Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

নতুন রূপে সাবেক ফানুস, মন কেড়েছে উৎসব-শহরে

নির্বাসিত নবাবের হেঁশেল থেকে বেরিয়ে এলেও বনেদিয়ানা তার গা থেকে যাচ্ছিল না। কিন্তু চাহিদার এমনই জোর যে, বিরিয়ানি এখন পাড়ার দোকানেও মেলে! নবাবি হেঁশেলের সেই খোশবাই না থাকলেও বাঙালির চেটেপুটে খাওয়ায় কোনও খামতি নেই।

উড়তে দিলাম তোকে। রবিবার, বিবেকানন্দ পার্কে ফানুস উৎসব। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।

উড়তে দিলাম তোকে। রবিবার, বিবেকানন্দ পার্কে ফানুস উৎসব। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।

পিনাকী বন্দ্যোপাধ্যায় ও কুন্তক চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০১৬ ০১:৫২
Share: Save:

নির্বাসিত নবাবের হেঁশেল থেকে বেরিয়ে এলেও বনেদিয়ানা তার গা থেকে যাচ্ছিল না। কিন্তু চাহিদার এমনই জোর যে, বিরিয়ানি এখন পাড়ার দোকানেও মেলে! নবাবি হেঁশেলের সেই খোশবাই না থাকলেও বাঙালির চেটেপুটে খাওয়ায় কোনও খামতি নেই।

কলকাতার বনেদি বাড়ির চিলেকোঠার ফানুসের গল্পটাও অনেকটা এক। সেই আদি, অকৃত্রিম ফুটবল বা ভীমের গদা না-ই বা হল, ‘চিনে’ আকাশ লণ্ঠনেই সাধ মিটিয়েছে বহু মানুষ। কালীপুজোর রাতে আকাশ দিয়ে একের পর এক ফানুস ভেসে যেতে দেখে কেউ কেউ চলতি ট্রেনে ‘কাব্যি’-ও জুড়ে দিয়েছেন।

ফানুসের চাহিদা যে বাড়ছে, তার ইঙ্গিত গত বছর দুয়েক ধরেই মিলছিল। কিন্তু কালীপুজোর দিন তিনেক আগে ডালহৌসি চত্বরে ফানুস কিনতে দোকানে ভিড় উপচে পড়বে, তা ভাবতে পারেননি অনেকেই। দমদম স্টেশনে মেট্রো থেকে বেরিয়ে তাজ্জব বনে গিয়েছিলেন পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায়। সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে ফানুস বিক্রি করছেন এক যুবক। শুধু বিক্রিই করছেন না, ক্রেতাদের ফানুস ওড়ানোর কায়দাও বাতলাচ্ছেন তিনি। এ সবের ফল মিলেছে কালীপুজোতেও।

সন্ধ্যার পর থেকে আকাশে ভাসতে দেখা গিয়েছে একের পর এক ফানুস। গভীর রাতেও ফানুস ওড়ানো শেষ হয়নি। রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ দমদম স্টেশনের পশ্চিম দিকের আকাশে এক সঙ্গে সার দিয়ে সাতটি ফানুস ভেসে বেড়াচ্ছিল। তা দেখে এক যুবক সহযাত্রীকে বললেন, ‘‘ঠিক যেন গঙ্গার বুকে নৌকো ভেসে বেড়াচ্ছে!’’ রবিবার ভোর পাঁচটায় নিউ ব্যারাকপুর স্টেশনের কাছে জনা চারেক যুবক মিলে ফানুস উড়িয়েছেন। সকালে ঘুম থেকে উঠে ছাদে দু’টি ফানুসের ‘দেহ’ পড়ে থাকতে দেখে চমকে উঠেছিলেন দীপনারায়ণ চৌধুরী। ফানুসপ্রেমী দীপনারায়ণ সেই বার্তা রটিয়ে দিয়েছেন হোয়্যাটসঅ্যাপ-ফেসবুকে।

গোরাবাজারের বাজি ব্যবসায়ী বাবু গুহ এ বার কিছু ফানুস তুলেছিলেন। তাঁর কথায়, ‘‘বেশির ভাগই আগে বিক্রি হয়েছিল। কালীপুজোর সন্ধ্যাতেও বাকি ক’টা ফানুস নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে গিয়েছিল।’’ চাহিদা বাড়তেই কোনও কোনও দোকানি মওকা বুঝে কুড়ি টাকার ফানুস সত্তর-আশি টাকায় বেচেছেন। টালা পার্কের বাজি বাজারের উদ্যোক্তা সঞ্জয় দত্ত বলছেন, এ বার প্রচুর ফানুস বিক্রি হয়েছে। ‘‘বাজি বাজারে কেউ হয়তো এক প্যাকেট আতসবাজি কিনেছেন। কিন্তু তার সঙ্গে দু’প্যাকেট ফানুসও কিনেছেন!’’

বাজারে এমন চাহিদা থাকলেও চিনে ফানুসকে তেমন নম্বর দিতে নারাজ অনেকে। তাঁরা বলছেন, ফানুস শুধু আঁধারে ভেসে যাওয়া আকাশ লণ্ঠন নয়, এর দেখনদারিটাই আসল। ভরদুপুরে বা সাঁঝের আগে আকাশে ভেসে যাওয়া পেল্লাই ফুটবল বা ঘড়ি দেখতে ছাদে ভিড় করত লোকজন। উত্তর কলকাতার পুরনো বাসিন্দাদের মতে, ওই ফানুস যদি অযোধ্যার নবাব ওয়াজে়দ আলি শাহের হেঁশেল খ্যাত বিরিয়ানি হয়, ‘চিনে’ ফানুস নেহাতই রাস্তার মোড়ের লাল শালু মোড়া হাঁড়ির হলদে-সাদা ‘মাংস ভাত’। ‘‘তা-ও তো এই আকাশ লণ্ঠন খাঁটি চৈনিক বংশোদ্ভূত নয়। এ দেশে তৈরি ফানুসের গায়েই চিনে তকমা সেঁটে দেওয়া হচ্ছে,’’ বলছেন এক ফানুসপ্রেমী।

যা-ই হোক না কেন, এই চিনে ফানুসের হাত ধরে পুরনো ফানুস প্রেম তো জেগে উঠছে। মেনে নিচ্ছেন উত্তর কলকাতার ফানুসপ্রেমী অজয় দত্ত। তিনি বলছেন, ফানুস নিয়ে আগ্রহ তো রয়েছে, কিন্তু পুরনো বাড়িগুলো ভেঙে যাচ্ছে, ভেঙে যাচ্ছে যৌথ পরিবার। ফলে ফানুস তৈরির সময়, লোকবল— সবই তো কমছে। একই সুর কম্পিউটার প্রযুক্তি প্রয়োগে ফানুসের নকশা তৈরি করা রজত মল্লিকের গলাতেও। বলছেন, ‘‘ফানুস তৈরির যা খাটনি, তাতে অনেকেই পেরে ওঠেন না। তাই চিনে ফানুস উড়িয়েই সাধ মেটাচ্ছেন বেশির ভাগে।’’

পাড়ার মোড়ে শুধু নয়, বিরিয়ানি প্রেম কিন্তু এখন ঢুকে প়ড়েছে বাঙালির হেঁশেলেও। ছোট অনুষ্ঠান কিংবা বন্ধুদের জমায়েতে বিরিয়ানি রেঁধে তাক লাগিয়ে দেন, এমন গিন্নির সংখ্যা নেহাত কম নয়। তেমনই চিনে ফানুসের প্রেম আদি ফানুস তৈরির উৎসাহ জোগাবে, এই আশাতেই বুক বাঁধছেন অনেকে। সুকিয়া স্ট্রিটের একটি কালীপুজো যেমন গত বছর বিসর্জনে চিনে ফানুস উড়িয়ে তাক লাগিয়েছিল। এ বার ওই কমিটির সদস্যেরা অজয়বাবুকে আদি ফানুস তৈরির জন্য পাকড়াও করেছেন।

বেলগাছিয়ার ফানুসপ্রেমী দেবাশিস মুখোপাধ্যায়ও আশা করেন, বাঙালির ফানুস তৈরির ঐতিহ্য টিঁকিয়ে রাখতেই হবে। এ জন্য ফানুসপ্রেমীদের এক জায়গায় জড়ো করার পরিকল্পনাও করেছেন তিনি। দেবাশিসবাবু বলছেন, ‘‘গুজরাতে যেমন ঘুড়ি উৎসব হয়, তেমন এ রাজ্যে ফানুস উৎসব হবে না কেন?’’

উৎসব হোক বা না হোক, ইচ্ছের ফানুস ওড়াতে তো বাধা নেই!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Sky lanterns Festival
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE