উদ্যোগ: স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায় ও অভিষেক দত্তের সঙ্গে কারাকর্মী ও বন্দি আবাসিকেরা। নিজস্ব চিত্র
লাল রঙের গাউনে সরু সুতোর কারুকাজ। র্যাম্পের ‘স্পট লাইট’ পাওলি দামের গায়ের ওই গাউনের উপরে পড়তেই হাততালির ঢেউ। ওই দৃশ্যের রেশ কাটতে না কাটতেই র্যাম্পে উঠে পড়েছেন স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়। অফ-হোয়াইটের ড্রেসের উপরে এক রঙের সুতোর কাজে তখন ঝলমলিয়ে উঠেছে ফ্যাশন র্যাম্পে।
এখানেই শেষ নয়, একে একে আসছেন সোহম, মনোজ তিওয়ারি, নাইজেল আকারা, অলকানন্দা রায়, শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়রা।
এর মধ্যে নতুনত্ব কিছু নেই। সেলুলয়েড জগতে এমন ঘটনা হামেশাই ঘটে। কিন্তু কারাগারের অন্তরালে থাকা জনা বন্দিদের চোখ তখন বিস্ফারিত। এমন কাণ্ড কোনও দিন ঘটতে পারে, তাঁরা যে স্বপ্নেও ভাবেননি। ভাববেনই বা কী করে? এমন ঘটনা শুধু এ রাজ্যে নয়, এ দেশেই প্রথম।
সেলুলয়েডের ফ্ল্যাশ বাল্বের ঝলকানি কারাগারের অন্তরালে পৌঁছে গিয়েছে আগেই। এ বার কারাগারের অন্তরালের সৃষ্টি ঝলসে উঠবে সেলুলয়েডের তারকাদের গায়ে। তা-ও আবার এক্কেবারে মুক্তাঙ্গনে, নবনির্মিত ‘উত্তীর্ণ’-এ।
তা নিয়ে উদ্বেগের শেষ নেই বরুণ, সাহাবুদ্দিন শেখ, নাজিমুলদের। কেউ খুনের আসামি, কেউ বা ডাকাতির। এঁদের হাতেই এখন ফুটে উঠছে তাবড় টলিউড নায়ক-নায়িকার পোশাকের খুঁটিনাটি।
আলিপুরের প্রেসিডেন্সি সেন্ট্রাল জেল আর আলিপুর মহিলা জেলের মধ্যেই সরকারের নবনির্মিত মুক্তাঙ্গন ‘উত্তীর্ণ’। সেখানেই শনিবার বন্দিদের তৈরি পোশাক পরে র্যাম্পে হাঁটবেন পাওলি, স্বস্তিকারা।
রাজ্যের কারা দফতর সূত্রের খবর, ফ্যাশন-ডিজাইনার অভিষেক দত্তের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে গত তিন মাস ধরে একটু একটু করে নিজেরা কাজ শিখেছেন জনা চল্লিশেক বন্দি। এঁদের কেউ যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত। কারও মামলা আদালতে বিচারাধীন। কেউ বধূ হত্যার মামলায় দোষী, তো কেউ আবার ডাকাতি-রাজহানির মামলায় দোষী সাব্যস্ত।
ফ্যাশন ডিজাইনার অভিষেক দত্ত বলেন, ‘‘এঁরা প্রথম প্রথম একটু সংশয়ে ছিলেন। কিন্তু এক মাস হাতে-কলমে কাজ শেখার পর থেকেই ওঁদের উৎসাহ বেড়ে যায়। গত তিন মাস ধরে প্রশিক্ষণ নিয়ে সমানে কাজ করে চলেছেন সকলে।’’ অভিষেক জানিয়েছেন, এখন এক-এক জন এমনই পারদর্শী হয়ে উঠেছেন যে, এঁদের অনেকেই পেশাদারদের মতো পোশাক তৈরি করতে পারেন। শুধু পোশাক নয়, এখন ওঁরা তৈরি করতে পারেন চামড়ার পোশাকি ‘জুতি’ও।
অভিষেক আরও জানালেন, বন্দিদের তৈরি পোশাকের এই অভিনব ফ্যাশন শো-এ চমক থাকছে বালুচরির নতুন আঙ্গিক। তিনি বলেন, ‘‘এত দিন বালুচরি শাড়ি কিংবা সালোয়ার-কামিজের কথা লোকজন শুনেছেন। এ বার পাশ্চাত্য পোশাকও ঝলমল করবে বালুচরির কাজে।’’ আর এই পোশাকও তৈরি করেছেন প্রেসিডেন্সি জেলের বন্দিরাই। তা তৈরি হয়েছে প্রেসিডেন্সি জেলের অন্দরেই।
এমন অভিনব ফ্যাশন শো নিয়ে উচ্ছ্বসিত ‘মুক্তধারা’র পরিচালক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। তাঁর মতে, ‘‘আমার মনে হয়, অভিষেক আবাসিকদের নিয়ে যে কাজটা করছেন, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যাঁরা সাংস্কৃতিক থেরাপি নিয়ে জেলের মধ্যে কাজ করি, তাঁরা বন্দিদের নতুন করে বাঁচার প্রেরণা জোগাই। সেটা এক জিনিস। কিন্তু এই সাংস্কৃতিক থেরাপির মধ্যেই দিয়েই যদি ওঁদের ভবিষ্যতের উপার্জনের পথও তৈরি হয়, তবে সেটা আরও গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হবে। আর সেই কাজে অভিষেকের মতো ব্যক্তিত্বেরা সামনে দাঁড়ালে তা সত্যিই একটা উদাহরণ তৈরি করবে।’’
কারা দফতরের কর্তারা জানাচ্ছেন, ফ্যাশন শো হয়েই থেমে থাকবে না এই কাজ। আজ, শনিবারের ফ্যাশন শো-এর শেষে জনা
বারো বন্দি পরিচিত হবেন দর্শকদের সঙ্গে। আর তাঁদের পোশাক এ বার থেকে রাখা থাকবে পার্ক স্ট্রিটের ঝাঁ চকচকে দোকানেও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy