এক সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতা। তবে ববির হাতেই বদলির মূল চাবি রয়েছে বলে অভিমত কলকাতা থেকে জেলায় বদলি হওয়া এক আইপিএস অফিসারের। ববি ঘনিষ্ঠ হওয়ার ফলেই চট করে এতটা গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়েছেন বুদ্ধদেব, বলছে পুলিশমহলের বড় অংশ। ঘনিষ্ঠতা এতটাই যে বুদ্ধবাবুর সহকর্মীদের অনেকেই মজা করে তাঁকে আড়ালে ‘পাজামা ওসি’ (মন্ত্রীর পাজামা ধরে চলা ওসি) বলে ডাকেন। আর ববি ঘনিষ্ঠ বলেই খোদ পুলিশ কমিশনারও তাঁকে সরাতে পারবেন কি না, উঠেছে সেই প্রশ্নও।
প্রশ্ন উঠেছে তদন্তের ভবিষ্যৎ নিয়েও। যে দিন ঘটনাটি ঘটে, সে দিনই প্রতাপকে থানায় ডেকে পাঠান। দু’জনের আলোচনার ভিত্তিতেই ওই মামলায় কার কার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হবে, তা ঠিক হয় বলেও জানাচ্ছে নিচুতলা। আদালতে পুলিশ যে কাগজ জমা দিয়েছিল, তাতে থানায় ভাঙচুরের কোনও অভিযোগ করা হয়নি। এ নিয়ে আদালত ভর্ৎসনাও করেছে আলিপুর থানার পুলিশকে। স্বাভাবিক ভাবেই এর পরে তদন্ত নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। এর আগে দু’দিন ধরে এই ঘটনাকে ‘সামান্য ঘটনা’ বলে আসা ববি হাকিম আনন্দবাজারের প্রশ্ন শুনে বিরক্ত। তিনি বলেন, “পুলিশের কাজ পুলিশ করবে। আমি এই ব্যাপারে কী বলব?” প্রতাপের জবাবও প্রায় একই: “পুলিশ পুলিশের কাজ করবে।” শুক্রবার থানায় গেলেন কেন? প্রতাপ বললেন, “ওসি ডেকেছিলেন। তাই গিয়েছি। আবার ডাকলে যাব।” আর খোদ ওসি বুদ্ধদেব কুণ্ডুর বক্তব্য, “আমি কার লোক, তা জানি না। তদন্তে যা পাওয়া যাবে, তাই হবে।”
আলিপুর-কাণ্ডে ববি ও প্রতাপের ঘনিষ্ঠ বুদ্ধর ভূমিকা নিয়ে লালবাজার কি ভাবছে? সুরজিৎ করপুরকায়স্থ কোনও মন্তব্য করতে চাননি। ফোন ধরেননি। যুগ্ম কমিশনার সদর রাজীব মিশ্র শুধু বলেছেন, “তদন্ত চলছে। আর কিছু বলা যাবে না।” তবে লালবাজার সূত্রের খবর, আজ, মঙ্গলবার ধৃত পাঁচ জনকে আদালতে তোলা হবে। সেখানেই বিচারকের কাছে মামলার কেস ডায়েরি তুলে দেওয়া হবে। সেখানে কী কী থাকবে, অভিযুক্তদের তালিকায় কোন কোন নাম যুক্ত হবে তা চূড়ান্ত করা হবে মঙ্গলবার সকালেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy