Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Soumitra Chatterjee

ব-এ বড়দিন, স-এ সান্টা

এই বড়দিনে কলকাতার রসিকতা, করোনাকালে রক্তের জোরে কমতি নিয়ে সান্টাবুড়ো মনে হয় না নিজে আসবেন এ বছর! বদলে নির্ঘাত পাঠাবেন তাঁরই মতো লাল টুপি পরিহিত কোনও তরুণী নাতনিকে।

শেষ আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০২০ ০৩:৩০
Share: Save:

সে কোনও এক আনন্দময় বড়দিন বা শীতের গল্প। আনন্দ, বটেই! কারণ অন্তত মনের মধ্যে গুচ্ছের চোরা আশঙ্কার ছুরির ফলা তখন কথায় কথায় ঝিকমিকিয়ে উঠছিল না। পার্ক স্ট্রিটে কোনও এক মিলন অনুষ্ঠানে জনৈক রাজনীতির নেতা বা নেত্রীকে আবেগের আতিশয্যে ‘সান্টাক্লজ়’ বলে ফেলেন কোনও বিশিষ্ট অনুগামী। এই সম্বোধনে খুশি তো হনইনি, বেশ রেগে কড়া বকুনি দিয়েছিলেন নেতাপ্রবর। ‘সব পেয়েছির দেশ’ সান্টাক্ল‌জ় হয়ে ওঠার ঝুঁকি নেওয়াটা মোটেও পছন্দ ছিল না অভিজ্ঞ রাজনীতি-কারবারির।

এই বড়দিনে কলকাতার রসিকতা, করোনাকালে রক্তের জোরে কমতি নিয়ে সান্টাবুড়ো মনে হয় না নিজে আসবেন এ বছর! বদলে নির্ঘাত পাঠাবেন তাঁরই মতো লাল টুপি পরিহিত কোনও তরুণী নাতনিকে। অতিমারির বিষাক্ত বছর ২০২০-র শেষ অঙ্কে এটুকুই নাকি সান্ত্বনার প্রলেপ! নিউ মার্কেট তল্লাটে ছড়িয়ে থাকা খিদিরপুর বা পার্ক সার্কাস বস্তির জ্যান্ত ‘সান্টাক্লজ়’দের তা বলে ঘরে বসার ফুরসত নেই। শহরের সাহেব-পাড়ার সোনালি আমেজ ফিরুক না ফিরুক, ঠিক সময়মতো তুলোর গোঁফদাড়ি সামলে হাজিরা দিতে হবে।

এ বার পার্ক স্ট্রিটের বড়দিনের মেলা গরহাজির। উৎসব অনুষ্ঠান, নমো-নমো করে এক সন্ধ্যায় কাবার। অতিমারি-আতঙ্কে বচ্ছরকার ফেরা নেই শহরের কত পুরনো পাখির! ক্রিসমাস ইভের গির্জাও অন্য বারের মতো নয় অবারিতদ্বার। বুক বাজিয়ে চেনা আন্তরিকতায় সবাইকে স্বাগত জানাতে খানিক পিছু হঠা মেজাজ। তবু এ বারও কবেকার খুঁতখুঁতে খরিদ্দারের ফরমায়েশ মেটাতে ব্যস্ত পার্কসার্কাস বাজারের সোনকর ভাইরা। মোক্ষম মশলা জড়ো করে বিশেষ সসেজ কারির উপাদান সাজিয়ে তুলতে এ শীতেও গলদঘর্ম তাঁরা। পিকনিক গার্ডেনের অ্যাংলো পাড়ায় ফরমায়েশি রোস্টের আশায় খেজুরে আলাপ। খিদিরপুরের জার্মান বেকারির আভেন-তপ্ত ফসলের টানে এখনও ধৈর্য ধরে বৈকালিক মাস্ক-ঢাকা মুখের লাইন। বো স্ট্রিটের বড়ুয়া বা ওয়েলেসলিতে সালদানহাদের স্যাঁতসেঁতে বেকারির হাঁ-মুখ আভেনেরও এটাই ‘রাবণের চিতা’ হয়ে ওঠার লগ্ন।

কে বলে, শীত শুধু পাতা ঝরায়! ঘর সাজানোর কাগজের শিকলি, ক্রিসমাস ট্রি-র খুদে আলোর উপহার সাজিয়ে যেন শীতেই জেগে ওঠেন নিউ মার্কেটের ইয়াকুব মল্লিক। রিপন স্ট্রিটের একলা গৃহকোণে যা গত জন্মের ডাক শোনায়। বয়ামের তরলে জমানো কমলা, কিশমিশের ঘ্রাণে সময় পিছু হটে আমহার্স্ট স্ট্রিট বা বালিগঞ্জেও। ফুটপাতের খড়ি-ওঠা মাস্কহীন গালে সামান্য এক খণ্ড কেকই পারে ফুটিয়ে তুলতে অমল হাসি! বেকারি কারখানার হিসেবের ব্যালান্স শিটে তার মূল্য জরিপ করা কঠিন। বড়দিনের প্রাপ্তির ঝুলি উপচে ওঠা নানা সম্ভার সান্টাক্লজ় ছাড়া আর কারই বা উপহার হতে পারে! গির্জায় ক্যারলের সুরে মিশে যায় জিশুর কীর্তন। সাতরঙা বাঙালিয়ানাকে আবিষ্কারের ঘ্রাণেই বড়দিনের সুরভি। ছবিতে ২০১৭ সালের কলকাতায়, পার্ক স্ট্রিটে বড়দিনের সন্ধেয় সান্টা-রূপী বাইক-আরোহী।

অনন্য যাপন

তিনি কৃষ্ণনাগরিক, নিজের কৃষ্ণনাগরিকত্ব বজায় রেখেই সর্বজনশ্রদ্ধেয়। স্থানিকতার ইতিহাস, লোকায়ত জীবন, গৌণধর্ম যেমন তাঁর আগ্রহের বিষয়, তেমনই রবীন্দ্রনাথ তাঁর চর্চা ও চর্যার অবলম্বন। সংস্কৃতির নানা স্তরে তাঁর গতায়াত, লিখন ও বাক্‌ দুই সংস্কৃতিতে সমান সঞ্চরণ। বিদ্যায়তনিক গবেষণায় যেমন তাঁর অবাধ গতি, তেমনই তাঁর রচনার বৈঠকখানায় সাধারণ পাঠক সমাজের আনাগোনা। নিত্যযাত্রার বিবরণ, মেলার অভিজ্ঞতা, পরীক্ষার খাতার আশ্চর্য ভুলভ্রান্তিও হয়ে উঠেছিল তাঁর কোনও কোনও রচনার বিষয়। গান গাইতে গাইতে যখন গান নিয়ে কথা বলতেন তখন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ বক্তৃতাসভায় শ্রোতা-সমাবেশ চোখে পড়ার মতো। তিনি বর্জনের অহমিকায় ঋজু নন, হাস্যোজ্জ্বল স্বাতন্ত্র্যে সমাদরণীয়। সুধীর চক্রবর্তীর (১৯৩৪-২০২০) (ছবিতে) চলে যাওয়া বাঙালির বিশেষ এক যাপনধারাকে রিক্ত করে দিল। সে ধারায় ভদ্রলোক বাঙালি তাঁর ধুতি পাঞ্জাবি-সহ বসে পড়তে পারতেন মেলার ধুলোয়। অধীত জ্ঞানকে তরল না করেও বঙ্গসংস্কৃতির যাত্রীরা যে সুসামাজিকতার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন, তিনি ছিলেন সেই মহাযানপন্থার অন্যতম সাধক।

জীবনের কবি

বড়দিনের আনন্দ-উৎসবের মধ্যেই দু’বছর আগে চলে গিয়েছিলেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী (১৯২৪-২০১৮)। তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে হৃদয়পুরের ‘দ্য গৌরী কালচার অ্যান্ড এডুকেশনাল অ্যাসোসিয়েশন’ আয়োজন করেছিল এক ঘরোয়া অনুষ্ঠান, কবিপুত্র ও পুত্রবধূর উপস্থিতিতে হয়েছিল নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী স্মারক বক্তৃতাও। অন্তরের বিনম্র তাগিদে কবির প্রতি এই শ্রদ্ধাজ্ঞাপন অনুষ্ঠান হবে প্রতি বছর, জানিয়েছিলেন প্রধান উদ্যোক্তা দীপঙ্কর মল্লিক। অতিমারির কারণে সম্বৎসরের আয়োজন এ বার আন্তর্জালিক, অ্যাসোসিয়েশনের ফেসবুক পেজে, ২৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৭টায়। এ বারের বক্তা কবি ও অধ্যাপক জহর সেন মজুমদার। “তা হলে নূতন করে জীবনের জয়ধ্বনি দাও,/ যা মারে মৃত্যুকে, সেই উদ্বোধনী সংগীত শোনাও।”— লিখেছিলেন যে কবি, প্রয়াণদিনে তাঁর জীবন ও কবিতাবোধের উদ্‌যাপন।

জনগল্প ’৭১

সাধারণ মানুষের মৌখিক বিবরণও ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব অভিজ্ঞতাসঞ্জাত কিছু বক্তব্য থাকে, সত্যমূল্যের নিরিখে সেগুলি যাচাই করে নির্মিত হয় জন-ইতিহাস, যার মূল্য অপরিসীম। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল প্রকৃত অর্থেই জনযুদ্ধ। দীর্ঘ নয় মাসের সেই সংগ্রাম এনে দিয়েছিল বাঙালির বহুকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতা অর্জনের মানবিক ইতিকথাকে একত্র করে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য গুছিয়ে রাখার কাজে জনগল্প ’৭১ নামে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছেন বাংলাদেশের লেখক ও প্রকাশক নিশাত জাহান রানা। সংগ্রহ করেছেন বহু মানুষের মৌখিক বয়ান, এরই মধ্যে যা দুই খণ্ডে গ্রন্থাকারে মুদ্রিত হয়েছে জনগল্প ’৭১ (প্রকাশক: ‘যুক্ত’) নামেই। বিজয় দিবসের মাসে ‘যুক্ত’-র উদ্যোগে ১০-১৬ ডিসেম্বর হয়ে গেল সপ্তাহব্যাপী আন্তর্জাল-আলোচনা, ছিলেন দুই বাংলার বিশিষ্টজন। মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের বাইরে— ব্রিটেনে, তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে— ছিলেন, এমন কয়েকজনের কথাও শোনা গেল। আকাশবাণী কলকাতা-র প্রাক্তন কর্মী ভবেশ দাসের কথায় ফুটে উঠল মুক্তিযুদ্ধের সময়কার কলকাতার ছবি।

বিজ্ঞান-যাত্রায়

১৯৮৬ সালে ভারত সরকারের ডিপার্টমেন্ট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনলজি-র পৃষ্ঠপোষকতায় সল্টলেকে গড়ে ওঠে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নামাঙ্কিত জাতীয় গবেষণাকেন্দ্র এস এন বোস ন্যাশনাল সেন্টার ফর বেসিক সায়েন্সেস। প্রকৃতিবিজ্ঞান চর্চায় এটি দেশের অন্যতম প্রধান গবেষণা কেন্দ্র। অন্য দিকে, ২০০৬ সালে ভারত সরকারের মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স, এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ (আইসার), কলকাতা, ২০১২ সালে যে প্রতিষ্ঠান পেয়েছে ‘ইনস্টিটিউট অব ন্যাশনাল ইম্পর্ট্যান্স’-এর মর্যাদাও। কলকাতার এই দুই গবেষণাকেন্দ্রের মধ্যে ‘মেমোরান্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং’ (মউ) স্বাক্ষরিত হল গত ১৬ ডিসেম্বর, এস এন বোস ন্যাশনাল সেন্টার ক্যাম্পাসে। চুক্তি স্বাক্ষর করলেন দুই ইনস্টিটিউটের প্রধান। এর ফলে পিএইচ ডি স্তরের গবেষকেরা দুই গবেষণাকেন্দ্রেই কাজ করবেন, গবেষণা সংক্রান্ত সমস্ত সুযোগ-সুবিধাও পাবেন। ২০২১ থেকে শুরু হবে যৌথ পিএইচ ডি প্রোগ্রাম।

বিচিত্র সৌমিত্র

সুকুমার রায়ের হাত ধরে শুরু হয়েছিল ‘খেরোর খাতা’-র চল। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ও ধর্মতলার এক বিশেষ দোকান থেকে কিনতেন এমন খাতা। সে খাতাই যেন ফিরে এল, প্রচ্ছদে ও সামগ্রিক সৌষ্ঠবে। সৌজন্যে, বিচিত্রপত্র-র ‘সৌমিত্র স্মরণ সংখ্যা’ (সম্পা: সৌরদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌম্যকান্তি দত্ত)। পত্রিকার উপদেষ্টা সন্দীপ রায় লিখেছেন জলসাঘর ছবির শুটিং-এর কথা, “এক দিন শুটিং-এ সৌমিত্রকাকু আসেন, বাবা ওঁকে নিয়ে গিয়ে ছবি বিশ্বাসের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেন আর বলেন— ‘ছবিদা, এই যে আমার অপুর সংসার ছবির অপু।’ ” ছ’টি বিভাগে বিন্যস্ত সংখ্যাটির নজরকাড়া লেখক তালিকায় রয়েছেন বিশিষ্ট কবি, গায়ক, অভিনেতা, প্রাবন্ধিক-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের কৃতীরা। কয়েকটি লেখা সাক্ষাৎকার-ভিত্তিক। বিশেষ প্রাপ্তি, কন্যা পৌলমী বসুকে লেখা কবিতা, চিঠি, সৌমিত্রের এ যাবৎ না-দেখা চিত্রকৃতি। সত্যজিৎ রায়ের করা সৌমিত্রবাবুর পাঁচটি বইয়ের প্রচ্ছদ, সত্যজিতের তোলা নাট্যমঞ্চের সৌমিত্রের (বিদেহী নাটকে) আলোকচিত্রগুলিও বিশেষ আকর্ষণ। পাশাপাশি, ‘দুর্লভ লেখা’ শিরোনামে সৌমিত্র প্রসঙ্গে সত্যজিৎ রায়, বিজয়া রায়, মান্না দে, রবি ঘোষ, মৃণাল সেন-সহ আট জনের লেখার পুনর্মুদ্রণ করা হয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা শেষ কবিতাটিও— গন্ডারের উদ্বেগ।

স্মরণে, মননে

জীবন ও জগৎকে অতিমারি আচ্ছন্ন করার আগেই, এ বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি চলে গিয়েছেন তিনি— অধ্যাপিকা, সুলেখিকা, সাংসদ কৃষ্ণা বসু (১৯৩০-২০২০)। ২৬ ডিসেম্বর তাঁর ৯০তম জন্মদিনে ‘প্রথম কৃষ্ণা বসু বক্তৃতা’ দেবেন কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির ইংরেজি ও তুলনামূলক সাহিত্যের প্রফেসর গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক। ১৯৫০-এর দশকে দু’জনেই ইংরেজি সাহিত্যের পাঠ নিয়েছিলেন স্বনামধন্য অধ্যাপক তারকনাথ সেনের কাছে। সে অভিজ্ঞতার কথা কৃষ্ণা বসু লিখে গিয়েছেন তাঁর হারানো ঠিকানা গ্রন্থে। কৃষ্ণা বসুর সাহিত্যচর্চার শুরু অবশ্য তারও আগে, বাবা চারুচন্দ্র চৌধুরীর বাড়ির গ্রন্থাগারে। পরবর্তী কালে সাহিত্য ও ইতিহাসের মেলবন্ধনে তাঁর কলমে রূপ পেয়েছে নিত্যনতুন স্বাদ ও বোধের বহুবিধ রচনা। ১৯৭৯ সালে স্বামী শিশিরকুমার বসুর সঙ্গে ইউরোপ ভ্রমণ, সেই সঙ্গে তাঁর গবেষণা ও বক্তৃতার ফসল তাঁর লেখা গ্রন্থ ইতিহাসের সন্ধানে। ১৯৭৯ সালেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর পদচিহ্ন অনুসরণ-অভিজ্ঞতা গ্রন্থিত হয় চরণরেখা তব বইটিতে। সাহিত্য, ইতিহাস ও পরে রাজনীতির আঙিনায় তাঁর প্রিয় ‘কৃষ্ণাদি’র সচ্ছন্দ ব্যাপ্তি মুগ্ধ করেছে গায়ত্রীকে, স্মারক বক্তৃতায় বলবেন সেই নিয়ে। ‘নেতাজি রিসার্চ ব্যুরো’-র আয়োজনে অনুষ্ঠান ঐতিহাসিক নেতাজি ভবনে, ২৬ ডিসেম্বর শনিবার সন্ধে ৬টায়। ছবিতে জর্জ অরওয়েল-এর বই হাতে কৃষ্ণা বসু, ১৯৫৩ সালে।

অনুবাদে গুপী-বাঘা

“চারদিকে একটা কি কাণ্ড হচ্ছে। ঝাপসা ঝাপসা কালো কালো, এই বড় বড় কি যেন সব গাছের উপর থেকে উঁকি মারতে লেগেছে। তাদের চোখগুলো জ্বলছে, যেন আগুনের ভাটা, দাঁতগুলো বেরুচ্ছে যেন মুলোর সার।” আজকের বঙ্গশিশুরা কি উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর অননুকরণীয় কলম আর বাংলা ভাষার স্বাদ-গন্ধ পাচ্ছে? কিংবা বাংলার বা দেশের বাইরে বড়-হওয়া শিশুরা? ইংরেজি-উন্মুখ এই সমাজে বাংলা ক্রমশ ক্ষীয়মাণ, এই তর্ক ও আক্ষেপের ও পারেও একটা চর্চা ঘনাচ্ছে: তাবৎ ধ্রুপদী বাংলা শিশুসাহিত্যের সুখপাঠ্য ইংরেজি অনুবাদের প্রয়োজনীয়তা, যার পাখায় ভর করে দেশ ও বিশ্বকে চেনানো যেত বাংলার শিশুসাহিত্যের রত্নসম্ভার। সেই কাজটাই করেছেন তিলোত্তমা সোম, দি অ্যাডভেঞ্চার্স অব গুপী দ্য সিঙ্গার অ্যান্ড বাঘা দ্য ড্রামার (প্রকাশক: টকিং ক্লাব) ইংরেজি অনুবাদে। শিশুপাঠ্য সুন্দর ভাষার পাশে বড় প্রাপ্তি সায়ন মুখোপাধ্যায়ের সাদা-কালো স্কেচে গুপী-বাঘা আর চিরচেনা চরিত্রদের কাণ্ডকারখানার ছবি। গতকাল ছিল উপেন্দ্রকিশোরের প্রয়াণদিন, সেই আবহে এই বইয়ের গুরুত্ব অনুভূত আরও।

সুন্দরবনের জন্য

দক্ষিণ রায়, বনবিবি, হিংস্র জলচর আর বিরূপ প্রকৃতি নিয়েই যুগ যুগ ধরে সমতলকে মহাবিপর্যয় থেকে বাঁচায় রহস্য-রোমাঞ্চে ভরা সুন্দরবন। সে শুধু ম্যানগ্রোভ অরণ্য মাত্র নয়, তার বুকে রোজ মৃত্যুর শ্বদন্তের সঙ্গে লড়াই করেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। তাঁদের ভাল থাকার ও রাখার কথা মনে রেখে, জল জঙ্গল পশু সম্পর্কিত গবেষণাধর্মী নিবন্ধসম্ভার নিয়ে প্রকাশিত হয় ত্রৈমাসিক পত্রিকা শুধু সুন্দরবন চর্চা (সম্পাদক: জ্যোতিরিন্দ্রনারায়ণ লাহিড়ী)। নতুন সংখ্যাটির মূল বিষয় বাদাবনের বিপন্ন কামট। অরণ্যের ইতিহাস থেকে এলাকার আর্থসামাজিক সংগ্রামের তথ্য ও বিশ্লেষণে সমৃদ্ধ সংখ্যাটি। সম্প্রতি পত্রিকার দশ বছর পূর্তিতে উদ্বোধন হল ওয়েবসাইট ‘সুন্দরবন চর্চা ডট ওআরজি’। আন্তর্জাল-অনুষ্ঠানে ছিলেন কল্যাণ রুদ্র, অনু জালে, মোহসীন উল হাকিম প্রমুখ। পত্রিকার প্রতিটি সংখ্যা, সুন্দরবন সম্পর্কিত প্রকাশিত খবর ও নিবন্ধ, আমপান-ধ্বস্ত কূল বা বাঘের চোখে চোখ রাখা মানুষ— জঙ্গলদুনিয়ার ছবি এবং বনের মানচিত্র পাওয়া যাবে ওয়েবসাইটে। সুন্দরবন-জীবনের উন্নয়নে পত্রিকাটি কী ভাবে জড়িয়ে আছে জানা যাবে তা, আগ্রহীজন যুক্ত হতে পারবেন সেই মহতী লক্ষ্যে।

আম্রপালী

১৭ ডিসেম্বর জন্মদিন ছিল ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউট (আইএসআই)-এর। ১৯৩১ সালের এই দিনে প্রেসিডেন্সি কলেজের স্ট্যাটিসটিক্যাল ল্যাবরেটরিতে যাত্রা শুরু এই প্রতিষ্ঠানের, প্রতিষ্ঠাতা প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ। পরের বছর ২৮ এপ্রিল প্রথাগত ভাবে নথিভুক্ত হয় প্রতিষ্ঠানটি। ১৯৪১-এ বরানগরে একটি বাড়ি-সহ এক খণ্ড জমি কেনেন প্রশান্তচন্দ্র, তখন চারপাশে আমগাছের প্রাচুর্য থাকায় বাড়ির নাম ‘আম্রপালী’ (ছবিতে) রেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রোনাল্ড ফিশার, হ্যারল্ড হোটেলিং, ফ্র্যাঙ্ক ইয়েটস, নোরবার্ট উইনার, কুরি দম্পতি, জুলিয়ান হাক্সলে, জে বি এস হলডেন-এর মতো পণ্ডিত ও বিজ্ঞানীরা অতিথি হয়ে এসেছেন এ বাড়িতে, এখানে থেকেছেন জওহরলাল নেহরুও। রবীন্দ্রনাথ ও প্রশান্তচন্দ্রের ছিল তিন দশকের গভীর সম্পর্ক, সেই সখ্যকেই এক নন্দিত আলেখ্যে বেঁধেছেন আইএসআই-এর প্রাক্তনী, বিবেকানন্দ বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের শিক্ষক সুদেষ্ণা বসু। ‘টুগেদারনেস’ নামের আলেখ্যটিতে ভাষ্য পাঠ করেছেন বিশিষ্ট অভিনেতা বরুণ চন্দ, সঙ্গীতে সুদেষ্ণা নিজে। অতিমারির আগের কলকাতায় জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি ও রবীন্দ্রতীর্থে পরিবেশিত হয়েছে এই আলেখ্য, এখন অপেক্ষা পরবর্তী সুযোগের।

নতুন মঞ্চ

বাংলায় হিন্দি থিয়েটারের অন্যতম পুরোধা ঊষা গঙ্গোপাধ্যায় জীবনমঞ্চ ছেড়ে গিয়েছেন এ বছর, তাঁর শিল্পের স্পর্শ তবু এই শহরে, তাঁর তৈরি ‘রঙ্গকর্মী স্টুডিয়ো থিয়েটার’-এ। ৬৪ দিনের বিরামহীন শ্রমে, প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডের এই স্টুডিয়ো থিয়েটারেই তাঁর শিষ্যদল গড়ে তুলেছেন ‘ঊষা গঙ্গোপাধ্যায় মঞ্চ’। স্থপতি অমিতাভ ঘোষের চিন্তনে, অনিরুদ্ধ সরকারের পরিকল্পনায় নির্মিত মঞ্চের অনুষ্ঠানক্ষেত্রটি সুপরিসর, আছে ৭০ জন দর্শকের বসার ব্যবস্থা, শব্দ-আলোর সুষ্ঠু ব্যবস্থা, সাজঘর, ফোটোশুটের বন্দোবস্ত, আধুনিক কাফে। নাটক, নাচ, গান, যোগ ও অন্যান্য কলার প্রদর্শনী ও কর্মশালার পরিকল্পনা আছে দলের। নতুন মঞ্চে নবীন প্রতিভাদের সুযোগ দিতেও আগ্রহী তাঁরা। ১৯ ডিসেম্বর, শনিবার সন্ধেয় মঞ্চটির উদ্বোধন হল।

নাটকের কলকাতা

অতিমারিতে বিধ্বস্ত পরিযায়ী শ্রমিকেরা, কর্মহীনতা ও ক্ষুধার তাড়নায় বিপর্যস্ত জীবন। এই সঙ্কটকে তুলে ধরতেই ‘স্পন্দন’ নাট্যগোষ্ঠী তাদের নতুন প্রযোজনা হিসেবে বেছে নিয়েছে মাইম-থিয়েটার। “আমাদের এই প্রযোজনাটির নির্দেশনায় আছেন মাইম-বিশেষজ্ঞ অমিত পাল।”— নাট্যদলের পক্ষে জানালেন সমুদ্র গুহ। অভিবাসন নামাঙ্কিত মাইম-নাট্যটি অভিনীত হবে গোর্কি সদনে, ২৩ ডিসেম্বর বিকেল ৫টায়। ‘স্পন্দন’-এর সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে রুশ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গোর্কি সদন ও ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ, কলকাতা। অন্য দিকে, কেয়া চক্রবর্তী স্মরণে প্রতি বছর নাট্যোৎসব আয়োজন করে নাট্যদল ‘ঊহিনী কলকাতা’। ভালবাসার তারে বাঁধা এই উৎসবের নাম ‘অনন্ত কেয়া বিকেল’। দ্বাদশ বছরে নাট্যোৎসবের তৃতীয় পর্ব ২৪, ২৫ ও ২৮ ডিসেম্বর সন্ধে সাড়ে ৬টা থেকে— প্রথম ও তৃতীয় দিন নাগেরবাজারের থিয়েঅ্যাপেক্স-এ, দ্বিতীয় দিন যাদবপুরের নিরঞ্জন সদনে। থাকছে ঊহিনী-র গান ও নাটক পত্রলেখা (নির্দেশনা অদ্রিজা দাশগুপ্ত), কবিতা-অভিনয়, সুদীপ গুপ্তের ‘ডলস থিয়েটার’-এর পুতুল নাটক, এ ছাড়াও গুরুগ্রাম, পুণে, গুয়াহাটির দলের প্রযোজনা।

অভিনব মেলা

লেখালিখিতুতো বন্ধুরা মিলে শুরু করেছিলেন একটি ছোট পত্রিকা— ‘কলিখাতা’। পাঁচ বছরের একত্র ভাবনাযাপনের ফসল নিয়মিত সংখ্যাগুলি, বিষয়ও বহুবিধ— ডাস্টবিন, গ্রামজীবন, মৃত্যুচেতনা, কবিতার আঙ্গিক। চিত্রকলা নিয়ে সমবেত-চিন্তার ফসল সম্প্রতি রূপ পেয়েছে বইয়ে, প্রকাশনীরও শুরু সেটা। বই করলেই হল না, পাঠকের কাছে পৌঁছতেও হবে— এই ভাবনা থেকে বন্ধুরা তৈরি করলেন অনলাইন বই-দোকানঘর ‘কলিখাতা ডট ইন’। অতিমারিলাঞ্ছিত এই সময়ে বইমেলা ঘিরে অনিশ্চয়তাকে রুখে দিয়ে কলিখাতা ডট ইন-এর আয়োজনে দশ দিনের ‘অনলাইন পুরনো বইমেলা’ শেষ হল গতকাল। চলছে ‘অনলাইন লিটল ম্যাগাজ়িন মেলা’— শুরু হয়েছে ১৮ ডিসেম্বর, চলবে ২২ অবধি। যোগ দিয়েছে মুদ্রিত ও ই-পত্রিকা মিলিয়ে মোট কুড়িটি পত্রিকা। মুঠোফোন বা কম্পিউটারের এক ক্লিকেই পাঠক সংগ্রহ করতে পারবেন প্রিয় পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা।

এই বাংলারও

শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ, বিজয় দিবসের পঞ্চাশ বছর— এই দু’টি ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী চলতি বছর। বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতিকে এক নতুন রাষ্ট্রের শেকড়ে গেঁথে দেওয়া এই জননেতাকে সমসময়ের এ পার বাংলা কী চোখে দেখে, তারই তত্ত্বতালাশ পাওয়া যাবে এপারের চোখে মুজিব (প্রকাশক: ‘কণ্ঠস্বর’ ও ‘সময়’) সঙ্কলনগ্রন্থে। দুই বাংলার বিশিষ্টজনের কলমে উঠে এসেছে ‘রাজনৈতিক জাদুকর’ বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি, বিদেশনীতি, সংখ্যালঘু উন্নয়ন, জনস্বাস্থ্য সম্পর্কে ধারণা। মধুমতী পারের মানুষটি কী ভাবে বাঙালির নাটক, চলচ্চিত্র, কবিতা, খেলাধুলো-সহ সংস্কৃতির নানা পরিসরকে প্রভাবিত ও উজ্জীবিত করেছেন, আছে সে আলোচনাও।

ব্যতিক্রমী

শিক্ষিত বাঙালির কাছে সমুদ্র বিশালত্বের চিহ্নস্বরূপ, যার কাছে গেলে সংসারের তাবৎ ক্ষুদ্রতা থেকে মুক্তি মেলে। ইতিপূর্বে তীর্থযাত্রীর কাছ সমুদ্রের তীরটাই ছিল গুরুত্বপূর্ণ। সমুদ্রের সঙ্গে তাঁর হাসি-তামাশার সম্পর্ক। ভক্তের চোখে সমুদ্র যেন ঈশ্বরেরই নামগান করে। ইংরেজি শিক্ষার প্রভাবে বাঙালি সমুদ্রের বিশালত্বকে চিনতে শেখে। এই বিরাটের উপর যেন পুরুষের অধিকার। পুরুষের কল্পনায় নারী সেই বৃহতের জন্য যথেষ্ট বড় পাত্র নয়। তার কাছে শুধু সংসার নয়, মেয়েরাও ক্ষুদ্র। ‘সমুদ্রের আমিষ গন্ধ: বাঙালি পুরুষ-জীবনে গৃহ, রমণী, ও অসীমের স্বাদ’ শিরোনামে এক বক্তৃতায় গত ১৫ ডিসেম্বর এমনটাই বললেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক দীপেশ চক্রবর্তী। ‘সোসাইটি ফর আন্ডারস্ট্যান্ডিং কালচার অ্যান্ড হিস্ট্রি ইন ইন্ডিয়া (শুচি)’-র উদ্যোগে ‘অধ্যাপক গৌতম চট্টোপাধ্যায় স্মারক বক্তৃতা’-য় বক্তা ছিলেন তিনি, সভাপতি ইতিহাসবিদ রণবীর চক্রবর্তী। ‘শুচি’-র ইউটিউব চ্যানেলে আগ্রহীজন শুনতে পারবেন ব্যতিক্রমী এই বক্তৃতাটি।

আনন্দযাত্রা

ছেলেবেলায় যাত্রাপালায় শোনা নদের নিমাই-এর গান ‘মেরেছিস কলসির কানা...’ তাঁর মারীচ সংবাদ-এও মোক্ষম ঠাঁই করে নিয়েছে, বলছিলেন অরুণ মুখোপাধ্যায়। সঙ্গীত নাটক অকাদেমি তাঁদের ফেসবুক পেজে প্রতি মঙ্গল ও শুক্রবার আয়োজন করছে অনুষ্ঠান ‘অন্তরঙ্গ’— বিশিষ্ট শিল্পীদের সঙ্গে কথালাপ— সেখানেই, গত ১৮ ডিসেম্বর সন্ধেয়। অংশুমান ভৌমিকের সঙ্গে আলাপে ফুটে উঠল বরেণ্য অভিনেতা-নির্দেশকের শিল্পযাপনচিত্র। গান গাইলেন, জগন্নাথ নাটক থেকে করলেন সংলাপ-অভিনয়ও। উঠে এল তাঁর ব্রেশট-প্রীতি, তিন বার তিন রকম করে ব্রেশট-এর মাদার তৈরি করা, লোরকা-র ইয়ারমা বা দ্য হাউস অব বার্নার্ডা আলবা থেকে মৃণাল সেনের ছবি পরশুরাম-এ অভিনয়সূত্রে জাতীয় পুরস্কারের প্রসঙ্গ। ৫০ বছরের দিকে এগোচ্ছে তাঁর নাট্যদল ‘চেতনা’, বললেন তাঁর দুই ছেলে সুমন ও সুজন মুখোপাধ্যায় এবং অগণিত ছাত্র- অনুরাগীর সংযোগ ও সখ্যে দলের অভিযাত্রার কথাও।

কেবল রাজনীতি

ভদ্রলোক থলি হাতে বাজার যাচ্ছিলেন। রাস্তার ধারে একটা বাড়ি থেকে কানে এল শিশুকণ্ঠ— ‘‘সে অনেক হাঙ্গাম। আগে হিসেব করে দেখতে হবে, দাদা কোথায় কোথায় নেই, তার পর হিসেব করে দেখতে হবে, দাদা কোথায় কোথায় থাকতে পারে, তার পর দেখতে হবে, দাদা এখন কোথায় আছে।’’ বেশ কিছুক্ষণ পরে বাজার সেরে ফিরছেন, শুনতে পেলেন— ‘‘তাও জানো না? সকালে আমার নাম থাকে আলুনারকোল আবার আর একটু বিকেল হলেই আমার নাম হয়ে যাবে রামতাড়ু।’’ থলি দুটো রান্নাঘরের মেঝেতে নামিয়ে ভদ্রলোক বললেন, ‘‘সমাজটা একেবারে উচ্ছন্নে গেছে। বাচ্চাগুলো পর্যন্ত সকাল থেকে কেবল রাজনীতি আর রাজনীতি... চা দাও এক কাপ।’’

বুকে বিদ্ধ তরবারি, শোকার্তা মা মেরি

কোলে মার্কেটের হট্টগোল, গাড়ির হর্ন, চেঁচামেচি যেন জাদুবলে আটকে থাকে ও পারে। গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকলেই কখনও শোনা যায় প্রার্থনা সঙ্গীত, ‘সুসমাচার’, কখনও শুধুই নিস্তব্ধতা। শিয়ালদহ ফ্লাইওভার আর সাবেক বৌবাজার স্ট্রিটের সংযোগস্থলে দাঁড়ালে যে গির্জার চুড়ো দেখা যায় (ছবিতে ডান দিকে), তার নাম ‘চার্চ অব আওয়ার লেডি অব ডলর্স’— ‘সপ্ত শোকার্ত মা মারিয়া’-র গির্জা। উত্তরে বৌবাজার, দক্ষিণ ও পূর্বে সার্কুলার রোডের মাঝের জায়গায় গড়ে উঠেছিল ঔপনিবেশিক কলকাতার বহু গির্জা, এলাকার বাসিন্দা ব্রিটিশ ও মিশ্র জাতিগোষ্ঠী-সহ বহু খ্রিস্টধর্মাবলম্বী মানুষের প্রয়োজনে। বৌবাজারের এই প্রাচীন গির্জা তারই একটি।
১৮০৮ সালে মে মাসে মিসেস গ্রেস এলিজ়াবেথ নামে এক ক্যাথলিক মহিলা এই গির্জার নির্মাণকাজ শুরু করান। তাঁর জন্ম চট্টগ্রামে, যা আগে পর্তুগিজদের বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল। ১৮০৯-এর জুলাইয়ে কাজ শেষ হলে গির্জাটি উৎসর্গ করা হয় ‘লেডি অব ডলর্স’-এর নামে। তিনি আর কেউ নন, মা মেরি। এই গির্জার মূল আকর্ষণ তাঁর মূর্তিটি (বাঁ দিকের ছবি)। ক্যাথলিক মূর্তিতত্ত্বে অনেক সময় শোকের অভিজ্ঞান হিসেবে দেখানো হয়, মা মেরির হৃদয়ে গাঁথা তরবারি। ‘মেরিয়ান আর্ট’ শিল্পধারার এক গুরুত্বপূর্ণ রূপ এই ‘লেডি অব ডলর্স’— সাদা-নীল বস্ত্রাবৃতা, তরবারিবিদ্ধ, শোকাতুরা মেরি। এ ছাড়াও গির্জায় আছে ক্যাথলিক সন্তদের মূর্তি, ক্যাথলিকদের স্বীকারোক্তির ‘কনফেশন বক্স’, শিশুদের ব্যাপটাইজ় করা হয় যে পাত্রের জল দিয়ে, সেই ‘ব্যাপ্টিজ়মাল ফন্ট’। কলকাতার এই অঞ্চলে ১৮১০-১৯১৪ সাল পর্যন্ত বসবাসকারী পর্তুগিজদের জন্ম, মৃত্যু ও বিয়ের তথ্য সংবলিত নথি (১৯১৫ সালে সম্পাদিত ও প্রকাশিত) সংরক্ষিত আছে এই গির্জায়। উনিশ শতকের কলকাতা-চর্চায় অমূল্য দলিল এই তথ্যসম্ভার। বৌবাজার ও সংলগ্ন এলাকাগুলিতে তখন বাস করতেন এ শহরের পর্তুগিজ জনসংখ্যার একটি বড় অংশ। অনেকে ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ‘রাইটার’ বা কেরানি। তাঁদের স্মৃতি ধরে রেখেছে ‘কেরানীবাগান’ এলাকা। শিয়ালদা-বৌবাজার এলাকার গোমেজ লেন, ফরডাইস লেন, ডিক্সন লেনের নামেও মিশে কলকাতার সেই ‘ফিরিঙ্গি’ জনগোষ্ঠীর স্মৃতি।
দুশো বছরেরও বেশি পুরনো এই গির্জায় এক সময় শুধু পর্তুগিজ ভাষা ব্যবহার হত। গোয়ার আর্চবিশপের নির্দেশে ইংরেজি চালু হয়, পরে শুরু হয় বাংলাতে ধর্মোপদেশ। বড়দিনে গির্জা সেজে ওঠে আলোর মালায়। হয় দরিদ্রসেবাও। এ বছর অতিমারি-বিধি মেনেই বড়দিনের আগের মধ্যরাত্রের প্রার্থনা-সহ অন্যান্য অনুষ্ঠান হবে। নতুন ভোরের প্রার্থনায় ফাদার জয় ডি’সুজার সঙ্গে যোগ দেবেন সকলে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE