হাতে-হাতে: চলছে হেঁশেলের কাজ। ছবি: সুমন বল্লভ
বস্তির চিলতে ঘরে এ যেন আকাশ ছোঁয়ার স্পর্ধা! মাধ্যমিকে অঙ্ক-ভূগোলে ‘ব্যাক’, চেতলার রিকশাচালক বাপের মেয়ে হাসনাবানু খাতুন বুঝেছে, নিজের রেস্তোরাঁ খোলার স্বপ্নটা অসম্ভব নয় মোটেই।
টালিগঞ্জের খড়গোলায় রঙের মিস্ত্রি ও ঠিকে পরিচারিকার পুত্র সুজয় গায়েনও প্রত্যয়ী, জনা দু’তিন কর্মচারীকে নিয়ে ছোটখাটো চেষ্টায় ঝাঁপানোই যায় এখন। কোথা থেকে ঋণ মিলবে চলছে তার ফন্দিফিকির। চেনা মুখরোচকের সঙ্গে ‘ফ্রেঞ্চ’ খানাও থাকবে মেনুতে। পেঁয়াজ-লঙ্কায় ভাজা গোলা রুটি লোকে খেতে পারলে, থকথকে মিষ্টি সসে মাখন-ময়দার ‘ক্রেপ’ রুটি মুখে রুচবে না কেন?
চেতলার গোবিন্দ আঢ্য লেনের চিলতে এক কাফে থেকেই ছড়িয়ে পড়ছে এ সব স্বপ্ন। কাফে তো নয়, ইস্কুল। ফ্রান্স থেকে আসা স্বেচ্ছাসেবী অড্রি, ক্লোয়ি-রাই এখন হাসনা, সুজয়, ঝুমা, মধুমিতা, পায়েল, সাগরদের বন্ধু। কলকাতা বা শহরতলির স্কুলছুট, গরিবঘরের ছেলেমেয়েদের তারাই দেখিয়েছে, ইন্টারনেট ঘেঁটে কী ভাবে সহজসাধ্য কেক-টার্ট-কুকি-স্যান্ডউইচ-কিশ রাঁধতে হবে। ‘‘সব ওরা নিজেরা শিখেছে! আমরা শুধু সঙ্গে থাকি। গপাগপ চাখবার জন্যই আছি।’’ আভেন-গরম অ্যাপ্ল পাই ভেঙে মুখে পুরে মিষ্টি হাসে ক্লোয়ি।
ফরাসি স্বেচ্ছাসেবীদের সঙ্গে জুটেছে কলকাতার ‘কোচে’রাও। অল্পশিক্ষিত ছেলেমেয়েগুলোকে ব্যবসার খুঁটিনাটি শেখানোর ইস্কুল এখন জমজমাট। ফ্রান্স ও কলকাতার স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার গাঁটছড়াই পাল্টে দিয়েছে নিচুতলার গরিবগুর্বো ছেলেমেয়েদের জীবনদর্শন। ইংরেজি-সহ মাধ্যমিকে তিনটি বিষয়ে ‘ব্যাক’ পাওয়া ডায়মন্ড হারবার লাইনের সিরাখোলের ঝুমা মণ্ডল এখন অন্য মানুষ। একটু থেমেথেমে ইংরেজিতেই বলে, ‘‘নতুন রান্না থেকে মেলামেশার আদবকায়দা, কম্পিউটার— সব কিছুই এখন সড়গড় আমার।’’
পিছিয়ে থাকা ঘরের এই তরুণ-বাহিনীকে নিয়ে চেতলার ‘টোটো কাফে’ এখন একটি স্বপ্নের নাম। উদ্যোগটির নেপথ্যের অন্যতম স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্তা স্বরূপ ঘোষ হাসেন, ‘‘শহরের বস্তি-ফুটপাথের বাচ্চাদের নিয়ে কাজ করতে করতেই ফরাসি সংস্থার ক্ষমতায়ন প্রকল্পের সঙ্গে আমাদের পরিচয়।’’ জনা চল্লিশেক তরুণ এক বছর ধরে কাজ শিখছে। বছরখানেক আগে শুরু হওয়া তালিমকেন্দ্রটি এখন নিয়মিত কাফের চেহারায়। বুধ থেকে শনি, বেলা ১২টা থেকে ৩টে পর্যন্ত রয়েছে কলকাতার তরুণ শেফদের রান্না স্টার্টার থেকে ডেজার্ট চাখার সুবন্দোবস্ত।
শহরের অনাথ যুবক রামা রাও, গোবিন্দ দাসেরা ইতিমধ্যেই এ তল্লাটে কাজ শিখে একটি ইলেকট্রিক সরঞ্জাম তৈরির কারখানায় সুপারভাইজারের ভূমিকায়। তরুণ-বাহিনীর পাশে দাঁড়াতে এগিয়ে এসেছে কলকাতার ফরাসি সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দ্যু বেঙ্গালও। ঠিক হয়েছে, আগামী ২৪ মার্চ থেকে সপ্তাহান্তে ঝুমা, অর্পিতা, সুজয়রাই থাকবে আলিয়ঁসের ক্যান্টিনের দায়িত্বে। গরিবগুর্বোদের ‘এমবিএ স্কুল’এর তকমাধারী চেতলার ওই কাফেতেই চলছে আগামীর শিল্পোদ্যোগীদের স্বপ্ন দেখার মহড়া।
আর একটা স্বপ্নও অবশ্য জ্বালায় ঝুমাকে। বাড়িতে আভেন ছাড়া কেক, কিশ করা খুব কষ্টের। তলাটা কেমন জ্বলে গিয়ে ধরে-ধরে যায়! গ্রামে বাবাকে এখনও খাওয়ানো হয়নি এ সব কিছুমিছু। তবে তরুণ-বাহিনী আত্মবিশ্বাসী, চাকরির জন্য দোরে দোরে টো-টো কোম্পানি থেকে হয়তো নিষ্কৃতি মিলবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy