E-Paper

পাচারের গ্রাস থেকে মুক্তির উদ্‌যাপন বোনফোঁটার উৎসবে

বৃহস্পতিবার, ভাইফোঁটার বিকেলে বারুইপুরের মালঞ্চে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আয়োজন করেছিল বোনফোঁটার। অপরাধ-চক্রের গ্রাস থেকে কোনও মতে উদ্ধার পাওয়া কিশোরী-তরুণীদের অনেকেই ছিলেন সেই উৎসবে।

প্রবাল গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৪ অক্টোবর ২০২৫ ০৮:৪৪
পাচারকারীর খপ্পর থেকে পালিয়ে এসে পাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করা এক তরুণীকে বোনফোঁটা। বৃহস্পতিবার।

পাচারকারীর খপ্পর থেকে পালিয়ে এসে পাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করা এক তরুণীকে বোনফোঁটা। বৃহস্পতিবার। —নিজস্ব চিত্র।

কেউ কিশোরী, কেউ তরুণী। কাউকে ভিন্‌ রাজ্য থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। কেউ বা ভিন্‌ রাজ্যের যৌনপল্লি থেকে পালিয়ে এসেছেন। প্রতিবেশীদের টিপ্পনীর অসম্মান উপেক্ষা করে কেউ লড়ছেন সমাজের মূল স্রোতে ফিরতে, কারও লড়াই পাচারকারীর বিরুদ্ধে।

বৃহস্পতিবার, ভাইফোঁটার বিকেলে বারুইপুরের মালঞ্চে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আয়োজন করেছিল বোনফোঁটার। অপরাধ-চক্রের গ্রাস থেকে কোনও মতে উদ্ধার পাওয়া কিশোরী-তরুণীদের অনেকেই ছিলেন সেই উৎসবে। সংগঠনের পুরুষ সদস্যদের কপালে তাঁরা দইয়ের ফোঁটা দিলেন। আবার তাঁদের থেকে নিজেরাও ফোঁটা নিলেন। উদ্যোক্তাদের বক্তব্য, দুষ্কৃতীদের কবল থেকে বেরিয়ে আসা ওই মেয়েরা এখন সমাজের মূল স্রোতে ফিরতে এবং অন্যদের পাচারের বিপদ সম্পর্কে সচেতন ও শিক্ষিত করতে লড়াই করছেন। তাঁদের সেই লড়াইকে কুর্নিশ জানাতেই এ দিন বোনফোঁটার আয়োজন করা হয়েছিল বলে জানায় সংগঠনটি।

বোনফোঁটা উৎসবে হাসিমুখে যোগ দিলেও নিজেদের জীবনে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনার কথা জানাতে গিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেললেন এক তরুণী। বাসন্তীর বাসিন্দা ওই তরুণীর জীবনের অভিজ্ঞতা সিনেমার গল্পের মতো। ২০১২ সালে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে মুখে কাপড় চাপা দিয়ে তাঁকে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়েছিল পাচারকারীরা। তার পরে তাঁকে অচেতন করে দেড় লক্ষ টাকায় পুণের এক যৌনপল্লিতে বিক্রি করে দেওয়া হয়। কৈশোরে পাচার হয়ে যাওয়া সেই মেয়ে তরুণী হয়ে ওঠার সময়ে পুণে থেকে পালিয়ে চলে আসেন বাসন্তীতে। বর্তমানে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের তরফে গ্রামে গ্রামে পাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে দল গড়েছেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘এখনও রাতে দুঃস্বপ্নে সেই সব দিন ফিরে আসে। ঘুম ভেঙে যায়। পুণের যৌনপল্লিতে একটি বাড়ির পাঁচতলায় আমার মতো কত মেয়েকে আটকে থাকতে দেখেছিলাম সেই সময়ে। জোর করে তাদের দিয়ে যৌনকর্ম করানো হত। অত্যাচার করা হত। তবে, এক গ্রাহকই আমাকে সেখান থেকে পালাতে সাহায্য করেছিলেন। আমি পুরুষের পোশাক পরে ওদের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে আসি। মজার কথা হল, পাচারকারীরা ছিল আমাদেরই প্রতিবেশী।’’

বারুইপুরের সীতাকুণ্ড ও ক্যানিংয়ের বাসিন্দা দুই কিশোরীও অভাবে পড়ে গিয়েছিল পাচারকারীদের হাতে। সীতাকুণ্ডের বাসিন্দা, দশম শ্রেণির এক ছাত্রী জানাল, এক আত্মীয় তাকে বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার নাম করে স্কুটারে চাপিয়ে বাড়ি থেকে বার করে আনে। তার পরে একাধিক জায়গায় বার বার তাকে আচ্ছন্ন করে আটকে রেখে যৌন নির্যাতন করা হয়। কিশোরীর পরিবার পুলিশে খবর দেওয়ায় ক্যানিং স্টেশনের কাছ থেকে তাকে উদ্ধার করে পুলিশ।

ওই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন জানাচ্ছে, দক্ষিণ ২৪ পরগনার, বিশেষত সুন্দরবন এলাকার মানুষ এতটাই অর্থাভাবে থাকেন যে, কখনও বাড়তি আয়ের লোভে, কখনও বা সচেতনতার অভাবে পাচার-চক্রে জড়িয়ে পড়েন। এক কিশোরী শোনাল তার এক আত্মীয়ের কথা। কিশোরীর কথায়, ‘‘আমি প্রেমের ফাঁদে পড়ে অন্ধ্রপ্রদেশে পৌঁছে গিয়েছিলাম। আমার এক বৌদি তার এক ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দেয়। সে আমাকে ফোন করত। সমাজমাধ্যমেও যোগাযোগ ছিল। এক দিন সেই বৌদি আমাকে ফুসলিয়ে নিয়ে গেল ওই যুবকের কাছে। সে আমাকে ক্যানিং থেকে প্রথমে মেদিনীপুরের পাঁশকুড়ায় এবং পরে অন্ধ্রে নিয়ে যায়। আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে জানতে পারি, ছেলেটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। বৌদির যে কী উদ্দেশ্য ছিল, আমি আজও বুঝে উঠতে পারিনি।’’

এমনই নানা ধরনের পরিস্থিতির শিকার হওয়া, সমাজের বিভিন্ন স্তরের অন্তত ৩০ জন মেয়ে এ দিন বোনফোঁটায় অংশনেন। তাঁদের কেউ কেউ বাল্যবিবাহের, কেউ বা নাবালিকা অবস্থায় যৌন নির্যাতনের শিকার। সংগঠনের পরামর্শদাতা সম্রাট মৌলিক বললেন, ‘‘যে কোনও উৎসব মানুষকে মেলামেশার ক্ষেত্র তৈরি করে দেয়। আমরা বোনফোঁটার আয়োজন করেছি, যাতে এই মেয়েরা নিজেদের অসহায় না ভাবেন। তাঁরা যাতে এটা উপলব্ধি করতে পারেন যে, সব সময়ে ভাইয়েরা তাঁদের রক্ষা করবেন না, প্রয়োজনে ভাইকেও তাঁদের বিপদের সময়ে আগলে রাখতে হবে। এটুকু আত্মবিশ্বাস ছড়িয়ে দিতেই এই আয়োজন।’’

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bhai Phota 2025 Baruipur Bonphota

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy