Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

নতুন ভারতের হাত ধরে উঠে দাঁড়ায় ‘দেশদ্রোহী’

নিজস্ব লড়াই। যে লড়াইয়ে ক্রমশ মিশে যায় অসংখ্য মুখ। আর এখান থেকেই শুরু হয় স্টিভেন স্পিলবার্গের ‘দ্য টার্মিনাল’ ছবিটি।

সরব: পোস্টার হাতে নাগরিক মিছিলে। ছবি: দীক্ষা ভুঁইয়া

সরব: পোস্টার হাতে নাগরিক মিছিলে। ছবি: দীক্ষা ভুঁইয়া

দেবাশিস ঘড়াই
শেষ আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০১৯ ০১:৫৫
Share: Save:

দেশে গৃহযুদ্ধ চলছে। সরকারকে উৎখাত করে বিদ্রোহীরা ক্ষমতায় এসেছে। জনমতের বিরুদ্ধে। রাস্তায় রাস্তায় সেনাবাহিনী, গোলাগুলির আওয়াজ। নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পরে পুরনো সরকারের স্বীকৃত সব নথি বাতিল হয়ে গিয়েছে। এমনকি, নাগরিকত্বের প্রমাণস্বরূপ বৈধ পাসপোর্টটুকুও। ফলে বিদেশ-বিভুঁইয়ে আসা লোকটি পড়ল খুব বিপদে। আমেরিকার মূল ভূখণ্ডে ঢোকার তার কোনও অধিকার নেই। নতুন সরকার বিশ্বে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না পাওয়া পর্যন্ত নিজের দেশে ফেরারও তার কোনও পথ নেই। কারণ, সে তো কোনও দেশেরই নাগরিক নয়। অতঃপর এয়ারপোর্টের টার্মিনালের গণ্ডিটুকুর ভিতরেই শুরু হয় তার জীবনের লড়াই।

নিজস্ব লড়াই। যে লড়াইয়ে ক্রমশ মিশে যায় অসংখ্য মুখ। আর এখান থেকেই শুরু হয় স্টিভেন স্পিলবার্গের ‘দ্য টার্মিনাল’ ছবিটি।

ছবির একটি অংশ মনে পড়ছে ইদানীং। যেখানে এয়ারপোর্টের এক উচ্চ পদস্থ অফিসার টার্মিনালে আটকে থাকা দেশ-ভূখণ্ডহীন ‘আনঅ্যাকসেপ্টেবল’ লোকটিকে দিয়ে বলিয়ে নিতে চাইছে, সে নিজের দেশের থেকে ভয় পাচ্ছে। তা হলে এয়ারপোর্ট থেকে অন্যত্র পাঠানো যাবে তাকে। আর এক বার পাঠানো গেলে দেশহীন লোকটির দায় এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষের থাকবে না। তাই বারবার নানা ভাবে লোকটিকে বলিয়ে নিতে চায় অফিসারটি, ‘‘বলো, বলো তোমার দেশের থেকে তুমি ভয় পাও। এক বার বলো। তা হলেই তোমাকে আমি নিউ ইয়র্কে পাঠিয়ে দিতে পারি!’’ অফিসারটি ভেবেছিল, ইংরেজি ভাষায় সাবলীল না হওয়া লোকটি সহজেই সে কথা বলে দেবে। কিন্তু ইংরেজিতে স্বচ্ছন্দ না হওয়া লোকটি, কয়েক দিন ধরে এয়ারপোর্টের টার্মিনালেই আটকে থাকা লোকটি, নিজের দেশে ফিরতে না পারা লোকটি সেটা বলেনি! উল্টে বলেছিল, ‘‘ওখানে আমার বাড়ি রয়েছে। ওটা আমার দেশ। আমি কী করে নিজের বাড়ি, নিজের দেশ থেকে ভয় পেতে পারি?’’

ধর্মকে সামনে রেখে ‘দেশবিরোধী’ ও ‘দেশপ্রেমিকের’ যে তরজা চলছে সারা দেশ জুড়ে, তাতে এই দৃশ্যটা ঘুরে ফিরে মনে পড়ছে। এক দল চাইছে অন্য দলকে দেশবিরোধী তকমা দিতে।

ওদের ধর্ম আলাদা, তাই ওরা দেশের কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক। আর এক দল চাইছে, দেশপ্রেমিকদের বরণ করে নিতে। ইতিহাস বরাবরই সরলরৈখিক— বরণ এবং বর্জনের। তাই এই দুইয়ের তুমুল লড়াই শুরু হয়েছে দেশ জুড়ে। এটাও এক ধরনের গৃহযুদ্ধ যেন। আর এই গৃহযুদ্ধের মধ্যে পড়ে আমাদের মতো নিতান্ত তুচ্ছ যারা, তাদের অবস্থা হয়েছে ওই টার্মিনালে আটকে থাকা লোকটির মতো। কারণ, যাঁরা ‘ওপিনিয়ন মেকার’, তাঁরা চাইছেন দেশপ্রেমিক বা দেশদ্রোহী কোনও একটি গোত্রে দ্রুত ফেলে দিতে আমাদের। ‘আইদার ইউ আর উইথ আস অর এগেনস্ট আস’। অর্থাৎ, হয় তুমি আমাদের পক্ষে, নয় তো বিরোধী পক্ষে। আর এটা এক বার করতে পারলে দু’দলেরই মাথারা জানেন, তাঁরা চিন্তামুক্ত। এবং তাঁদের কাজের সুবিধা হয় বইকি! কারণ, তকমাহীন আপদদের নিয়ে ঠিক কী যে করতে হয়, তা জানেন না দু’দলের মাথারাই। যেমন ভাবে টার্মিনালের ওই উচ্চ পদস্থ অফিসারের জানা ছিল না, নিয়ম না ভাঙা পর্যন্ত একটি লোককে কী করে পুলিশের হাতে তুলে দিতে হয়!

জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রেই এই কৌশলটা চলে। আমরা সাধারণত্বের দিক দিয়ে অগণন, বিশেষত্ব কিছু নেই। কিন্তু স্বাভাবিক বোধেই আমরা বুঝতে পারি, আমাদেরকে ক্রমাগত হাঁটতে হচ্ছে দেশবিরোধী ও দেশপ্রেমিকের মধ্যের সরু ফিতেটার উপর দিয়ে। যাঁরা এই গৃহযুদ্ধটি শুরু করেছেন, তাঁদের প্রত্যেকেই চাইছেন, আমাদের পা পিছলে যাক। আর আমরা যে কোনও এক দিকে পড়ে যাই। যাতে হয় দেশপ্রেমিকের গৌরবে আমাদের বরণ করে নেওয়া যায়, নয়তো দেশবিরোধীর ঘৃণায় বর্জন করা যায়। কিন্তু কী করে জানি, অতি সাধারণত্বে বিশ্বাসী আমরাও ঠিক ওইটুকু সুতোর উপর দিয়েই হেঁটে চলেছি। বরাবরই। অন্য দেশ অনেক কিছুতে এগিয়ে থাকলে, অনেক কিছু পারলেও আমার দেশ কেন কিছু পারে না, এই বলে যেমন তুমুল বিক্ষোভ দেখিয়েছি, তেমনই জনগণমন শুনে একসঙ্গে উঠে দাঁড়িয়েছি— দেশদ্রোহিতা বা দেশপ্রেম নামক শব্দগুলো না বুঝেই। অনেকে আমাদের দিয়ে বলানোর চেষ্টা করছেন ক্রমাগত— ‘‘বলো দেশের থেকে তুমি ভয় পাচ্ছ। বলো।’’ কিন্তু আমরা, টার্মিনালে আটকে থাকা লোকটির মতোই ঠান্ডা স্বরে তাঁদের পাল্টা বলছি, ‘‘এই দেশে আমি থাকি। এই দেশে আমার বাড়ি রয়েছে। কেন ভয় পাব?’’

আর তাই এক দিকে যেমন দেশ জুড়ে হাত ধরাধরি করে মিছিলে হাঁটে বিভিন্ন ধর্মের অগণিত মানুষ, তেমনই কোনও এক এঁদো গলির ঘরে হয়তো মনে মনে গুমরোতে থাকে কেউ। এই দেশ তাকে কিচ্ছু দেয়নি। কারণ, তার কাছে শাসক মানেই দেশ। দেশ মানেই শাসক। বরাবরই। কোনও শাসকই তাকে মুক্তি দেয়নি। তাই এ দেশও তাকে কিছু দেয়নি। ‘জাহান্নমে যাক এই দেশ।’ ঘরে ফিরে দেশকে গালাগালি করতে করতে গুম হয়ে বসে থাকে সে।

হঠাৎ করে তার সাত বছরের মেয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। বলে, ‘বাবা, বাবা, জনগণমন অধিনায়ক হচ্ছে। তুমি বসে আছ? আমাদের স্কুলের ম্যাম বলেছে, জনগণ হলে উঠে দাঁড়াতে হয়।’

তার পরে—

সাত বছরের নতুন ভারতের হাত ধরে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায় ‘দেশদ্রোহী’!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Steven Spielberg The Terminal CAA NRC
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE